ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিকে ভারতবর্ষে সবাই চেনে। ভারতবর্ষের বাইরেও অচেনা নন তিনি। উপমহাদেশে মুসলমান রাজত্বের সূচনা তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল। কারো কাছে তিনি মহানায়ক, কারো চোখে তিনি মহাভিলেন। বখতিয়ার খিলজির বীরত্বের কিংবদন্তি সবাই জানলেও তাঁর শেষ অভিযান সম্পর্কে খুব বেশী মানুষ জানে
না। শেষ অভিযানটি তাঁর খ্যাতির মুকুটে একটি পরাজয়ের পালক হিসেবে থেকে
গিয়েছিল।
সুদূর পশ্চিম এশিয়া থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকে একের পর এক রাজ্য জয় করা শেষে বখতিয়ার খিলজি বঙ্গবিজয় করেছিলেন ১২০৪ খৃষ্টাব্দে। বঙ্গবিজয়ের পর তিনি খুব বেশীদিন ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করতে পারেননি। কেননা বঙ্গবিজয়ের দুবছরের মধ্যে অনিবার্য দুর্ভাগ্য তাঁর নজরকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল হিমালয়ের উত্তরের দুর্গম প্রায় অগম্য রাজ্য তিব্বতের দিকে। শোনা যেত নিজস্ব নিঃসঙ্গতায় মগ্ন পৃথিবী বিচ্ছিন্ন দেশ তিব্বতে আছে সোনা, রূপা, মূল্যবান রত্নরাজি। উপরি হিসেবে আরো আছে বিশ্বখ্যাত বাণিজ্য পথ সিল্ক রুট যেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে চীনের সাথে বিশ্ববানিজ্যের দরোজায় খাম্বা গেড়ে বসে যাওয়া যাবে।
খোঁজ খবর নিতে গিয়ে মিলে গেল আলী মেক (Ali Mech) নামের এক হিমালয়বাসী উপজাতীয় বাসিন্দার, যে পথ দেখিয়ে বখতিয়ার বাহিনীকে বাংলা থেকে তিব্বতে নিয়ে যাবে। যুগে যুগে এই উপমহাদেশের মানুষ বিদেশী শক্তির এমন সহায়ক গাইড হিসেবে কাজ করে আসছে। আলেকজাণ্ডার বা খিলজি বা ভাস্কো-দা-গামা কেউ তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হননি।
অতঃপর ১২০৬ খৃষ্টাব্দের এক শুভদিনে দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে বখতিয়ার খিলজি উত্তরবঙ্গের দেবকোট (Debkot- দিনাজপুর সংলগ্ন প্রাচীন গৌড়ের অংশ ছিল) নগরী থেকে যাত্রা শুরু করেন। যাত্রার পূর্বে তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী আলী মর্দান খিলজিকে দেশ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘোড়া ছোটালেন। ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ ধরে এগিয়ে তাঁর বাহিনী কামরূপ রাজ্যে প্রবেশ করে। তারপর কামরূপের রাজার সাহায্যে তিস্তা নদীর প্রাচীন সেতু পেরিয়ে, সিকিম ভূটানের মাঝামাঝির পার্বত্য এলাকা দিয়ে তিব্বতের চাম্বি উপত্যকায় (Chumbi Valley) প্রবেশ করলেন।
খিলজি বাহিনী চাম্বি উপত্যকায় পৌঁছে বিজিত নগরীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার কর্মসূচীতে নেমে পড়লো। কিন্তু গ্রামগঞ্জ লণ্ডভণ্ড করতে করতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তিব্বতীরা একসময় জেগে উঠলো। গড়ে তুললো অভিনব এক গেরিলা বাহিনী। সেই মধ্যযুগে এমন গেরিলা বাহিনীর উল্লেখ আর কোথাও পা্ওয়া যায় না। সেই বাহিনী পাহাড় পর্বতের নানান অংশ থেকে আক্রমন শুরু করলো দেশ প্রতিরক্ষার প্রবল প্রত্যয়ে।
কিছুদিন পরই তিব্বতী গেরিলা বাহিনীর চোরাগোপ্তা হামলায়
খিলজি বাহিনীর নাভিশ্বাস উঠলো। উপায় না দেখে বখতিয়ার খিলজি তাঁর বাহিনীকে পিছু
হঠার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে ফেরার পথও বন্ধ প্রায়। কামরূপের রাজা হয়তো আসার পথে ক্রোধ চেপে সাহায্য করেছিল, কিন্তু এখন খিলজি বাহিনীর বিপদ দেখে সুযোগ বুঝে বিগড়ে গেল এবং তিস্তা সেতু অবরোধ করে রাখল। বিপর্যস্ত খিলজি প্রায় সব সৈন্যকে
পেছনে রেখে বিকল্প কোন পথে মাত্র শ খানেক সৈন্য নিয়ে বাংলায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বাকীদের পরিণতি জানা যায়নি।
১২০৬ সালটি বখতিয়ার খিলজির জন্য
অভিশপ্ত একটি বছর। সে বছরই তিব্বতের ব্যর্থ অভিযান শেষ করে ফিরে আসার পর
বখতিয়ার খিলজি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইতিহাস বলে মধ্যযুগে রাজাধিরাজদের অসুস্থ হওয়া একটা বিপদ। খুব কাছের লোকেরা তখন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অসুস্থ অবস্থায় বখতিয়ার খিলজিকে হত্যা করে দেশ রক্ষার
মহান দায়িত্ব পালন করেছিল তাঁরই সহযোগী আলী মর্দান খিলজি।বখতিয়ার খিলজিকে হত্যার পর বাংলার মসনদ নিয়ে খিলজি বংশের কামড়াকামড়ি চলেছিল অনেকদিন। সে ইতিহাসে না গিয়েও বলা যায় বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতা হাজার বছরের ঐতিহ্য। বখতিয়ার খিলজি সেই ঐতিহ্যের একটি উদাহরণ মাত্র। সেরকম উদাহরণ খিলজি পরবর্তীকালে বহুবার ঘটে চলেছে। এমনকি এই বিশ একুশ শতকেও তা বহমান।
তথ্যসুত্র:
১. Buddhism and Islam on the Silk Road -Elverskog, Johan (2011-06-06).
২. The River of Golden Sand: The Narrative of a Journey Through China and Eastern Tibet to Burmah- William John Gill; Henry Yule (9 September 2010).
৩. A Comprehensive History of Medieval India: Twelfth to the Mid-Eighteenth Century- Farooqui Salma Ahmed (2011).
৪. বাংলাপিডিয়া
No comments:
Post a Comment