Friday, December 2, 2016

কন্ঠে যার বেজেছিল বাংলাদেশের সুর

জগত চেনে তাঁকে। আমি জানতাম শুধু নাম। ছবিও হয়তো দেখেছি দূর থেকে। তেমন কিছু পড়িনি। একটি মাত্র গান শুনেছি, তাঁর অনেক গানের মাত্র একটি। যে গান দিয়ে তিনি বিশ্বজয় করেননি, জয় করেছেন একটি জাতির হৃদয়। হৃদয় দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে বাংলাদেশের জনমানচিত্রে গ্রহন করেছেন স্থায়ী আসন। সে আসন কতোটা গভীর তা তিনি নিজেও হয়তো জানেন না।

যে গান দিয়ে তিনি বাংলাদেশের হৃদয় মানচিত্রে স্থান করেছেন তার বাইরে আর কোন গান শোনা হয়নি আমার। শোনা হয়নি ইংরেজি গানের প্রতি আমার আগ্রহের মাত্রা এবং যাতায়াত খুব কম বলেই। কাল রাতে অন্য একটি গান খুঁজতে গিয়ে তাঁর নামটা ইউটিউব স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। চেনা নামের প্রতি শ্রদ্ধার কারণেই গানটি শোনার জন্য ক্লিক করলাম। একটি গান শেষ হবার পর মেনু থেকে আরেকটি গান, তারপর আরেকটি......., এভাবে একের পর এক ক্লিক করতে করতে কতোগুলো গান শোনা হলো হিসেব রাখিনি। এক সময় আবিষ্কার করলাম যে আমি জোয়ান বায়েজ নামের অসাধারণ একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। হ্যাঁ সেই জোয়ান বায়েজ, যিনি আমাদের স্বাধীনতার জন্য 'বাংলাদেশ বাংলাদেশ' বলে আমেরিকার বাতাসে স্বাধীনতাকামী মানুষের বুক ভাসানো কান্না ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। তাঁর কন্ঠ, তাঁর ব্যক্তিত্ব, অভিব্যক্তি সবকিছু আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। মনে হলো আমার বহুকালের চেনামুখ এতদিন পরে খুঁজে পেলাম, যে ছিল আমার পাশের বাড়ির মেয়েটি।




বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জোয়ান বায়েজ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি যা করেছেন, তা নিয়ে আমাদের অনুভুতি কী, সে সম্পর্কে যা বলতে ইচ্ছে করছে, তা আমার ভাবনার চেয়েও গুছিয়ে লিখেছিলেন অভিজিত রায় ২০১১ সালে-

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আপামর জনগণ যখন দেশের জন্য যুদ্ধ করছে, লড়ছে না-পাক বাহিনীর হাত থেকে প্রিয় দেশ-মাতৃকাকে মুক্ত করতে,  সে সময় ত্রিশ বছর বয়সী এক নারী শিল্পী বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধের এক অভিনব মাধ্যম, নিজের মতো করে। গিটার হাতে বাংলাদেশের মানুষদের উপর গণহত্যার প্রতিবাদ জানালেন তিনি। রচনা করলেন এক অমর সঙ্গীতের – SONG OF BANGLADESH।  যে সঙ্গীতের চরণে চরণে মূর্ত হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের  অব্যক্ত বেদনা। ছাত্রদের উপর গণহত্যা, সেনাবাহিনীর তাণ্ডব, মানুষের হাহাকার, কুমারী মায়ের অসহায় দৃষ্টি, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, প্রতিরোধ সব কিছুই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে গানটিতে –জোয়ান বায়েজের কথা আর সুরের এক স্বপ্নিল যাদুস্পর্শে । পুরো গানটিতে ২২ বার তিনি ‘বাংলাদেশ’ –এর নাম উচ্চারণ করে যুদ্ধরত একটি জাতির স্বীকৃতি দিলেন বিশ্বের দরবারে, স্বীকৃতি দিলেন মুক্তিকামী একটি জাতির, অর্ধ গোলার্ধ দূরের অচেনা অজানা একটি ছোট্ট দেশের, নাম বাংলাদেশ।

বিদেশ বিভূঁইয়ের এক শিল্পীর বাংলাদেশের প্রতি দরদের ব্যাপারটা হয়তো আমাদের জন্য অদ্ভুত মনে হবে, কিন্তু জোয়ানের জন্য তা ছিলো না কখনোই। তিনি সব সময়ই ছিলেন সংগ্রামী। সংগ্রামের প্রেরণা পেয়েছিলেন সেই ছোটবেলাতেই, তার পরিবারের কাছ থেকে।  তার বাবা আলবার্ট বায়েজ ছিলেন খুব বিখ্যাত পদার্থবিদ, এমআইটির অধ্যাপক ছিলেন অনেকদিন। তাঁর আবিষ্কৃত এক্স রে ডিফ্রেকশন মাইক্রোস্কোপ এখনো মেডিকেলের জগতে ব্যবহৃত হয়।    অথচ যখন এই বিখ্যাত পদার্থবিদকে ম্যানহ্যাটন প্রোজেক্টে কাজ  কাজ করার জন্য তাকে অনুরোধ করা হয়েছিলো তিনি পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। এমন কি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দেওয়া প্রতিরক্ষা প্রকল্পের লোভনীয় চাকুরী কিংবা পুরস্কারকেও হেলায়  প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি তখন। বাবার এই আত্মত্যাগ, ঋজু মনোভাব খুব নাড়া দিয়েছিলো ছোট্ট জোয়ানের মনে। বড় হয়ে তিনিও তাই দাঁড়াতে পেরেছিলেন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। তিনি গান গাওয়ার পাশাপাশি ক্রমশ: বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে উঠেন। ষাটের দশকে মার্টিন লুথার কিং এর সাথে মিলে ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’এর সাথে জড়িত হন, জড়িত হন ‘ফ্রি-স্পিচ মুভমেন্টের’ সাথেও। সেখানেই তিনি পরিবেশন করেন তার বিখ্যাত গান ‘উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে’ বা ‘আমরা করব জয়, একদিন’ গানটি –

httpv://www.youtube.com/watch?v=RkNsEH1GD7Q

জোয়ান আজীবন যুদ্ধবিরোধী শান্তিকামী সৈনিক।  আজও তিনি ইরাকের উপর মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একই ভাবে সোচ্চার। ২০০৩ সালে ৬২ বছর বয়সে সানফ্রান্সিস্কোতে কনসার্ট করেছিলেন  ইরাক যুদ্ধের অবসান চেয়ে।  বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, শান্তি ও মানবাধিকারের স্বপক্ষে আজও তিনি এক জোরালো কণ্ঠস্বর। তিনি সমকামী, রূপান্তরকামী সংখ্যালঘু মানুষদের অধিকারের ব্যাপারেও গান গেয়েছেন অনেক, এমনকি তার ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি একটু পরিবর্তন করে সংখ্যালঘুদের অধিকারের  দাবীতে পোস্ট করেছেন ইউটিউবে ২০০৯ সালে।  তবে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ ছিলো সবচেয়ে প্রকট।  যুদ্ধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুই দুইবার গ্রেফতার হন ১৯৬৭ সালে।  তিনি এসময় মার্কিন সরকারকে ট্যাক্স দিতেও অস্বীকার করেন। তিনি রেভেনিউ সার্ভিসের কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে বলেন  –

    “I do not believe in war. I do not believe in the weapons of war … and I am not going to volunteer 60% of my year’s income tax that goes to armaments.”

তিনি বাংলাদেশের গণহত্যার খবরে বিচলিত হবেন না তো কে হবেন? জোয়ান হয়েছিলেন। সুদূর আমেরিকায় বসে ভেবেছিলেন আমাদের কথা, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির কথা। লিখেছিলেন একটি অসাধারণ গান, যেটি প্রস্তুত করা হয়েছিলো ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের অগাস্ট মাসে অনুষ্ঠিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর জন্য। যদিও ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এ জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া বাংলাদেশ গানটির কথা অনেকেই জানেন,  কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে জোয়ান বায়েজের গানটি সেভাবে পরিচিতি পায়নি। জর্জ হ্যারিসনের গানটির কথা  মাথায় রেখেও আমার কাছে জোয়ান বায়েজের এই বিষাদময় সুরেলো গানটিই বেশি প্রিয় ছিলো সবসময়ই। আজো – প্রতিবার যখনই গানটি শুনি  চোখ ভিজে উঠতে চায়, বুকের গহীন কোনে কোথায় যেন বেজে উঠে রিনি রিনি এক ব্যথার সুর। ঠিক যেমন প্রতিবছর একুশের সকালে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ গানটা শুনলেও যে অনুভূতি হয় মনে!


এবং সেই গানটি

জোয়ান বায়েজ Song of Bangladesh গানটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত Come from the Shadows অ্যালবামে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই গানটি তিনি নিজে লিখেছেন, সুর দিয়েছেন এবং নিজের কন্ঠে গেয়েছেন। তিনটি কাজ তিনি কতো আন্তরিকতার সাথে করেছিলেন সেটি বুঝতে হলে গানটি চোখ বন্ধ করে শুনতে শুনতে ১৯৭১ সালের আমেরিকার কোন একটা কনসার্টের হাজারো মানুষের ভিড় ঘিরে থাকা একটি মঞ্চে উঠে একটি সুদূর অচেনা আক্রান্ত জনপদের কথা ভাবতে হবে, অনাগত স্বাধীনতার গর্ভ যন্ত্রণার মর্মস্পর্শী ভাষাকে বুঝতে হবে। যে ভিনদেশী মেয়েটি আমার দেশের জন্য গানটি গেয়েছিল সে তো আমার চিরচেনা বোন কিংবা বন্ধু কিংবা প্রেয়সীর চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

    Bangladesh, Bangladesh
    Bangladesh, Bangladesh
    When the sun sinks in the west
    Die a million people of the Bangladesh

    The story of Bangladesh
    Is an ancient one again made fresh
    By blind men who carry out commands
    Which flow out of the laws upon which nation stands
    Which is to sacrifice a people for a land

    Bangladesh, Bangladesh
    Bangladesh, Bangladesh
    When the sun sinks in the west
    Die a million people of the Bangladesh

    Once again we stand aside
    And watch the families crucified
    See a teenage mother’s vacant eyes
    As she watches her feeble baby try
    To fight the monsoon rains and the cholera flies

    And the students at the university
    Asleep at night quite peacefully
    The soldiers came and shot them in their beds
    And terror took the dorm awakening shrieks of dread
    And silent frozen forms and pillows drenched in red

    Bangladesh, Bangladesh
    Bangladesh, Bangladesh
    When the sun sinks in the west
    Die a million people of the Bangladesh

    Did you read about the army officer’s plea
    For donor’s blood? It was given willingly
    By boys who took the needles in their veins
    And from their bodies every drop of blood was drained
    No time to comprehend and there was little pain

    And so the story of Bangladesh
    Is an ancient one again made fresh
    By all who carry out commands
    Which flow out of the laws upon which nations stand
    Which say to sacrifice a people for a land

    Bangladesh, Bangladesh
    Bangladesh, Bangladesh
    When the sun sinks in the west
    Die a million people of the Bangladesh

SONG OF BANGLADESH
Joan Baez.
© 1972 Chandos Music (ASCAP)


এই গানটি ১৯৭১ সালের ১ অাগষ্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশে' গাওয়া হয়েছে বলা হলেও জোয়ান বায়েজের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সুত্রে যাচাই করে জানা গেছে ভুলবশতঃ কনসার্ট অব বাংলাদেশে তাঁর নামটি রাখা হয়নি। ভুলটি ইচ্ছাকৃত ছিল কিনা সেটা জানার উপায় নেই। তবে ভারতীয় গবেষক শ্রীনাথ রাঘবনের* একটি প্রবন্ধের সুত্রে জানা গেছে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বায়েজ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ হাজার দর্শকের সামনে গান করেন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি বিশাল কনসার্টে তিনি ‘সং ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামে গান করেন।

[*"কনসার্ট ফর বাংলাদেশ, জোয়ান বায়েজের গান ও অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা"- শ্রীনাথ রাঘবন, প্রথম আলো ১৬ ডিসেম্বর ২০১৩]


গান শোনা হলো, তারপর...

গান শেষ হবার পর তাঁর জীবনী পড়লাম, জীবনী পড়া হলে তাঁকে নিয়ে তৈরী ডকুমেন্টারী, ছবি, সাক্ষাতকার হাতের কাছে যা পেলাম প্রায় সব পড়লাম। এক নাগাড়ে গত ২৪ ঘন্টার মধ্যে জাগ্রত সবটুকু সময় তাঁকে দিয়ে দিলাম। আমার দৈনিক সব কর্মসূচী বাদ দিয়ে আমি শুধু তাঁকে সঙ্গী করে কাটিয়ে দিলাম।

মাত্র একটা দিনে কতোটা গান শোনা যায়? বড়জোর বিশ বা পঁচিশটি। কিন্তু তাতেই জোয়ান বায়েজের কন্ঠ বুকের খুব গভীরে অনুভব করেছি। এ যেন ভিনদেশী কেউ নয়, যেন আমার দেশের ভাটিয়ালী গান গাইছে বিদেশী সুরে, এই কন্ঠ আমার অচেনা নয়, এই ইংরেজি যেন চেনা বাংলা ভাষা। কেউ এত সহজ কথায়, সহজ সুরে, সহজ বাদনে এমন করে গাইতে পারে, তাঁকে না শুনলে বুঝতাম না। বিপ্লবের ভাষা সঙ্গীতে এসে এত চমৎকার সুরে বাজে তখন তা দেশ কাল জাতি ধর্ম সবকিছুর উপরে চলে যায়। আমি স্পেনিশ ভাষার বিন্দু বিসর্গ বুঝি না, অথচ তাঁর গুয়ান্তানামেরা গানটি কী সুন্দর বুঝে গেলাম। প্রতিটি ভাষার, প্রতিটি সংগ্রামের নিজস্ব একটি কান্না আছে, সেই ক্রন্দনের সুরেই অনুদিত হয় অচেনা ভাষাও। গান শুনতে তাই ভাষা বোঝা সবসময় জরুরী না। ভাষা না বুঝেও উপভোগ করা যায় সঙ্গীত।

এই গানটি খুঁজতে গিয়েই তাঁকে খুঁজে পাওয়া - 500 miles
বব ডিলানের সাথে তাঁর সম্পর্কসুত্রে গাওয়া এই গানটি অসাধারণ- Diamond and Rust
এই গানটি শুনে হঠাৎ ধ্বক করে উঠেছিল বুকের ভেতর, এ যেন আমার চেনা কেউ।
মুগ্ধতার সাথে নস্টালিজক স্মৃতি এসে ভর করে এই গানটি শুনে।
যুদ্ধের বিপক্ষে এমন কোমল প্রতিবাদ সভ্যতার গালে সজোরে চড় কষায়
এই গান বুঝতে কী ভাষা খুব জরুরী?
আরো কতো গান শোনা বাকী তাঁর। শোনা গানগুলো আরো কতোবার শোনা হবে, আরো অনেক সময় কাটবে তাঁর সাথে। তাঁকে নিয়ে তৈরী করা এই ডকুমেন্টারি ভিডিওটি সংগ্রহে রেখে দেয়া যায়।


অসমাপ্ত উপসংহার

কিছু কথা এখনো বাকী।  কথাগুলো এখনো সাজানো হয়নি, সাজানো হয়ে গেলে যোগ করা হবে। শুধু একটি ছবি দেখি আজ। এই ছবিটি আজ সারাদিন খুব কথা বলেছে। যতক্ষণ ধরে গান শুনেছি এই ছবি, এই দৃষ্টি বারবার এসে চোখের সামনে দাঁড়িয়েছে। এ যেন বলতে চায় আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে। দেশ মানে কোন মানচিত্র নয়, দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। কেন এই দৃষ্টি, কেন এই চোখের সামনে এসে দাঁড়ানো, সেই কথা আরেকদিন।





[অসমাপ্ত.....]



No comments: