Saturday, November 5, 2016

যাত্রাসঙ্গী

ডিসেম্বরের তীব্র শীত কুয়াশার চাদর ভেদ করে তূর্না নিশীথা ঢাকার পথে। যেতে যেতে মধ্যরাতে সহযাত্রীর কানে টেলিফোনের নারীকন্ঠ ভেসে আসে সুদূর নীহারিকা থেকে। কৌতুহলী কানে তবু অসাবধান শব্দেরা ছলকে পড়ে রেললাইনের পাথরকুচির মতো। সসংকোচ সহযাত্রীর অনিচ্ছুক অজুহাত, চশমার আড়ালে অবিশ্বাসের কুঁচকানো ভ্রু উপেক্ষিত হয়। অনন্ত শব্দের স্রোতস্বিনী পেরিয়ে ভেসে আসে -

সংকোচে জানাই আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার -
আজ দেখি অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে …

জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছো।
তোমাকে ফুলের দেশে নিয়ে যাবে ব'লে যে-প্রেমিক
ফেলে রেখে গেছে পথে, জানি, তার মিথ্যে বাগদান
হাড়ের মালার মতো এখনো জড়িয়ে রাখো চুলে।

আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?

শোনো, আমি রাত্রিচর। আমি এই সভ্যতার কাছে
এখনো গোপন ক'রে রেখেছি আমার দগ্ধ ডানা;
সমস্ত যৌবন ধ'রে ব্যধিঘোর কাটেনি আমার। আমি একা
দেখেছি ফুলের জন্ম মৃতের শয্যার পাশে বসে,
জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোস্নার ধারণা দেব ব'লে
এখনো রাত্রির এই মরুভুমি জাগিয়ে রেখেছি।

দ্যাখো, সেই মরুরাত্রি চোখ থেকে চোখে আজ পাঠালো সংকেত -
যদি বুঝে থাকো তবে একবার মুগ্ধ করো বধির কবিকে;
সে যদি সংকোচ করে, তবে লোকসমক্ষে দাঁড়িয়ে
তাকে অন্ধ করো, তার দগ্ধ চোখে ঢেলে দাও অসমাপ্ত চুম্বন তোমার…
পৃথিবী দেখুক, এই তীব্র সূর্যের সামনে তুমি
সভ্য পথচারীদের আগুনে স্তম্ভিত ক'রে রেখে
উন্মাদ কবির সঙ্গে স্নান করছো প্রকাশ্য ঝর্ণায় ।
[স্নান - জয় গোস্বামী]

কবিতা শেষ হলেও প্রিয়ংবদা সংলাপ অব্যাহত থাকে। উপেক্ষিত প্রতিবেশী দূরযাত্রীর অলস চোখে ঘুম নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হৃদয়ে প্রশমিত থাকা বেদনার ভার নিয়ে। রাত্রির আকাশ ঢেকে থাকে অন্তহীন কুয়াশায়। মাঘ নিশীথের স্বপ্নের ঘোরে তখন ভিন্ন একটি স্মৃতি ডাক দিয়ে বলতে থাকে-

অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে


করো আনন্দ আয়োজন ক'রে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে
যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো


করেছো, অতল; করেছিলে; প'ড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিল–ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;
–'প'ড়ে রইল যে!' প'ড়েই থাকত–সে-লেখা তুলবে বলে


কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।

[হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে - জয় গোস্বামী]

রাত ফুরোবার আগে ফুরিয়ে যায় ভ্রমণ। গন্তব্যে নেমে এক কাপ গরম কফি হাতের তালু পুড়িয়ে সুগন্ধী সুবাসে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি তাড়াতে থাকে, জনহীন প্ল্যাটফর্ম তখন নির্জন সৈকতের বালিতে ঝিনুকের আঁচড় কাটে। সহযাত্রীরা নিজের পথে চলে যাবার পর পথিক ভাবে, আমার কী এই অচেনা স্টেশানে নেমে পড়ার কথা? শংকা দূর করে একটি বাহন এসে পরিচিত মুখের হাতছানি দেয়। বাহনের উষ্ণ আসনে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আরেকবার জয় গোস্বামীকে স্মরণ করে যাত্রাসঙ্গী হবার আনন্দে। দুহাজার নয় পেরুলো মাত্র কদিন আগে। 

No comments: