Tuesday, December 13, 2016

তিন কাকের স্বর্গারোহন




শহরের সমস্ত সবুজ লোপাট হয়ে যাবার পর বৃক্ষহীন উদ্বাস্তু  হাজারো কাকের ভিড়ে তিন তরুণ কাকের খুব বন্ধুত্ব হলো। তিন কাকের নাম- এক, দুই, তিন। আধুনিক কাক জানে, বৃক্ষের বদলে ইলেকট্রিকের তারেও জমতে পারে তারুণ্য সভা কংক্রিটের পিলারে তৈরী অ্যাপার্টমেন্ট বাসা। 

ত্রিরত্নের আকাশবিহার সকাল বিকাল দুপুর ভেসে ভেসে ভেসে বেড়ানো। উড়ে উড়ে চিল তাড়ানো। ঘুরে ঘুরে পাহারা যেন শহরে যেন আর কোন পাখি প্রবেশ করে খাবারে ভাগ না বসায়। কখনো তাই কোন কোকিল এসে ডিম পাড়েনি তাদের বাসায়। সন্ধ্যে হলেই আবার যে যার স্বাধীন বাসায়। নিরিবিলি কা কা স্বাধীন জীবনে খুঁটে খুঁজে কেটে যাচ্ছিল দিন।

একদিন নগরপিতার ঘোষণা। এবার সবুজে সাজবে নগরীঘাসপাতার চাষ হবে ছাদের কার্নিশে। আকাশ ভেঙ্গে বর্ষা নামলেও সেই সবুজ ধুয়ে যাবে না ঘোলা নর্দমায়। এবার নগরী হবে সত্যিকারের প্রাচ্য রানী। স্বর্গের পথ খুলে দেয়া হবে এই শহরে। বিশ্ব তাকিয়ে রবে প্রবল বিস্ময়ে।

মানুষ কাকের ভাষা বোঝে না, কিন্তু কাক মানুষের ভাষা শিখে ফেলেছে। রিকশাওয়ালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সব ভাষাতেই কাকেদের কর্ণকূহর অভ্যস্ত। লিখতে পারে না, বলতে পারে না, কিন্তু বুঝতে কোন সমস্যা হয় না। কাকেরা দেখেছে এই নগরপিতা সবুজে সাজানোর ঘোষণা দিয়ে শহরের সকল বৃক্ষ  নিধন করে সেখানে কংক্রিটের চাষ করেছে। যেখানে ছিল সবুজ বনানী সেখানে উঠেছে দালানের পর দালান। যেখানে ছিল পাহাড়ি বুনোঝোপের সজীব ছায়ার মাঝে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া ঝরনা সেখানে এখন ধাতব নলের কৃত্রিম ফোয়ারা। শহরজুড়ে কেবল ইট সিমেন্ট কংক্রিটের মেলা। তার ফাঁকে ফাঁকে সিরামিকের টবে বৈচিত্র্যহীন বিদেশী পাতাবাহারের সস্তা প্রদর্শনী। যেখানে পাখি নেই, প্রজাপতি নেই, অন্ধকারে দীপ জ্বালানো জোনাকী নেই। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক নগরী থেকে প্রকৃতিকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠিয়ে যখন সবুজে সাজার ঘোষণা এলো তখন মানুষেরা না বুঝলেও কাকেরা বুঝে নিল এই প্রহসন।  

তাই প্রাচ্যের রানী হোক বা না হোক স্বর্গের ঘোষণা শুনে তিন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিল ওরাও স্বর্গে যাবার সুযোগ নেবে। শুনেছে স্বর্গে একবার ঢুকলে আর ফিরতে হয় না, অনন্ত সুখ সেখানে। কিন্তু কবে খুলবে স্বর্গের পথ? অপেক্ষায় দিন গুনতে শুরু করলো তিন বন্ধু কাক।

কয়েকদিন পর। 

এক দুপুরে খুব বৃষ্টি হলো। ছুটির শহর চুপচাপ ভিজলো। তিন বন্ধুতে এক কার্ণিশে বসে খুব গল্প করলো। স্বপ্নের ক্যানভাসে ইচ্ছেমতো রঙ চড়াতে চড়াতে বেলা নেমে যাচ্ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি থেমে শেষ বিকেলের সূর্য উঁকি দিল। অমনি পুব আকাশ রাঙিয়ে দিগন্ত জুড়ে মেঘের ফাঁক থেকে অদ্ভুত একটা রঙিন আলোর রেখা ভেসে উঠলো।

এক- 'ওই তো স্বর্গের দরোজা  দেখা দিয়েছে'

দুই- 'আমি জানতাম স্বর্গের দরোজা খুলবেই'

তিন- 'উড়ে চলো স্বর্গের পথে'

অতঃপর দেরী না করে তিনজনই উড়াল দিল। উড়তে উড়তে তিনজনই উড়াল দিল। উড়তে উড়তে...... উড়তে তো উড়ছেই। কিন্তু সাত রঙে সাজানো স্বর্গের দরোজা যেন আরো দূরে সরে যায়। কিছুতে ছুঁতে পারে না তাকে। কোথায় স্বর্গ, কোথায় তার সাজানো দুয়ার? সবই মায়ার খেলা।

তিন নম্বর কাক সবার আগে ক্লান্ত হয়ে নেমে আসলো ইলেকট্রিকের আড্ডা খুঁটির তারে। বসে বসে দেখছে বাকী দুই বন্ধু তখনো উড়ে উড়ে স্বর্গের দরোজা ছুঁতে চেষ্টা করছে। ওরাও ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে একসময়। তারপর আবারো এই মিথ্যে প্রতিশ্রুতির পুরোনো শহরের কংক্রিটের মধ্যে প্রতিদিনের ক্লান্ত জীবন। এই শহর আর কখনো ফিরবে না সবুজে। 

তবু কাকেরা শান্ত্বনা পেল পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া একটি বাণীর কথা ভেবে- 

যে শহর যত বেশী আবর্জনাময় 
সে শহর কাকেদের স্বর্গ নিশ্চয়।

No comments: