প্রশ্নটিও সহজ, আর উত্তরও তো জানা........তবু আবার একটু চোখ বুলাই।
যদি বলি আপনার সহস্র নাম্বার পূর্বপুরুষটি সত্তর হাজার বছর আগে আফ্রিকার কোন জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতের ঢালুতে বসে একটা আধপাকা কলা ভক্ষণ শেষে কলা ছিলকার উপর হাতের আঙুলগুলো রেখে অবাক হয়ে দেখছে –আরে এই ছিলকায়ও দেখি আমার হাতের আঙুলের সমান টুকরা! হাউ ফানি! অংক আবিষ্কারের এই ভুজুংভাজুং কেচ্ছা কি বিশ্বাস করবেন? না করলেও সমস্যা নাই। কিন্তু কল্পনাটি অসম্ভব কিছু না। প্রাগৈতিহাসিক কালের কোন আদম হয়তো ওই ভাবেই প্রথম গুনতে শিখেছিল যার অসংখ্য বিবর্তনের ফসল হিসেবে ৭০ হাজার বছর পরে আপনি কম্পিউটারে খুটখাট করার দুর্লভ সুযোগ সুলভে ভোগ করছেন।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আপনি গরু ছাগল কুকুর বেড়াল বা শিম্পাঞ্জির চেয়ে খান্দানী কোন প্রাণী ছিলেন না। প্রাগৈতিহাসিক যুগে দুনিয়ার বুকে আপনার ভূমিকাটা একটা জেলিফিশ, কাঠঠোকরা এমনকি একটা মৌমাছির চেয়েও নগণ্য ছিল।
অথচ আজকে আপনি প্রযুক্তির পাখায় ভর করে গোটা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, আকাশে উড়ছেন, পাতালে নামছেন, আধমরাকে বাঁচিয়ে তুলছেন ইনজেকশানের খোঁচায়, আবার জীবিতকে কবরজাত করছেন ক্লাস্টার/নাপাম বোমা দিয়ে, হাতের তালুর সাইজের মোবাইল টিপে জগতের সব খোঁজ খবর নিতে পারছেন, বুর্জ-আল-আরবে বসে দুনিয়াতেই বেহেশতী সুখ উপভোগ করছেন। আপনার এই সাফল্যের গোপন চাবিকাঠি কোথায়? কোন যাদুতে আফ্রিকার অখ্যাত জঙ্গলের এক কোণায় কলা ছিলে খাওয়া এক নগণ্য আদিম জানোয়ার থেকে মাত্র পঞ্চাশ হাজার বছরে পরিবর্তিত হয়ে গেলেন পৃথিবীর শাসক প্রাণীতে।
প্রচলিত বিশ্বাসে আপনি হয়তো ভাবেন আপনারা অর্থাৎ মানুষের দল আশরাফুল মখলুকাত। অন্য সকল প্রাণীদের চেয়ে আপনাদের আলাদা করে বানানো হয়েছে। আপনি বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন আপনার শরীরে কিংবা মগজে এমন কোন বিশেষ কোন মাল মশল্লা আছে যা আপনাকে একটা বাঘ, সিংহ, হাতি কিংবা গণ্ডারের চেয়ে বেশী যোগ্যতা দিয়েছে। কিন্তু বিব্রতকর ব্যাপার হলো মগজের হিসেবে আপনি বড়জোর একটা শিম্পাঞ্জির সমতূল্য। তাতেও আবার কিন্তু আছে। শিম্পাঞ্জি খালু আর আপনাকে যদি একটা নির্জন দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়, তাহলে আমি বাজি ধরতে পারি আপনি খালুর কাছে হেরে যাবেন।এমন হতে পারে আপনি ভাতের ক্ষুধায় কাতর হয়ে হাবিজাবি খেয়ে পেট খারাপ করে পটল তুলবেন, ওদিকে শিম্পাঞ্জি খালু লতাপাতা খেয়ে দিব্যি মোটাতাজা হয়ে বলবে, শালার মনুষ্যি একটা অপদার্থ জানোয়ার! অথবা শিম্পাঞ্জি খালু আপনাকে খাবারের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে টুটি চেপে পরপারে চালান করে দেবে।
শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে টানাটানি করছি বলে চিন্তায় পড়ে গেলেন? চিন্তার কিছু নাই। খুলে বলছি।
আসলে অন্য প্রাণীদের সাথে মানুষের আসল পার্থক্য হলো দলগত অবস্থানে। মানুষের এত ক্ষমতার সুত্র হলো একজন মানুষ অনেক মানুষের সাথে দলগতভাবে সহাবস্থান করতে পারে বিভিন্ন বিচিত্র পরিস্থিতিতে। পিঁপড়া বা মৌমাছিও দলগত অবস্থানে বেশ মজবুত, কিন্তু তাদের মধ্যে নিয়ম শৃংখলার নমনীয়তা নেই। হাজার হাজার বছর ধরে যে ফরমেটে ওরা কাজ করে তার বাইরে যেতে পারে না। একটা মৌচাক যদি আক্রান্ত হয় তখন সেই সমস্যা মোকাবেলার জন্য রাতারাতি নতুন কোন নিয়ম চালু করতে পারে না ওরা। তারা রাণীকে বিতাড়িত করে নতুন রাষ্ট্র গড়ার কথা ভাবতেও পারে না।
নেকড়ে আর শিম্পাঞ্জিরা যদিও পিপড়াদের তুলনায় অধিক নমনীয় কিন্তু সেটা শুধুমাত্র অল্প কটা নেকড়ে বা শিম্পাঞ্জি হলেই সম্ভব। কোন একটা শিকার ধরার জন্য আক্রমনের দলগত পরিকল্পনা করা সম্ভব তাদের পক্ষে। তবে এটাকে ঠিক সামাজিক সহযোগিতা হিসেবে দেখানো যায় না।
ধরা যাক আপনি একজন শিম্পাঞ্জি এবং আমিও একজন। এখন আপনি যদি কোন কাজে আমাকে লাগাতে চান, সেটার জন্য আগে আমাকে চিনতে হবে, আমার স্বভাব চরিত্র বুঝতে হবে, আমার মধ্যে কোন শয়তানি আছে কিনা সেটা বোঝার শক্তি থাকতে হবে। আপনি যদি আমাকে ভালোভাবে না চেনেন তাইলে কোন কাজে আমাকে নিতে ভরসা পাবেন না। হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা অসংখ্য অচেনা মানুষের সাথেও জোটবদ্ধভাবে পারস্পরিক বোঝাপরার মাধ্যমে যে কোন মিশন সম্পন্ন করতে পারে।
একটা শিম্পাঞ্জির সাথে একটা মানুষের হাতাহাতি লাগলে শিম্পাঞ্জিটা জিতবে, এমনকি দশটা শিম্পাঞ্জীও দশটা মানুষকে হারাতে পারবে। কিন্তু ১০০০ শিম্পাঞ্জিকে ১০০০ মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিলে মানুষই জিতবে কেননা ১০০০ মানুষের মধ্যে ঐকতান সৃষ্টির যে ক্ষমতা মানুষের আছে যেটা শিম্পাঞ্জির নেই। মীরপুর স্টেডিয়ামে এক লাখ শিম্পাঞ্জিকে এনে বসিয়ে দিলে কী ভয়ানক ক্যাচালের সৃষ্টি হবে চিন্তা করতে পারেন? অথচ লাখ লাখ মানুষ স্টেডিয়ামে বসে হরদম আনন্দের সাথে খেলা দেখে শৃংখলা মেনে। এখানেই মানুষের জিত।
তবে মানুষের এই জোটবদ্ধ অবস্থান সবসময় সুখের হয় না এটাও ঠিক। এই মানুষই দলবদ্ধভাবে ভয়ানক সব কর্মকাণ্ড করেছে সমগ্র ইতিহাস জুড়ে। জেলখানা, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, গণহত্যা এসবই যুথবদ্ধ কর্মকাণ্ড।
অন্যদিকে অপরাধ বা অপকর্মের দিক থেকে দেখলে আবার শিম্পাঞ্জিদের জেলখানাও নেই, কনসেনট্রেশান ক্যাম্পও নেই, রাজাকার আলবদরও নেই। সেদিক দিয়ে ওরা মানুষের চেয়ে সেরা।
কিন্তু মানুষের এই দলবদ্ধভাবে সুপরিকল্পিত উপায়ে কাজ করার রহস্যটা কী? হোক সেটা খেলাধুলা কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য অথবা খুন খারাবি।
উত্তর হলো – মানুষের অপরিসীম কল্পনাশক্তি।
হ্যাঁ, একমাত্র মানুষের কল্পনার জোরেই অনেক অচেনা মানুষের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারে, মানুষ বানিয়ে গল্প কাহিনী লিখতে পারে, সেটা দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিতে পারে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাতে বিশ্বাস করাতে পারে, এই সবকিছুর মূলে মানুষের কল্পনাশক্তি। এটার জোরেই আমরা সবাই একটা ধারণায় সম্মিলিতভাবে বিশ্বাস করতে পারি, একই আইনে নিজেদের শৃংখলিত রাখতে পারি, পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারি।
সমগ্র প্রাণীজগতের কিছু ব্যাপার একমাত্র মানুষকে দিয়েই সম্ভব। যেমন আপনি কোন একটা শিম্পাঞ্জিকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে সে যদি আপনাকে একটা কলা খেতে দেয় দেয়, পরকালে এই পূন্যের জোরে সে লক্ষ লক্ষ কলার মালিক হবে। কিন্তু একজন মানুষকে আপনি এটা বিশ্বাস করাতে পারবেন। এই ক্ষমতার জোরেই আমরা সারা পৃথিবী শাসন করি, আর শিম্পাঞ্জিরা বনজঙ্গল, চিড়িয়াখানা কিংবা গবেষণাগারের জেলখানায় আটক থাকে।
পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মের পেছনে কিছু না কিছু গল্প কাহিনীর প্রভাব আছে। সেসব গল্পের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মানুষ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকে কিংবা ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ করে। কেননা তারা ঈশ্বর ও স্বর্গের কাহিনীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে।
শুধু ধর্ম না, আইনকানুন বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য। সভ্য যুগে সকল আইন কানুনের অন্যতম ভিত্তি হলো ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার। কিন্তু বাস্তবে মানবাধিকার ব্যাপারটিও একটি রূপকথা যার বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। বস্তুতপক্ষে মানবের কোন অধিকার নাই, যেমন নেই শিম্পাঞ্জি বা নেকড়ের। পুরো মানবাধিকার ব্যাপারটি একটি গালগল্প যা আমি নিজেরা বানিয়ে অন্যদেরকে বিশ্বাস করতে বলি। এটা খুব আকর্ষণীয় গল্প কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এ শুধুই গল্প, বাস্তব কিছু না।
রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। যেমন একটা পর্বত হলো সত্যিকারের অস্তিত্ব। আপনি তাকে ছুঁতে পারেন, বেয়ে উঠতে পারেন, পর্বতের মাটি পাথরের ঘ্রাণ নিতে পারেন। কিন্তু আমেরিকা বা ইসরায়েল বা জাপান কোন বাস্তব ব্যাপার না। আপনি আমেরিকা- ইসরায়েল - জাপান নামের কোন অস্তিত্বকে ছুঁয়ে দেখতে পারবেন না। রাষ্ট্র নামক বিষয়টি পুরোপুরি একটা কল্পনা। এটি মানুষের তৈরী এবং মানুষ তাতে প্রবলভাবে বিশ্বাস করে যেমন বিশ্বাস করে ঈশ্বর বা স্বর্গের উপস্থিতি।
কল্পনার এই ঘটনা টাকাপয়সার ক্ষেত্রেও। ধরুন আপনার কাছে ১০০ টাকার একটা নোট আছে। এটা আপনি চিবিয়ে খেয়ে কোন মজা পাবেন না, পানিতে চুবিয়ে সরবত বানানো যাবে না, অলংকার বানিয়ে পরলেও সুবিধার হবে না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছে এটার মূল্য দুই কেজি চিনির সমান। আপনি অচেনা কোন এক দোকানে গিয়ে নোটটি দিয়ে দোকানীকে বললেন দুই কেজি চিনি দিতে। সেই দোকানী লোকটা আপনাকে জিন্দেগীতে কখনো না চিনলেও বিনাবাক্য ব্যয়ে দুই কেজি চিনি দিয়ে দেবে ১০০ টাকা নামক কাগজের টুকরোর বিনিময়ে।
কেন দিয়েছে? দিয়েছে কেননা সেও আপনার মতো গভর্নরের গল্পটা বিশ্বাস করেছে যে এই টুকরো কাগজটির মূল্য দুই কেজি চিনির সমান। কিন্তু একটা শিম্পাঞ্জিকে কাগজের টুকরোটা দিলে কেমন হবে নিশ্চয়ই বোঝার বাকী নেই।
সম্ভবতঃ টাকা হচ্ছে মানব আবিষ্কৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ফিকশন। পৃথিবীর সব মানুষ সমভাবে ঈশ্বর, মানবাধিকার কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের উপর আস্থাশীল নয়, কিন্তু ডলারের উপর আস্থা আছে সবার, এমনকি ওসামা বিন লাদেনেরও। লাদেন আমেরিকার ধর্ম রাজনীতি সংস্কৃতি সবকিছুকে ঘৃণা করলেও আমেরিকান ডলারের উপর তার প্রেমে কোন খাদ ছিল না।ওই ফিকশনে তার কোন আপত্তি ছিল না।
সুতরাং যেখানে অন্য সকল প্রাণী নদী বৃক্ষ কিংবা বনের পশু যে কোন একটির উপর নির্ভর করে জীবনধারণ করে কিন্তু আমরা মানুষেরা সেখানে দ্বৈত জীবনে অভ্যস্ত। আমাদের জীবনধারণের প্রাথমিক উদ্দেশ্যের সাথে আমরা আরেকটি বিশ্বাসের স্তর নিয়ে বাস করি যা পুরোপুরি কাল্পনিক অস্তিত্ব নিয়ে আছে যেমন জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ঈশ্বর, ডলার, মানবাধিকার ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে এসব কাল্পনিক অস্তিত্বগুলো অনেক বেশী শক্তিশালী হয়েছে এবং আজকের পৃথিবীতে সেইসব কাল্পনিক বস্তুর প্রভাবই সবচেয়ে বেশী। বলা চলে তারাই আজ পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি। তাদের উপর নির্ভর করছে সমস্ত পৃথিবীর সব মানুষের জীবনধারণ চলন বলন নদী সমুদ্র বন কিংবা পশুপাখির অস্তিত্ব।
এবং এই দ্বিতীয় কাল্পনিক জগতের জন্যই মানুষ আজ পৃথিবী শাসন করছে, অন্য প্রাণীরা তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে বনে জঙ্গলে বাস করছে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
[Professor Yuval Noah Harari লিখিত WHY HUMANS RUN THE WORLD অনুসরণে লিখিত]
যদি বলি আপনার সহস্র নাম্বার পূর্বপুরুষটি সত্তর হাজার বছর আগে আফ্রিকার কোন জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতের ঢালুতে বসে একটা আধপাকা কলা ভক্ষণ শেষে কলা ছিলকার উপর হাতের আঙুলগুলো রেখে অবাক হয়ে দেখছে –আরে এই ছিলকায়ও দেখি আমার হাতের আঙুলের সমান টুকরা! হাউ ফানি! অংক আবিষ্কারের এই ভুজুংভাজুং কেচ্ছা কি বিশ্বাস করবেন? না করলেও সমস্যা নাই। কিন্তু কল্পনাটি অসম্ভব কিছু না। প্রাগৈতিহাসিক কালের কোন আদম হয়তো ওই ভাবেই প্রথম গুনতে শিখেছিল যার অসংখ্য বিবর্তনের ফসল হিসেবে ৭০ হাজার বছর পরে আপনি কম্পিউটারে খুটখাট করার দুর্লভ সুযোগ সুলভে ভোগ করছেন।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আপনি গরু ছাগল কুকুর বেড়াল বা শিম্পাঞ্জির চেয়ে খান্দানী কোন প্রাণী ছিলেন না। প্রাগৈতিহাসিক যুগে দুনিয়ার বুকে আপনার ভূমিকাটা একটা জেলিফিশ, কাঠঠোকরা এমনকি একটা মৌমাছির চেয়েও নগণ্য ছিল।
অথচ আজকে আপনি প্রযুক্তির পাখায় ভর করে গোটা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, আকাশে উড়ছেন, পাতালে নামছেন, আধমরাকে বাঁচিয়ে তুলছেন ইনজেকশানের খোঁচায়, আবার জীবিতকে কবরজাত করছেন ক্লাস্টার/নাপাম বোমা দিয়ে, হাতের তালুর সাইজের মোবাইল টিপে জগতের সব খোঁজ খবর নিতে পারছেন, বুর্জ-আল-আরবে বসে দুনিয়াতেই বেহেশতী সুখ উপভোগ করছেন। আপনার এই সাফল্যের গোপন চাবিকাঠি কোথায়? কোন যাদুতে আফ্রিকার অখ্যাত জঙ্গলের এক কোণায় কলা ছিলে খাওয়া এক নগণ্য আদিম জানোয়ার থেকে মাত্র পঞ্চাশ হাজার বছরে পরিবর্তিত হয়ে গেলেন পৃথিবীর শাসক প্রাণীতে।
প্রচলিত বিশ্বাসে আপনি হয়তো ভাবেন আপনারা অর্থাৎ মানুষের দল আশরাফুল মখলুকাত। অন্য সকল প্রাণীদের চেয়ে আপনাদের আলাদা করে বানানো হয়েছে। আপনি বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন আপনার শরীরে কিংবা মগজে এমন কোন বিশেষ কোন মাল মশল্লা আছে যা আপনাকে একটা বাঘ, সিংহ, হাতি কিংবা গণ্ডারের চেয়ে বেশী যোগ্যতা দিয়েছে। কিন্তু বিব্রতকর ব্যাপার হলো মগজের হিসেবে আপনি বড়জোর একটা শিম্পাঞ্জির সমতূল্য। তাতেও আবার কিন্তু আছে। শিম্পাঞ্জি খালু আর আপনাকে যদি একটা নির্জন দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়, তাহলে আমি বাজি ধরতে পারি আপনি খালুর কাছে হেরে যাবেন।এমন হতে পারে আপনি ভাতের ক্ষুধায় কাতর হয়ে হাবিজাবি খেয়ে পেট খারাপ করে পটল তুলবেন, ওদিকে শিম্পাঞ্জি খালু লতাপাতা খেয়ে দিব্যি মোটাতাজা হয়ে বলবে, শালার মনুষ্যি একটা অপদার্থ জানোয়ার! অথবা শিম্পাঞ্জি খালু আপনাকে খাবারের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে টুটি চেপে পরপারে চালান করে দেবে।
শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে টানাটানি করছি বলে চিন্তায় পড়ে গেলেন? চিন্তার কিছু নাই। খুলে বলছি।
আসলে অন্য প্রাণীদের সাথে মানুষের আসল পার্থক্য হলো দলগত অবস্থানে। মানুষের এত ক্ষমতার সুত্র হলো একজন মানুষ অনেক মানুষের সাথে দলগতভাবে সহাবস্থান করতে পারে বিভিন্ন বিচিত্র পরিস্থিতিতে। পিঁপড়া বা মৌমাছিও দলগত অবস্থানে বেশ মজবুত, কিন্তু তাদের মধ্যে নিয়ম শৃংখলার নমনীয়তা নেই। হাজার হাজার বছর ধরে যে ফরমেটে ওরা কাজ করে তার বাইরে যেতে পারে না। একটা মৌচাক যদি আক্রান্ত হয় তখন সেই সমস্যা মোকাবেলার জন্য রাতারাতি নতুন কোন নিয়ম চালু করতে পারে না ওরা। তারা রাণীকে বিতাড়িত করে নতুন রাষ্ট্র গড়ার কথা ভাবতেও পারে না।
নেকড়ে আর শিম্পাঞ্জিরা যদিও পিপড়াদের তুলনায় অধিক নমনীয় কিন্তু সেটা শুধুমাত্র অল্প কটা নেকড়ে বা শিম্পাঞ্জি হলেই সম্ভব। কোন একটা শিকার ধরার জন্য আক্রমনের দলগত পরিকল্পনা করা সম্ভব তাদের পক্ষে। তবে এটাকে ঠিক সামাজিক সহযোগিতা হিসেবে দেখানো যায় না।
ধরা যাক আপনি একজন শিম্পাঞ্জি এবং আমিও একজন। এখন আপনি যদি কোন কাজে আমাকে লাগাতে চান, সেটার জন্য আগে আমাকে চিনতে হবে, আমার স্বভাব চরিত্র বুঝতে হবে, আমার মধ্যে কোন শয়তানি আছে কিনা সেটা বোঝার শক্তি থাকতে হবে। আপনি যদি আমাকে ভালোভাবে না চেনেন তাইলে কোন কাজে আমাকে নিতে ভরসা পাবেন না। হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা অসংখ্য অচেনা মানুষের সাথেও জোটবদ্ধভাবে পারস্পরিক বোঝাপরার মাধ্যমে যে কোন মিশন সম্পন্ন করতে পারে।
একটা শিম্পাঞ্জির সাথে একটা মানুষের হাতাহাতি লাগলে শিম্পাঞ্জিটা জিতবে, এমনকি দশটা শিম্পাঞ্জীও দশটা মানুষকে হারাতে পারবে। কিন্তু ১০০০ শিম্পাঞ্জিকে ১০০০ মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিলে মানুষই জিতবে কেননা ১০০০ মানুষের মধ্যে ঐকতান সৃষ্টির যে ক্ষমতা মানুষের আছে যেটা শিম্পাঞ্জির নেই। মীরপুর স্টেডিয়ামে এক লাখ শিম্পাঞ্জিকে এনে বসিয়ে দিলে কী ভয়ানক ক্যাচালের সৃষ্টি হবে চিন্তা করতে পারেন? অথচ লাখ লাখ মানুষ স্টেডিয়ামে বসে হরদম আনন্দের সাথে খেলা দেখে শৃংখলা মেনে। এখানেই মানুষের জিত।
তবে মানুষের এই জোটবদ্ধ অবস্থান সবসময় সুখের হয় না এটাও ঠিক। এই মানুষই দলবদ্ধভাবে ভয়ানক সব কর্মকাণ্ড করেছে সমগ্র ইতিহাস জুড়ে। জেলখানা, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, গণহত্যা এসবই যুথবদ্ধ কর্মকাণ্ড।
অন্যদিকে অপরাধ বা অপকর্মের দিক থেকে দেখলে আবার শিম্পাঞ্জিদের জেলখানাও নেই, কনসেনট্রেশান ক্যাম্পও নেই, রাজাকার আলবদরও নেই। সেদিক দিয়ে ওরা মানুষের চেয়ে সেরা।
কিন্তু মানুষের এই দলবদ্ধভাবে সুপরিকল্পিত উপায়ে কাজ করার রহস্যটা কী? হোক সেটা খেলাধুলা কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য অথবা খুন খারাবি।
উত্তর হলো – মানুষের অপরিসীম কল্পনাশক্তি।
হ্যাঁ, একমাত্র মানুষের কল্পনার জোরেই অনেক অচেনা মানুষের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারে, মানুষ বানিয়ে গল্প কাহিনী লিখতে পারে, সেটা দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিতে পারে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাতে বিশ্বাস করাতে পারে, এই সবকিছুর মূলে মানুষের কল্পনাশক্তি। এটার জোরেই আমরা সবাই একটা ধারণায় সম্মিলিতভাবে বিশ্বাস করতে পারি, একই আইনে নিজেদের শৃংখলিত রাখতে পারি, পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারি।
সমগ্র প্রাণীজগতের কিছু ব্যাপার একমাত্র মানুষকে দিয়েই সম্ভব। যেমন আপনি কোন একটা শিম্পাঞ্জিকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে সে যদি আপনাকে একটা কলা খেতে দেয় দেয়, পরকালে এই পূন্যের জোরে সে লক্ষ লক্ষ কলার মালিক হবে। কিন্তু একজন মানুষকে আপনি এটা বিশ্বাস করাতে পারবেন। এই ক্ষমতার জোরেই আমরা সারা পৃথিবী শাসন করি, আর শিম্পাঞ্জিরা বনজঙ্গল, চিড়িয়াখানা কিংবা গবেষণাগারের জেলখানায় আটক থাকে।
পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মের পেছনে কিছু না কিছু গল্প কাহিনীর প্রভাব আছে। সেসব গল্পের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মানুষ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকে কিংবা ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ করে। কেননা তারা ঈশ্বর ও স্বর্গের কাহিনীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে।
শুধু ধর্ম না, আইনকানুন বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য। সভ্য যুগে সকল আইন কানুনের অন্যতম ভিত্তি হলো ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার। কিন্তু বাস্তবে মানবাধিকার ব্যাপারটিও একটি রূপকথা যার বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। বস্তুতপক্ষে মানবের কোন অধিকার নাই, যেমন নেই শিম্পাঞ্জি বা নেকড়ের। পুরো মানবাধিকার ব্যাপারটি একটি গালগল্প যা আমি নিজেরা বানিয়ে অন্যদেরকে বিশ্বাস করতে বলি। এটা খুব আকর্ষণীয় গল্প কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এ শুধুই গল্প, বাস্তব কিছু না।
রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। যেমন একটা পর্বত হলো সত্যিকারের অস্তিত্ব। আপনি তাকে ছুঁতে পারেন, বেয়ে উঠতে পারেন, পর্বতের মাটি পাথরের ঘ্রাণ নিতে পারেন। কিন্তু আমেরিকা বা ইসরায়েল বা জাপান কোন বাস্তব ব্যাপার না। আপনি আমেরিকা- ইসরায়েল - জাপান নামের কোন অস্তিত্বকে ছুঁয়ে দেখতে পারবেন না। রাষ্ট্র নামক বিষয়টি পুরোপুরি একটা কল্পনা। এটি মানুষের তৈরী এবং মানুষ তাতে প্রবলভাবে বিশ্বাস করে যেমন বিশ্বাস করে ঈশ্বর বা স্বর্গের উপস্থিতি।
কল্পনার এই ঘটনা টাকাপয়সার ক্ষেত্রেও। ধরুন আপনার কাছে ১০০ টাকার একটা নোট আছে। এটা আপনি চিবিয়ে খেয়ে কোন মজা পাবেন না, পানিতে চুবিয়ে সরবত বানানো যাবে না, অলংকার বানিয়ে পরলেও সুবিধার হবে না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছে এটার মূল্য দুই কেজি চিনির সমান। আপনি অচেনা কোন এক দোকানে গিয়ে নোটটি দিয়ে দোকানীকে বললেন দুই কেজি চিনি দিতে। সেই দোকানী লোকটা আপনাকে জিন্দেগীতে কখনো না চিনলেও বিনাবাক্য ব্যয়ে দুই কেজি চিনি দিয়ে দেবে ১০০ টাকা নামক কাগজের টুকরোর বিনিময়ে।
কেন দিয়েছে? দিয়েছে কেননা সেও আপনার মতো গভর্নরের গল্পটা বিশ্বাস করেছে যে এই টুকরো কাগজটির মূল্য দুই কেজি চিনির সমান। কিন্তু একটা শিম্পাঞ্জিকে কাগজের টুকরোটা দিলে কেমন হবে নিশ্চয়ই বোঝার বাকী নেই।
সম্ভবতঃ টাকা হচ্ছে মানব আবিষ্কৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ফিকশন। পৃথিবীর সব মানুষ সমভাবে ঈশ্বর, মানবাধিকার কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের উপর আস্থাশীল নয়, কিন্তু ডলারের উপর আস্থা আছে সবার, এমনকি ওসামা বিন লাদেনেরও। লাদেন আমেরিকার ধর্ম রাজনীতি সংস্কৃতি সবকিছুকে ঘৃণা করলেও আমেরিকান ডলারের উপর তার প্রেমে কোন খাদ ছিল না।ওই ফিকশনে তার কোন আপত্তি ছিল না।
সুতরাং যেখানে অন্য সকল প্রাণী নদী বৃক্ষ কিংবা বনের পশু যে কোন একটির উপর নির্ভর করে জীবনধারণ করে কিন্তু আমরা মানুষেরা সেখানে দ্বৈত জীবনে অভ্যস্ত। আমাদের জীবনধারণের প্রাথমিক উদ্দেশ্যের সাথে আমরা আরেকটি বিশ্বাসের স্তর নিয়ে বাস করি যা পুরোপুরি কাল্পনিক অস্তিত্ব নিয়ে আছে যেমন জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ঈশ্বর, ডলার, মানবাধিকার ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে এসব কাল্পনিক অস্তিত্বগুলো অনেক বেশী শক্তিশালী হয়েছে এবং আজকের পৃথিবীতে সেইসব কাল্পনিক বস্তুর প্রভাবই সবচেয়ে বেশী। বলা চলে তারাই আজ পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি। তাদের উপর নির্ভর করছে সমস্ত পৃথিবীর সব মানুষের জীবনধারণ চলন বলন নদী সমুদ্র বন কিংবা পশুপাখির অস্তিত্ব।
এবং এই দ্বিতীয় কাল্পনিক জগতের জন্যই মানুষ আজ পৃথিবী শাসন করছে, অন্য প্রাণীরা তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে বনে জঙ্গলে বাস করছে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
[Professor Yuval Noah Harari লিখিত WHY HUMANS RUN THE WORLD অনুসরণে লিখিত]
No comments:
Post a Comment