আমি বহুভাষাবিদ নই। বাংলা আর ইংরেজি বাদে অন্য কোন ভাষায় দখল নেই। ফলে ভিন্ন ভাষার সাহিত্যের স্বাদ নেবার জন্য অনুবাদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু অনুবাদ বিষয়ে আমার কিছু বিবমিষা তৈরী হয়েছে নানান সময়ে, যেটা আমাকে অনুবাদ পাঠ থেকে বিরত রেখেছে দীর্ঘকাল। সংগ্রহে থাকা প্রচুর অনুবাদ সাহিত্য অপঠিত রয়ে গেছে।
অনুবাদ পড়তে কেন ভয় পাই -সেই প্রশ্নের উত্তরে একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার অবস্থানটি যথাসম্ভব ছোট পরিসরে ব্যাখ্যা করলাম। জানতে ইচ্ছে করে এমন অভিজ্ঞতা আরো মানুষের আছে কিনা।
++কেমন অনুবাদ চাই++
অনুবাদ মানে শব্দার্থ নয়। যথার্থ অনুবাদ বিষয়টি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। প্রতিটি ভাষার নিজস্ব একটি ব্যাকরণ আছে, স্বতন্ত্র একটি চেতনা আছে, ভাব প্রকাশের শৈলী আছে। আরো আছে নানান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য যা একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। একটি অনুবাদ তখনই সফল হয় যখন এই বিভিন্ন মাত্রার শিল্প সুষমাকেও রূপান্তরিত করে ভিন্ন ভাষায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। সবগুলো মাত্রাকে শুধুমাত্র আক্ষরিক অনুবাদ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। যে অনুবাদ এই শর্তগুলো যত বেশী পরিমানে পূর্ণ করতে পারে সেই অনুবাদ ততখানি সফল।
একাডেমিক বই অনুবাদ যতটা সহজ, সাহিত্যের বিষয়াদি অনুবাদ তার চেয়ে বহুগুন কঠিন। তথ্যভিত্তিক বইগুলো শুধু তথ্যের অনুবাদ ঠিক থাকলেই চলে। কিন্তু একটা সাহিত্য যে ভাষায় রচিত হয় সেই ভাষাগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক চেতনাও ধারণ করে। একজন অনুবাদক যদি মূল ভাষার সেই সাংস্কৃতিক চেতনার সাথে যথেষ্ট পরিমানে পরিচিত না থাকেন তাঁর পক্ষে যথার্থ অনুবাদের পথে হাঁটা অসম্ভব।
বাংলা ভাষায় যথার্থ অনুবাদের উদাহরণ খুব বেশী নেই। ব্যক্তিগত পাঠাভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি প্রচুর অনুবাদ মূল সুর থেকে অনেকটা দূর দিয়ে হেঁটেছে। অর্থ ঠিক থাকলেও অনুবাদকের ভুল শব্দচয়নের কারণে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে পাঠককে। বাংলা আমার মাতৃভাষা, ইংরেজি শুধুমাত্র পাঠ্য ভাষা। বাংলার চেয়ে ইংরেজি জ্ঞান অনেকটা কম হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি বইয়ের বাংলা অনুবাদের চেয়ে মূল ইংরেজির সাহিত্য পাঠ অনেক বেশী বোধগম্য হয় আমার কাছে। আক্ষরিক অনুবাদ ব্যাপারটা তো রীতিমত ভয়াবহ। আমাদের অধিকাংশ অনুবাদক সরাসরি আক্ষরিক অনুবাদের পথ ধরেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি শব্দের আভিধানিক অর্থ শুদ্ধ হলেও বাক্যটি তার সঠিক অর্থ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
++একটি উদাহরন++
জেরোম কে জেরোমের 'থ্রি ম্যান ইন আ বোট' বইটি ছাত্রজীবন থেকেই আমার খুব পছন্দের একটি বই। এই বইয়ের তিনটি বঙ্গানুবাদ পাঠের সুযোগ হয়েছে। সেবা প্রকাশনী, বাংলা একাডেমি এবং পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রকাশনীর। এখানে একমাত্র সেবা প্রকাশনীর অনুবাদটিই(অনুবাদক এ.টি.এম. শামশুজ্জামান) মূল বইয়ের কাছাকাছি যেতে পেরেছে। সেবার অধিকাংশ অনুবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো তা পাঠককে বুঝতে দেয় না এটি একটি অনুবাদ। সীমাবদ্ধ পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- নিজের ভাষার আদলে একটি বিদেশী সাহিত্যকে উপস্থাপন করার নজির বাংলাদেশে সেবা প্রকাশনী ছাড়া আর কোন প্রকাশনীতে চোখে পড়েনি আমার।
++একটি অভিজ্ঞতা++
সম্প্রতি কাহলিল জিবরানের 'দ্য ব্রোকেন উইংস' বইটির একটি অনুবাদ(অনুবাদক: মোস্তফা মীর, অনিন্দ্য প্রকাশনী) পড়তে গিয়ে হোঁচট নয় রীতিমত হুমড়ি খেয়ে পড়ার যোগাড় হয়েছিল। অথচ ইংরেজি বইটি এই অনুবাদের চেয়ে বহুগুন সহজবোধ্য। কেবল দুটি বাক্যের উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে-
"নারীর চোখ থেকে নিক্ষেপ করা একটি দৃষ্টি তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত করবে।"
One look from a woman's eye makes you the happiest man in the world.
"সেই রাতে সেলমা যে কথা উচ্চারণ করেছিল তা আমার অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝখানে আমাকে গ্রেফতার করে রেখেছিল, যেন মধ্যসমুদ্রে নোঙর করা একটা নৌকা"
That word which Selma uttered that night arrested me between my past and future, as a boat which is anchored in the midst of the ocean.
এই দুটি বাক্যবন্ধের মধ্যে 'নারীর চোখ থেকে নিক্ষেপ করা একটি দৃষ্টি' এবং 'অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝখানে আমাকে গ্রেফতার করে রাখা' পাঠক হিসেবে আমাকে খুব মর্মাহত করেছিল। যদি অনুবাদক গল্পটির মূল সুর ধরতে অক্ষম হন কিংবা বেখেয়াল হন পাঠকের যে দুর্বিসহ অবস্থা উপস্থিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের অনুবাদ জগতে এমন উদাহরণ শত শত, হাজার হাজার।
আবার জি.এইচ. হাবীব অনূদিত হাণ্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড বইটির অনুবাদ 'নিঃসঙ্গতার একশো বছর' পড়ে বেশ ভালো লেগেছিল। গোটা বইটি না থেমে এক নাগাড়ে পড়ে শেষ করতে তেমন কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি। মূলের সাথে অনুবাদের দূরত্ব যেটুকু ছিল তাকে সহনীয় বলা চলে। এক্ষেত্রে অনুবাদক উপরে উল্লেখিত শর্তাবলী মোটামুটিভাবে পালন করতে পেরেছেন। পাঠক হিসেবে তা আমাকে তৃপ্ত করেছিল।
++শেষ কথাটি++
আমি জানি অনুবাদ খুব পরিশ্রমসাধ্য একটি কাজ। ছোটখাট কিছু অনুবাদ কর্ম করে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। আস্ত একটি বই কিংবা সমস্ত কোন রচনাবলী অনুবাদ খুবই দুঃসাধ্যের একটি কাজ। এত পরিশ্রমসাধ্য কাজটি যদি পাঠকের মননে প্রবেশযোগ্য না হয় তাহলে সেই অনুবাদের কোন অর্থ হয় না। সেই কাজটাকে পণ্ডশ্রম বলেই ধরে নেয়া যায়। অনুবাদ করার জন্য সেই ভাষা ও সংস্কৃতির উপর যথেষ্ট দখল এবং নিজের ভাষায় বৈচিত্র্যময় শব্দচয়নের দক্ষতা না থাকলে সেই পথে না হাঁটাই উচিত।
এইসব কারণে আমি অনুবাদ পড়তে ভয় পাই, সেই সাথে অনুবাদ করতেও। একই কারনে হাতে থাকা অসমাপ্ত অনুবাদকর্মগুলো অগ্রসর হতে সাহস পাচ্ছে না।
অনুবাদ পড়তে কেন ভয় পাই -সেই প্রশ্নের উত্তরে একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার অবস্থানটি যথাসম্ভব ছোট পরিসরে ব্যাখ্যা করলাম। জানতে ইচ্ছে করে এমন অভিজ্ঞতা আরো মানুষের আছে কিনা।
++কেমন অনুবাদ চাই++
অনুবাদ মানে শব্দার্থ নয়। যথার্থ অনুবাদ বিষয়টি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। প্রতিটি ভাষার নিজস্ব একটি ব্যাকরণ আছে, স্বতন্ত্র একটি চেতনা আছে, ভাব প্রকাশের শৈলী আছে। আরো আছে নানান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য যা একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। একটি অনুবাদ তখনই সফল হয় যখন এই বিভিন্ন মাত্রার শিল্প সুষমাকেও রূপান্তরিত করে ভিন্ন ভাষায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। সবগুলো মাত্রাকে শুধুমাত্র আক্ষরিক অনুবাদ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। যে অনুবাদ এই শর্তগুলো যত বেশী পরিমানে পূর্ণ করতে পারে সেই অনুবাদ ততখানি সফল।
একাডেমিক বই অনুবাদ যতটা সহজ, সাহিত্যের বিষয়াদি অনুবাদ তার চেয়ে বহুগুন কঠিন। তথ্যভিত্তিক বইগুলো শুধু তথ্যের অনুবাদ ঠিক থাকলেই চলে। কিন্তু একটা সাহিত্য যে ভাষায় রচিত হয় সেই ভাষাগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক চেতনাও ধারণ করে। একজন অনুবাদক যদি মূল ভাষার সেই সাংস্কৃতিক চেতনার সাথে যথেষ্ট পরিমানে পরিচিত না থাকেন তাঁর পক্ষে যথার্থ অনুবাদের পথে হাঁটা অসম্ভব।
বাংলা ভাষায় যথার্থ অনুবাদের উদাহরণ খুব বেশী নেই। ব্যক্তিগত পাঠাভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি প্রচুর অনুবাদ মূল সুর থেকে অনেকটা দূর দিয়ে হেঁটেছে। অর্থ ঠিক থাকলেও অনুবাদকের ভুল শব্দচয়নের কারণে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে পাঠককে। বাংলা আমার মাতৃভাষা, ইংরেজি শুধুমাত্র পাঠ্য ভাষা। বাংলার চেয়ে ইংরেজি জ্ঞান অনেকটা কম হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি বইয়ের বাংলা অনুবাদের চেয়ে মূল ইংরেজির সাহিত্য পাঠ অনেক বেশী বোধগম্য হয় আমার কাছে। আক্ষরিক অনুবাদ ব্যাপারটা তো রীতিমত ভয়াবহ। আমাদের অধিকাংশ অনুবাদক সরাসরি আক্ষরিক অনুবাদের পথ ধরেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি শব্দের আভিধানিক অর্থ শুদ্ধ হলেও বাক্যটি তার সঠিক অর্থ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
++একটি উদাহরন++
জেরোম কে জেরোমের 'থ্রি ম্যান ইন আ বোট' বইটি ছাত্রজীবন থেকেই আমার খুব পছন্দের একটি বই। এই বইয়ের তিনটি বঙ্গানুবাদ পাঠের সুযোগ হয়েছে। সেবা প্রকাশনী, বাংলা একাডেমি এবং পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রকাশনীর। এখানে একমাত্র সেবা প্রকাশনীর অনুবাদটিই(অনুবাদক এ.টি.এম. শামশুজ্জামান) মূল বইয়ের কাছাকাছি যেতে পেরেছে। সেবার অধিকাংশ অনুবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো তা পাঠককে বুঝতে দেয় না এটি একটি অনুবাদ। সীমাবদ্ধ পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- নিজের ভাষার আদলে একটি বিদেশী সাহিত্যকে উপস্থাপন করার নজির বাংলাদেশে সেবা প্রকাশনী ছাড়া আর কোন প্রকাশনীতে চোখে পড়েনি আমার।
++একটি অভিজ্ঞতা++
সম্প্রতি কাহলিল জিবরানের 'দ্য ব্রোকেন উইংস' বইটির একটি অনুবাদ(অনুবাদক: মোস্তফা মীর, অনিন্দ্য প্রকাশনী) পড়তে গিয়ে হোঁচট নয় রীতিমত হুমড়ি খেয়ে পড়ার যোগাড় হয়েছিল। অথচ ইংরেজি বইটি এই অনুবাদের চেয়ে বহুগুন সহজবোধ্য। কেবল দুটি বাক্যের উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে-
"নারীর চোখ থেকে নিক্ষেপ করা একটি দৃষ্টি তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত করবে।"
One look from a woman's eye makes you the happiest man in the world.
"সেই রাতে সেলমা যে কথা উচ্চারণ করেছিল তা আমার অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝখানে আমাকে গ্রেফতার করে রেখেছিল, যেন মধ্যসমুদ্রে নোঙর করা একটা নৌকা"
That word which Selma uttered that night arrested me between my past and future, as a boat which is anchored in the midst of the ocean.
এই দুটি বাক্যবন্ধের মধ্যে 'নারীর চোখ থেকে নিক্ষেপ করা একটি দৃষ্টি' এবং 'অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝখানে আমাকে গ্রেফতার করে রাখা' পাঠক হিসেবে আমাকে খুব মর্মাহত করেছিল। যদি অনুবাদক গল্পটির মূল সুর ধরতে অক্ষম হন কিংবা বেখেয়াল হন পাঠকের যে দুর্বিসহ অবস্থা উপস্থিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের অনুবাদ জগতে এমন উদাহরণ শত শত, হাজার হাজার।
আবার জি.এইচ. হাবীব অনূদিত হাণ্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড বইটির অনুবাদ 'নিঃসঙ্গতার একশো বছর' পড়ে বেশ ভালো লেগেছিল। গোটা বইটি না থেমে এক নাগাড়ে পড়ে শেষ করতে তেমন কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি। মূলের সাথে অনুবাদের দূরত্ব যেটুকু ছিল তাকে সহনীয় বলা চলে। এক্ষেত্রে অনুবাদক উপরে উল্লেখিত শর্তাবলী মোটামুটিভাবে পালন করতে পেরেছেন। পাঠক হিসেবে তা আমাকে তৃপ্ত করেছিল।
++শেষ কথাটি++
আমি জানি অনুবাদ খুব পরিশ্রমসাধ্য একটি কাজ। ছোটখাট কিছু অনুবাদ কর্ম করে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। আস্ত একটি বই কিংবা সমস্ত কোন রচনাবলী অনুবাদ খুবই দুঃসাধ্যের একটি কাজ। এত পরিশ্রমসাধ্য কাজটি যদি পাঠকের মননে প্রবেশযোগ্য না হয় তাহলে সেই অনুবাদের কোন অর্থ হয় না। সেই কাজটাকে পণ্ডশ্রম বলেই ধরে নেয়া যায়। অনুবাদ করার জন্য সেই ভাষা ও সংস্কৃতির উপর যথেষ্ট দখল এবং নিজের ভাষায় বৈচিত্র্যময় শব্দচয়নের দক্ষতা না থাকলে সেই পথে না হাঁটাই উচিত।
এইসব কারণে আমি অনুবাদ পড়তে ভয় পাই, সেই সাথে অনুবাদ করতেও। একই কারনে হাতে থাকা অসমাপ্ত অনুবাদকর্মগুলো অগ্রসর হতে সাহস পাচ্ছে না।
No comments:
Post a Comment