Saturday, November 26, 2016

পাঁচ পয়সার গল্প

পাঁচ পয়সা দিয়ে বললাম, আজ আর নাই। এটা দিয়ে একটা আমসত্ত পাবে অথবা বৈয়ামে রাখা রঙিন চিনির লজেন্স।

মিষ্টি হেসে বললো, আমার তাতেই চলবে। বেশী চাওয়া নেই। তুমি দিতে চাও সে আমি খুব জানি। তোমার নেই বলে দিতে পারো না।

কত ছোট্ট একটা কথা অথচ কেমন চমৎকার বোধ। তুমি দিতে চাও, কিন্তু নেই বলে দিতে পারছো না। এতেই কী নিদারুণ সন্তুষ্টি। দিতে চাওয়াটাই তো আসল। ইচ্ছেটা সবচেয়ে মূল্যবান। আমার ইচ্ছেটা যদি তুমি বোঝো তাহলে কোথাও কোন সমস্যা নেই।

এখন আমার নেই বলে আমি দিতে পারছি না। যখন ছিল তখন চার আনা, আট আনা, এমনকি একটাকাও দিয়েছি। থাকলে দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু এখন আমার যে নেই, সেটা ও বুঝেছে। বুঝেছে বলেই পাঁচ পয়সা পেয়েও সন্তুষ্ট। বেশী চেয়ে বিরক্ত করছে না।

জীবনে এই বোঝাবুঝিটাই সবচেয়ে জরুরী। আমরা কেউ কেউ অবোধ থেকে যাই নিজের অজান্তেই। নিজেরা নিজেকেই বুঝি না, অন্যকে বোঝা দূর বাত। একটা শিশু যতটুকু বুঝদার, অনেক বয়স্ক তার ধারে কাছেও নেই।

বিশ শতকে বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়ে যাবার পর মানুষের মনুষ্যত্বকে শুষ্ক করে ফেলছে। বিদ্যুত কিংবা তেজষ্ক্রিয়তার কারণে চিরকালীন সহজ মানুষ, রুক্ষ মানুষে পরিণত হচ্ছে। যন্ত্র দেখত দেখতে যন্ত্রের মতো আচরণ করছে।

রবিঠাকুর যখন প্রথম আকাশে উড়লেন সেটা তাঁকে নতুন এক অনুভূতির দ্বার পরিগ্রহ করালো। দূরত্বের মরুশুষ্ক দৃষ্টিবিভ্রম তাঁকেও ভাবিয়েছে।  আকাশযান কিংবা ব্যোমতরী ভ্রমণে তাঁর প্রথম অভিব্যক্তি-

ব্যোমতরী বাংলাদেশের উপর দিয়ে যতক্ষণ চলল ততক্ষণ ছিল মাটির কতকটা কাছাকাছি। পানাপুকুরের চারি ধারে সংসক্ত গ্রামগুলি ধূসর বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো দ্বীপের মতো খণ্ড খণ্ড চোখে পড়ে। উপর থেকে তাদের ছায়াঘনিষ্ঠ শ্যামল মূর্তি দেখা যায় ছাড়া-ছাড়া, কিন্তু বেশ বুঝতে পারি আসন্ন গ্রীষ্মে সমস্ত তৃষাসন্তপ্ত দেশের রসনা আজ শুষ্ক। নির্মল নিরাময় জলগণ্ডুষের জন্য ইন্দ্রদেবের খেয়ালের উপর ছাড়া আর-কারো 'পরে এই বহু কোটি লোকের যথোচিত ভরসা নেই।

মানুষ পশু পাখি কিছু যে পৃথিবীতে আছে সে আর লক্ষ্য হয় না। শব্দ নেই, গতি নেই, প্রাণ নেই; যেন জীববিধাতার পরিত্যক্ত পৃথিবী তালি-দেওয়া চাদরে ঢাকা। যত উপরে উঠছে ততই পৃথিবীর রূপবৈচিত্র্য কতকগুলি আঁচড়ে এসে ঠেকল। বিস্মৃতনামা প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতিলিপি যেন অজ্ঞাত অক্ষরে কোনো মৃতদেশের প্রান্তর জুড়ে খোদিত হয়ে পড়ে আছে; তার রেখা দেখা যায়, অর্থ বোঝা যায় না।

রবিঠাকুর কয়েক বছর হলো বিগত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রতিটি বাণীর অন্তর্নিহিত সত্য আমাদের প্রতিদিন আলোড়িত করে।

পারমিতার সাথে আমার আজকাল কোন দূরত্ব নেই। মানসিকবোধটা আমাদের এত গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে এখানে ভৌগলিক দূরত্ব আর কোন দ্বিধার দেয়াল তুলতে পারে না।

আজ দুপুরে ডাক হরকরা যখন ঝুলি থেকে চিঠিটা বের করছিল তখন আমি জানতাম ওটা পারমিতা। চিঠি খুলে অবাক হয়ে দেখলাম, সেও আমার মতো একই কথা ভেবেছে। দুজনের চিন্তার এতখানি মিল এত যুগেও কমেনি।

১৯৩০ সালের পর ওর মুখখানি আর একবারও দেখিনি। এখন আর দেখতেও চাই না। যে চিত্রটি আমার ভেতরে মুদ্রিত হয়ে আছে সেই ছবিটাই থাকুক।

ইচ্ছেটা আছে। দুজনেই জানি দুজনের ইচ্ছে। এই জানাটাই সত্য সুন্দর চিরন্তন।

এই সত্যটি পাঁচ পয়সার আকুতি হলেও আমাদের শেষদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকবে।

[পরাগল রায়]

No comments: