১.
তিব্বত একটি দুর্গম এলাকা। এশিয়ার অন্যতম বিচ্ছিন্ন এলাকা। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রায় বিশ হাজার ফুট উঁচু দু্ই হাজার মাইল দীর্ঘ হিমালয় পর্বতমালা দ্বারা আলাদা করা। এতসব দুর্গম পর্বত, দুঃসহ আবহাওয়া, ক্ষেত খামারের জায়গা নেই, খনিজ সম্পদেরও কোন প্রাচুর্য নেই, তবু ঔপনিবেশিক কাল থেকে তিব্বতের প্রতি বড় বড় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহের কারণ কী? একের পর এক মিশন পাঠিয়ে তিব্বতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার এই চেষ্টা কেন? ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকা তিব্বতি লামাদের জোর করে দুনিয়ার ঝামেলার দিকে টানার কী দরকার ছিল?
তিব্বত নিয়ে পড়তে পড়তে ভাবনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।
তিব্বত তখনো একটি প্রচলিত রাষ্ট্র ছিল না। তিব্বতের শাসনকাজ চলে ধর্মগুরুর হাতে। তিব্বত হাজার বছর ধরে নিজের পথে চলছে। তিব্বত কখনো স্বাধীন ছিল না, আবার পরাধীনও নয়। তিব্বত বরাবরই চীনের হাতে। সেই তিনশো বছর আগের ইতিহাসেও তাই দেখি। কিন্তু আবার সেই চীন তিব্বতকে গিলেও স্বস্তিতে থাকেনি কখনো। তিব্বত তার পেটের মধ্যে আছে ঠিকই, কিন্তু সে কখনো সুখে ভাবতে পারছে না তিব্বত তার। দখল করলেই তাকে পাওয়া যায় না, তিব্বত তার অন্যতম একটা উদাহরণ।তিব্বত একটি দুর্গম এলাকা। এশিয়ার অন্যতম বিচ্ছিন্ন এলাকা। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রায় বিশ হাজার ফুট উঁচু দু্ই হাজার মাইল দীর্ঘ হিমালয় পর্বতমালা দ্বারা আলাদা করা। এতসব দুর্গম পর্বত, দুঃসহ আবহাওয়া, ক্ষেত খামারের জায়গা নেই, খনিজ সম্পদেরও কোন প্রাচুর্য নেই, তবু ঔপনিবেশিক কাল থেকে তিব্বতের প্রতি বড় বড় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহের কারণ কী? একের পর এক মিশন পাঠিয়ে তিব্বতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার এই চেষ্টা কেন? ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকা তিব্বতি লামাদের জোর করে দুনিয়ার ঝামেলার দিকে টানার কী দরকার ছিল?
তিব্বত নিয়ে পড়তে পড়তে ভাবনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।
২.
তিব্বতের প্রতি আমার কোন মোহ ছিল না। কিন্তু সমস্যা করেছে দুজন বাঙালী। বাঙালী কোথাও কিছু করেছে সেটা জানার পর আরেকজন বাঙালের কৌতুহল আকাশচুম্বী হয়। জাতপ্রেমের কারণে তিব্বত নিয়ে পড়ার আগ্রহ হলো। দুই বাঙালীর একজন শরতচন্দ্র দাশ, আরেকজন অতীশ দীপঙ্কর। শরতচন্দ্র দাশ নিয়ে লিখেছি কিছু, এবার অতীশ দীপঙ্করের কথা বলি।The Book of Kadam, the main text of the Kadampa school, to which the First Dalai Lama, Gendun Drup, first belonged
অতীশ দীপঙ্করের জন্ম ৯৮২ সালে বাংলাদেশে। ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাসস্থান এখনও 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে পরিচিত। এটা খুব আশ্চর্য যে তাঁর মতো এত বড় ধর্মগুরুকে নাস্তিক উপাধি পেতে হয়েছিল। কেন তা হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট জানাও সম্ভব নয় এত শত বছর পর।
১২ বছর বয়সে ৫ম শতকে বিহার অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন এবং তখন থেকে তাঁর নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
This distinctive portrait of Atiśa originated from a Kadam monastery in Tibet and was gifted to the Metropolitan Museum of Art, New York in 1933 by The Kronos Collections. In this graphic depiction, Atiśa holds a long, thin palm-leaf manuscript with his left hand, which probably symbolizes one of the many important texts he wrote, and he makes the gesture of teaching with his right hand |
তাঁর তিব্বত যাত্রা নিয়ে ছোট একটা অংশ পড়া যাক আনন্দবাজারের গৌতম চক্রবর্তীর বরাতে-
"১০৪০ খ্রিস্টাব্দের এক সকালে নাগসো, ভূমিসিংহ, ক্ষিতিগর্ভ প্রমুখ ১৯ জন শিষ্যকে নিয়ে বিক্রমশীল মহাবিহার রওনা থেকে রওনা হলেন মহাপণ্ডিত। সঙ্গে রয়েছেন আর এক শিষ্য বীর্যচন্দ্র। তিনি দীপঙ্করেরই ছোট ভাই। সংসারাশ্রমে তাঁর নাম ছিল শ্রীগর্ভ। আর দীপঙ্করের নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। মহাবিহার থেকে বেরিয়ে দীপঙ্কর ও তাঁর সঙ্গীরা গেলেন বুদ্ধগয়া। বোধিবৃক্ষের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে রওনা হলেন তাঁরা। সেখান থেকে আজকের চম্পারণ, রক্সৌল হয়ে নেপালের দিকে। নেপাল সীমান্তের কাছে ছোট্ট মিত্রবিহার। সেখানে কয়েক জন বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকেন। মিত্রবিহার থেকে ক্রমশ এগিয়ে চলা। মাঝপথে স্বয়ম্ভূনাথের রাজা তাঁর সেনাধ্যক্ষকে পাঠালেন এই দলটিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।
স্বয়ম্ভূনাথ থেকে পালপা। জ্বরে দীপঙ্করের সঙ্গী বীর্যসিংহর গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ রাজ্যে অদ্ভুত নিয়ম। পথে বীর্যসিংহের মৃত্যু হলে তাঁর সম্পত্তি যাবে সরাইখানার মালিকের হাতে। বীর্যসিংহ মারা গেলেন এক নদীর ধারে। রাতের অন্ধকারে তাঁকে দাহ করে, তাঁর ডুলিতে পোশাকআশাক সাজিয়ে চলল দলটি। দেখলে মনে হবে, বীর্যসিংহ বসে আছেন। পালপাতে সাদর আতিথ্য জানালেন রাজা অনন্তকীর্তি। নিজের 'দৃষ্ট ওষধি' নামের হাতিটি তাঁকে দান করলেন দীপঙ্কর। ওই হাতির পিঠে চেপেই বোধগয়ার বজ্রাসনীয় মহাবিহার থেকে তিনি এসেছেন এ রাজ্যে। অনন্তকীর্তিকে দিয়ে শুধু শপথ করিয়ে নিলেন, এ হাতিটিকে কখনও যুদ্ধের কাজে লাগানো যাবে না। অনন্তকীর্তি গুরুপদে বরণ করে নিলেন মহাপণ্ডিতকে। দীপঙ্করের নির্দেশেই 'থাম' অঞ্চলে তৈরি করালেন এক বৌদ্ধবিহার।
সেই 'থাম'ই আজকের থামেল। ডিস্কোথেক, ঝাঁ-চকচকে হোটেলে সজ্জিত কাঠমাণ্ডুর রঙিন এলাকা। পালপা জায়গাটা পোখরার অনতিদূরে তানসেন অঞ্চলে।
কিন্তু পালপায় এখনও শেষ হয়নি তাঁর কাজ। আর কয়েক দিন বাদে গৌড়বঙ্গের সিংহাসনে অভিষিক্ত হবেন তাঁর স্নেহধন্য ন্যায়পাল। এখান থেকেই পালবংশের নতুন রাজাকে চিঠি লিখলেন দীপঙ্কর, "রাজসিংহাসনে বসেও নম্র এবং বিনীত হবে।"
পালপা ছেড়ে এক দিন বেরিয়ে এলেন ভিক্ষু। এ বার আরও উত্তরে মুক্তিনাথের রাস্তা। সেই রাস্তা বেয়ে মানস সরোবর। সাত রাত সেখানে থাকলেন দীপঙ্কর। মানস সরোবরের পাশ দিয়ে নারি রাজ্যে যাওয়ার পথ। ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন বৃদ্ধ ভিক্ষু, কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে 'অতি ভাল। অতি মঙ্গল।' নারি আজ আর নেই। কিন্তু মানস সরোবরের পাশ দিয়ে যদি চিনের উইগুর অঞ্চলের কিছু আগে আসা যায়, 'গু জে' ধ্বংসাবশেষ। ওখানেই ছিল নারি রাজ্য। আজও সেখানে আছে থোলিং মহাবিহার। তিব্বতে প্রথম তিন বছর দীপঙ্কর সেখানেই ছিলেন।"
"১০৪০ খ্রিস্টাব্দের এক সকালে নাগসো, ভূমিসিংহ, ক্ষিতিগর্ভ প্রমুখ ১৯ জন শিষ্যকে নিয়ে বিক্রমশীল মহাবিহার রওনা থেকে রওনা হলেন মহাপণ্ডিত। সঙ্গে রয়েছেন আর এক শিষ্য বীর্যচন্দ্র। তিনি দীপঙ্করেরই ছোট ভাই। সংসারাশ্রমে তাঁর নাম ছিল শ্রীগর্ভ। আর দীপঙ্করের নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। মহাবিহার থেকে বেরিয়ে দীপঙ্কর ও তাঁর সঙ্গীরা গেলেন বুদ্ধগয়া। বোধিবৃক্ষের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে রওনা হলেন তাঁরা। সেখান থেকে আজকের চম্পারণ, রক্সৌল হয়ে নেপালের দিকে। নেপাল সীমান্তের কাছে ছোট্ট মিত্রবিহার। সেখানে কয়েক জন বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকেন। মিত্রবিহার থেকে ক্রমশ এগিয়ে চলা। মাঝপথে স্বয়ম্ভূনাথের রাজা তাঁর সেনাধ্যক্ষকে পাঠালেন এই দলটিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।
স্বয়ম্ভূনাথ থেকে পালপা। জ্বরে দীপঙ্করের সঙ্গী বীর্যসিংহর গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ রাজ্যে অদ্ভুত নিয়ম। পথে বীর্যসিংহের মৃত্যু হলে তাঁর সম্পত্তি যাবে সরাইখানার মালিকের হাতে। বীর্যসিংহ মারা গেলেন এক নদীর ধারে। রাতের অন্ধকারে তাঁকে দাহ করে, তাঁর ডুলিতে পোশাকআশাক সাজিয়ে চলল দলটি। দেখলে মনে হবে, বীর্যসিংহ বসে আছেন। পালপাতে সাদর আতিথ্য জানালেন রাজা অনন্তকীর্তি। নিজের 'দৃষ্ট ওষধি' নামের হাতিটি তাঁকে দান করলেন দীপঙ্কর। ওই হাতির পিঠে চেপেই বোধগয়ার বজ্রাসনীয় মহাবিহার থেকে তিনি এসেছেন এ রাজ্যে। অনন্তকীর্তিকে দিয়ে শুধু শপথ করিয়ে নিলেন, এ হাতিটিকে কখনও যুদ্ধের কাজে লাগানো যাবে না। অনন্তকীর্তি গুরুপদে বরণ করে নিলেন মহাপণ্ডিতকে। দীপঙ্করের নির্দেশেই 'থাম' অঞ্চলে তৈরি করালেন এক বৌদ্ধবিহার।
সেই 'থাম'ই আজকের থামেল। ডিস্কোথেক, ঝাঁ-চকচকে হোটেলে সজ্জিত কাঠমাণ্ডুর রঙিন এলাকা। পালপা জায়গাটা পোখরার অনতিদূরে তানসেন অঞ্চলে।
কিন্তু পালপায় এখনও শেষ হয়নি তাঁর কাজ। আর কয়েক দিন বাদে গৌড়বঙ্গের সিংহাসনে অভিষিক্ত হবেন তাঁর স্নেহধন্য ন্যায়পাল। এখান থেকেই পালবংশের নতুন রাজাকে চিঠি লিখলেন দীপঙ্কর, "রাজসিংহাসনে বসেও নম্র এবং বিনীত হবে।"
পালপা ছেড়ে এক দিন বেরিয়ে এলেন ভিক্ষু। এ বার আরও উত্তরে মুক্তিনাথের রাস্তা। সেই রাস্তা বেয়ে মানস সরোবর। সাত রাত সেখানে থাকলেন দীপঙ্কর। মানস সরোবরের পাশ দিয়ে নারি রাজ্যে যাওয়ার পথ। ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন বৃদ্ধ ভিক্ষু, কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে 'অতি ভাল। অতি মঙ্গল।' নারি আজ আর নেই। কিন্তু মানস সরোবরের পাশ দিয়ে যদি চিনের উইগুর অঞ্চলের কিছু আগে আসা যায়, 'গু জে' ধ্বংসাবশেষ। ওখানেই ছিল নারি রাজ্য। আজও সেখানে আছে থোলিং মহাবিহার। তিব্বতে প্রথম তিন বছর দীপঙ্কর সেখানেই ছিলেন।"
৩.
শরতচন্দ্র দাশের খনন এখনো শেষ হয়নি আমার। তিব্বত অভিযানের ঔপনিবেশিক কুটনীতির সাথে মহাদেশীয় ভূরাজনৈতিক তত্ত্ব বোঝার চেষ্টাও অব্যাহত। মাঝপথে একটু অতীশ দীপঙ্কর ভ্রমণ হয়ে গেল। পড়তে পড়তে লাইনচ্যুত হয়ে পড়া পুরোনো অভ্যেস। বদভ্যাস হলেও তাতে নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ আছে। সেই কারণে হাওয়া বদলকে নিরুৎসাহিত করা হয় না।
No comments:
Post a Comment