Thursday, December 8, 2016

রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসনের 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এবং একজন জোয়ান বায়েজ

[এই লেখাটি ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে মানবিক সহায়তার উদ্যোগ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত Concert for Bangladesh এর অংশগ্রহনকারী সব শিল্পীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং অংশগ্রহনকারী শিল্পীদের নির্ভূল তালিকা দেবার চেষ্টা।]

জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ কনসার্ট সম্পর্কে সচেতন বাংলাদেশীরা সবাই জানে। কিভাবে সে আয়োজন হয়েছিল, কিভাবে তা সারা পৃথিবী মাতিয়েছিল। সেই গল্পে যাবো না এখানে। আমি শুধু কৃতজ্ঞতা জানাতে সেই উদ্যোগের সাথে জড়িত নামগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখছি।

রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসনের Concert for Bangladesh
রবিশংকর এবং জর্জ হ্যারিসন, এই দুজনের কাছেই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ চিরঋণী থেকে যাবে সেদিনের সেই অসাধারণ উদ্যোগটির জন্য। সেদিন ওই মঞ্চে আরো যারা গেয়েছিলেন, তাদের কাছেও আমাদের ঋণ। এসব ঋণ অপরিশোধ্য, শুধু ইতিহাসের খাতায় তাদের নামগুলো জমা করে রাখা যায়।



Concert for Bangladesh-এ যে গানগুলো গাওয়া হয়েছিল তার তালিকা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় লেখা হলেও তাঁদের গাওয়া গান ও নাম একসাথে পাওয়া সহজ নয়। তাই কনসার্টের হোমপেজ, উইকিপেজ সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্যগুলো সংগ্রহ করে আর্কাইভ করা হলো।

ওইদিন দুটো কনসার্ট হয়েছিল। প্রথম কনসার্ট দুপুর ২.৩০মিনিট, দ্বিতীয় কনসার্ট সন্ধ্যা ৮.০০।

প্রথম কনসার্ট ২.৩০মিনিট

এই কনসার্টে দুটো পর্ব ছিল। প্রথম পর্বে ভারতীয় সঙ্গীত বাজিয়েছেন চারজন-
Ravi Shankar — Sitar
Ustad Ali Akbar Khan — Sarod
Ustad Alla Rakha — Tabla
Kamala Chakravarty — Tanpura 

দ্বিতীয় পর্বে পাশ্চাত্য সঙ্গীতে অংশ নিয়েছিলেন নীচের শিল্পীগন।
Wah-Wah - GEORGE HARRISON
Something - GEORGE HARRISON
That's The Way God Planned It - DON PRESTON
It Don't Come Easy - RINGO STARR
Beware Of Darkness - GEORGE HARRISON
While My Guitar Gently Weeps - GEORGE HARRISON & ERIC CLAPTON
Jumpin' Jack Flash - LEON RUSSELL
Young blood - LEON RUSSELL
Here Comes The Sun - GEORGE HARRISON
A Hard Rain's A-Gonna Fall - BOB DYLAN
Blowin' In The Wind - BOB DYLAN
It Takes A Lot To Laugh, It Takes a Train to Cry - BOB DYLAN
Just Like A Woman - BOB DYLAN
My Sweet Lord - GEORGE HARRISON
Bangla Desh - GEORGE HARRISON

দ্বিতীয় কনসার্ট
দ্বিতীয় কনসার্ট শুরু হয় রাত আটটায়। প্রথম কনসার্টের চেয়ে দ্বিতীয় শো আরো বেশী জমজমাট ছিল। আরো বেশী লোক সমাগম হয়েছিল। গানও ছিল বেশী। সান্ধ্যকালীন দ্বিতীয় শো-তেও উপরের গানগুলো গাওয়া হয়। তার সাথে আরো চারটি গান যুক্ত হয়েছিল।

Awaiting On You All - GEORGE HARRISON
Love Minus Zero/No Limit - BOB DYLAN
Hear Me Lord - GEORGE HARRISON
Mr. Tambourine Man - BOB DYLAN

আরো দুটি ব্যান্ড এবং একটি ব্যাকিং ভোকাল টীম মঞ্চে সাপোর্টিং টিম হিসেবে ছিল। তাদের তালিকা-
The Band• Jesse Ed Davis — rhythm guitar
• Tom Evans — acoustic guitar
• Pete Ham — acoustic guitar
• Mike Gibbins — percussion
• Jim Keltner — drums
• Joey Molland — acoustic guitar
• Don Preston — guitars, backing vocals
• Carl Radle — bass guitar
• Klaus Voormann — bass guitar

The Hollywood Horn • Jim Horn, Allan Beutler, Chuck Findley, Jackie Kelso, Lou McCreary, Ollie Mitchell

The Backing vocals • Don Nix, Jo Green, Jeanie Greene, Marlin Greene, Dolores Hall, Claudia .

সেদিন ওই আসরে মোট ১৯টি গান গাওয়া হয়েছিল যার মধ্যে জর্জ হ্যারিসন একাই ৯টি গান গেয়েছিলেন এবং বব ডিলান গেয়েছিলেন ৬টি।


কনসার্টের পোস্টার




এই লিংকে গিয়ে কনসার্টে অংশগ্রহনকারী সব আর্টিস্টের নাম ও ছবি দেখা যাবে

'বাংলাদেশ কনসার্ট' এর দীর্ঘ মেয়াদী সাফল্যের তালিকা অনেক দীর্ঘ। সবটা লিখতে গেলে একটি বই হয়ে যাবে। এই উইকি লিংকে মোটামুটি ভালো একটা সারাংশ আছে তার। এখন শুধু কনসার্টের একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার কথা জানাই। দুটি শো-ই এতটা সফল হয়েছিল যে শো শেষে বব আনন্দের আতিশয্যে জর্জকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- "তিন তিনটে শো হলো না কেন"! অথচ সেই সময়ে বব ডিলান সঙ্গীত থেকে দূরে সরে ছিলেন, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় হতাশাপূর্ণ জীবন কাটাচ্ছিলেন, এমনকি  ড্রাগেও আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে শোনা যায়।

'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এর লাইভ প্রোগ্রামের গানগুলো দিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানানো হয়েছিল। যার বিক্রি ছিল আকাশচুম্বী। ওই টাকা থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়া আফ্রিকার আরো দেশ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য পেয়েছিল। তবে ওই ফিল্ম বা প্রোগ্রামের ভিডিও বাংলাদেশে খুব বেশী মানুষ দেখেছে বলে মনে হয় না। আগ্রহীদের জন্য লিংকটি দেয়া হলো।

একটি ভুল ছবি

'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' অ্যালবামের ছবিটি নিয়ে কিছু প্রশ্ন জাগে। ছবিটা একটি ভুল বার্তা বহন করেছে। এই ছবিটি যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ সম্পর্কে ধারণা দেয় না। এই কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দিকে বিশ্বজনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং সেই জনগোষ্ঠির জন্য সাহায্য। অথচ এই ছবিটি দেখে শুধু দুর্ভিক্ষ পীড়িত একটি জাতির চেহারাই ভেসে ওঠে।



জর্জ হ্যারিসনের Bangla Desh বনাম জোয়ান বায়েজের Song of Bangladesh

একটি তথ্য প্রায়ই গুলিয়ে যেতে দেখেছি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং ওয়েবসাইটে। জর্জ হ্যারিসন যেমন বাংলাদেশকে নিয়ে Bangla Desh গানটি লিখেছেন তেমনি জোয়ান বায়েজও বাংলাদেশকে নিয়ে লিখেছিলেন Song of Bangladesh. অধিকাংশ জায়গায় দেখি জোয়ানের গানটি কনসার্ট অব বাংলাদেশের অংশ বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ম্যাডিসন স্কয়ারের ১  আগষ্ট ১৯৭১সালে 'কনসার্ট' অব বাংলাদেশে' জোয়ান বায়েজ ছিলেন না। তাঁকে রাখা হয়নি অজ্ঞাত কোন কারণে (এই লেখককে ব্যক্তিগত যোগাযোগের সুত্রে জোয়ান বলেছেন 'ভুলবশতঃ' তাঁকে রাখা হয়নি সেদিন)।


ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্টে না গাইলেও জোয়ান বায়েজ নিজস্ব মানবিক বোধ জাগিয়ে যে গানটি লিখে, সুর দিয়ে, গেয়ে শুনিয়েছিলেন, তা এক কৃতিত্ব হিসেবে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। তাঁর এই কাজ দিয়ে আমাদের ঋণের বোঝাকে আরো ভারী করেছেন। বস্তুতঃপক্ষে জোয়ান বায়েজের গানটি জর্জের গানটির চেয়ে অনেক বেশী প্রাণস্পর্শী সব দিক দিয়েই। একাত্তর নিয়ে যতগুলো গান কবিতা লেখা হয়েছে, আমার বিচারে ওই গানটি অন্যতম সেরা। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে জোয়ানের গানটি সেভাবে পরিচিতি বা স্বীকৃতি পায়নি।

তাঁর গান সম্পর্কে অভিজিত রায়ের এই লেখাটি সবচেয়ে সুন্দর। ইউটিউবে খুব সহজে গানটি মেলে। Story of Bangladesh নামে লেখা গানটি পরে তাঁর Come from the shadows অ্যালবামে Song of Bangladesh নামে রাখা হয়েছে।

এই গানটি সম্পর্কে ইউটিউবে এক ভিনদেশীর মন্তব্যটা বেশ ভালো লেগেছিল বলে টুকে রেখেছিলাম। তিনি এত আপ্লুত হয়েছেন যে বলেছেন, "I have no relation to bangladesh in any kind but i love this song of her..It is sung with pure emotion and gives me goosebump everytime."

কথাটা একবিন্দুও মিথ্যা নয়। এই গানটি যতবার শোনা হয়, চোখ ভিজে যায়। প্রিয় জোয়ান, বাংলাদেশ চিরকাল ঋনী থাকবে তোমার কাছে।


বর্তমান Concert of Bangladesh : একটি সাহায্য সংস্থা

Concert of Bangladesh নামটি এখনো সক্রিয়ভাবে টিকে আছে পরিবর্তিত নাম George Harrison Fund for UNICEF নিয়ে। কিন্তু তাদের ওয়েব সাইটের ঠিকানা এখনো বাংলাদেশের নাম নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। http://theconcertforbangladesh.com বাংলাদেশের পাশাপাশি তাঁদের সাহায্য তালিকায় আরো দরিদ্র দেশের নামও যুক্ত হয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছে রোমানিয়া, এঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, ব্রাজিল, ভারত ইত্যাদি। জর্জের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন এর সাথে জড়িত আছেন। তিনি ইউনিসেফের হয়ে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১১ সালে।

১৯৭১ সালের ১ আগষ্ট ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্টের পর যে ফাণ্ড যোগাড় হয়েছিল অ্যালবাম বিক্রি করে, তা প্রত্যাশার চাইতে বহুগুন বেশী ছিল। সেই টাকা শুধু বাংলাদেশ না, পৃথিবীর আরো অনেক দেশের দুস্থ মানুষকে বন্টন করা হয়েছে, হচ্ছে। বিলি বন্টনের কাজ করতে গিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানই দাঁড়িয়ে যায়। বর্তমানে ওই ফাণ্ড পরিচালনা করে হ্যারিসন পরিবার এবং ইউনিসেফ।
কিন্তু একটা ব্যাপার দুর্ভাগ্যজনক। কনসার্টটি যে মানুষগুলোকে সাহায্য করার জন্য করা হয়েছিল সেটা এত সাফল্য লাভের পরও টাকাগুলো সেই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছেনি। ফাণ্ডের টাকাটা বাংলাদেশে এসেছিল অনেক ঘাটের জল খেয়ে আরো তেরো বছর পর।

কত টাকা আয় হয়েছিল একদিনের একটি কনসার্টে? জর্জ হ্যারিসনকে কনসার্ট করার প্রস্তাব দেবার সময় রবিশংকরের ধারণা ছিল বিশ-ত্রিশ হাজার ডলার ফাণ্ড যোগাড় হবে। কিন্তু কনসার্টের সময় দেখা গেল প্রায় ৪০ হাজার টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে এবং কনসার্টের পরের সপ্তাহে আয়োজকরা নগদ বিক্রির মোট ২৪৩,৪১৮ ডলার হস্তান্তর করেছিল ইউনিসেফকে। ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের মধ্যে Capitol Records নামের একটি রেকর্ড কোম্পানী কনসার্টের লাইভ অ্যালবাম বিক্রির অগ্রিম টাকা জমা দেয় ৩,৭৫০,০০০ ডলার।

কিন্তু টাকাটা বাংলাদেশকে দেয়া যায়নি কনসার্টটি ইউনিসেফের অনুমোদনপ্রাপ্ত ছিল না বলে। প্রায় এক যুগ মার্কিন সরকারের রাজস্ব বিভাগ টাকাটা আটকে রাখে। যদিও আটকে রাখা, কর মওকুফ না করা ইত্যাদি বিষয় আইনের ব্যাপার, কিন্তু  তবে ওই সময়কালে অ্যালবামের বিক্রিত অর্থের পরিমান আরো কয়েকগুন বৃদ্ধি পায়। সেই ফাণ্ড থেকে ১৯৮৫ সালে ইউনিসেফ ১২ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের বন্যা দুর্গতদের জন্য দান করে।

নব্বই দশকে জর্জ হ্যারিসন বলেছিলেন ওই ফাণ্ডে ইতিমধ্যে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে এবং জাতিসংঘ তার দায়িত্ব নিয়েছে। বাংলাদেশ কনসার্টের নামে গড়ে তোলা সেই ফান্ডের নতুন নাম দেয়া হয় George Harrison Fund for UNICEF.


শেষ কথা:
এই লেখায় মাত্র কয়েকজন ভিনদেশী হিতাকংখীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার চেষ্টা ছিল। বিশেষ করে তিনজনের প্রতি। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে আরো অনেক বিদেশী বন্ধু আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের সবার নাম পরিচয় আমরা পাইনি। যারা দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের তথ্য অনুসন্ধান করে আসছেন তাঁরা নিশ্চয়ই একদিন খুঁজে পাবেন সেই নামগুলো। তবু অজানা সেই সব বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যাই।



----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
তথ্যসুত্র:
১. http://theconcertforbangladesh.com
২. George Harrison – In His Own Words, superseventies.com
৩.  Neal Alpert, "George Harrison's Concert for Bangladesh
৪. "Sweet Sounds", Time, 17 April 1972
৫.  Living in the Material World, Klaus Voormann 
৬. Wikipedia: The Concert for Bangladesh 


No comments: