রূপকথার রাজকন্যা -তুমি কোথায় থাকো, কোন সে সুদূর অন্তহীনের ওইপারে?
তোমাদের চির সবুজের রাজ্যটিতে কখনো শীতকাল আসেনা সুপর্না?
তোমাদের সবুজ দেশে কি শুধুই গান, শুধুই আনন্দ? কানাকানি, হানাহানি, রাজনীতি, কুটনীতি নেই, বিষাদ মলিনতার দুষণ নেই? কী নাম তোমার দেশের?
আমি তোমাকে চিনি না। কিন্তু মনে পড়ে যায় সুদূর দিনের একটি বিকেলের কথা।
সেই বিকেলে ‘যদি কাগজে লিখো নাম…’ গানটা বাজছিল ক্যাসেট প্লেয়ারে। মান্না দের সুরেলা কন্ঠস্বর আমাদের মুগ্ধ করছিল। আমরা সবাই তখন পারমিতাদের বাসায় জড়ো হয়েছি। পারমিতার ক্যাসেট প্লেয়ারে ওই গানটা বাজছিল। সেদিন সজল বিদেশে চলে যাচ্ছিল। বিদায় অনুষ্ঠানে বিষন্ন সঙ্গীত। কিন্তু আমরা সবাই আনন্দে ভাসছিলাম। বাসায় আত্মীয় স্বজন সবাই আছে। কিন্তু গানটা তিনজন মানুষকে লক্ষ্য করে বাজছিল। সজল, পারমিতা, আমি। সজল গানটার শুনে আমাকে ইঙ্গিত করছিল পারমিতার দিকে। আমি হাসছিলাম। কয়েকদিন আগে সে আমাকে জানিয়েছে পারমিতার প্রতি তার মুগ্ধতার কথা। সে ফিরে এসে পারমিতাকে বিয়ে করবে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিল। বলছিল পারমিতারও সম্মতি আছে তাতে। আমি পারমিতাকে লক্ষ্য করছিলাম। কোনোরকম পরিবর্তন দেখা যায় কিনা চেহারায়। কিন্তু পারমিতা যথারীতি আমার পাশে পাশে ঘুরছে। আমি এক ফাঁকে পারমিতাকে লক্ষ্য করে গানটার অর্থবোধক একটা ইঙ্গিত করলাম যেখানে সজলের সাথে ওর সম্পর্কের কথাটা বোঝা যায়। শুনে পারমিতা আমার দিকে কটমট করে তাকালো। সেই দৃষ্টি আমাকে বলে দিল সজলের প্রতি ওর মোটেও আগ্রহ নেই। ওর সকল মনোযোগ আমার দিকে। সজল যদি ওটা জানতে পারে তাহলে কষ্ট পাবে। তাই আমি সজলের পক্ষে সায় দিয়ে গেলাম। অভয় দিলাম, সে নিশ্চয়ই ফিরে এসে ওকে বিয়ে করবে। তাদের প্রেমের সাফল্য কামনা করলাম। পারমিতা আমাকে বারবার ইঙ্গিত করছিল ওর কাছে যাওয়ার জন্য। আমি সেটা এড়িয়ে থাকলাম। এই সময়ে সজলকে আমি কষ্ট দিতে পারি না। সজল জানে পারমিতা ওকেই ভালোবাসে। সজল গানটা আবারো বাজাতে দিল। পারমিতা সেটা নিয়ে খানিক বিরক্ত চেহারা দেখেই অনুমান করলাম। কিন্তু কিছু বললাম না। আমার তখন এমন অবস্থা আমি পারমিতার প্রেমে হাবুডুবু খেতে পারি না। আমাদের পারিবারিক সম্পর্কটা তেল আর জলের মতো। মুখে কিছু না বললেও পারমিতা সেই দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য আকুল। গত কয়েক বছর ধরে সেটা টের পাচ্ছিলাম। গ্রামে গেলেই বেশি বোঝা যেতো। বাধানিষেধ থাকতো না কাছাকাছি থাকতে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ২য় বর্ষে। পারমিতা এসএসসি দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে বোধহয়। ওর ১৮ আমার ২১। সে বছরই আমার সবচেয়ে কাছাকাছি এসে গিয়েছিল সে। আমরা মুখফুটে কিছু বলিনি কিন্তু দুজনই জানি সত্যিটা। সত্যিটা প্রকাশ হবার জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায়। মান্না দের গানটা সবার অলক্ষ্যে আমাদের দুজনকে আলোড়িত করছিল সেই বিকেলে। বিকেলটা আমি কখনো ভুলবো না।
কিন্তু পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে কত কিছু ঘটে গেল। আমরা কে কোথায় ছিটকে চলে গেলাম। পারমিতার বিয়ে হয়ে গেল। সজল বিদেশ থেকে বিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে এলো। আমি চলে গেলাম বিপরীত পথে। আমাদের কারো জীবন কারো জীবনের সাথে যুক্ত থাকলো না। জীবনটা এরকমই। কিছু কিছু মুহূর্তে স্বপ্ন হয়েই স্মৃতির সাথে লেপ্টে থাকে। মান্না দে আমাদের তিনজনের জীবনে পাথরের স্মৃতি হয়ে থাকলো। সাথে সেই বিকেল।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব –
প্রতি সন্ধ্যায় কে যেন
ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে –
আমি চুপ করে বসে থাকি –
অন্ধকারে নীল ফানুস উড়িয়ে দেয় কারা,
সারারাত বাজি পোড়ায়
হৈ-হল্লা – তারপর হঠাত্
সব মোমবাতি ভোজবাজির
মতো নিবে যায় একসঙ্গে –
উত্সবের দিন হাওয়ার
মতো অন্যদিকে ছুটে যায়,
বাঁশির শব্দ আর কানে আসে না –
তখন জল দেখলেই লাফ
দিতে ইচ্ছে করে আমার
মনে হয় – জলের ভেতর – শরীর ডুবিয়ে
মুখ উঁচু করে নিশ্বাস নিই সারাক্ষণ–
ভালো লাগে না সুপর্ণা,
আমি মানুষের মতো না, আলো না, স্বপ্ন না –
পায়ের পাতা আমার
চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশ –
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি,
ঘড়ির কাঁটা আঙ্গুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন –
আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব!
একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঘ
ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম জানলার
কাছে –
চারিদিকে অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যচ্ছিল
না সেদিন –
সেইদিন তোমার কথা মনে পড়তেই
আমি কেঁদে ফেলেছিলাম –
চুলে দেশলাই জ্বালিয়ে চুল পোড়ার
গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
আবার -এখন আমি মানুষের মতো না –
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাত্ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার
– ভালোবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নিচু
করে বসে থাকতে ভালো লাগে না –
আমি মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই
তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি এখন – যে-দিক
দিয়ে আসি, সে-দিকেই দৌড় দিই
কেন এই দৌড়ে যাওয়া?
আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব ।।
____________________________________________________________________
কবিতা: ভাস্কর চক্রবর্তী - শীতকাল কবে আসবে সুপর্না
তোমাদের চির সবুজের রাজ্যটিতে কখনো শীতকাল আসেনা সুপর্না?
তোমাদের সবুজ দেশে কি শুধুই গান, শুধুই আনন্দ? কানাকানি, হানাহানি, রাজনীতি, কুটনীতি নেই, বিষাদ মলিনতার দুষণ নেই? কী নাম তোমার দেশের?
আমি তোমাকে চিনি না। কিন্তু মনে পড়ে যায় সুদূর দিনের একটি বিকেলের কথা।
সেই বিকেলে ‘যদি কাগজে লিখো নাম…’ গানটা বাজছিল ক্যাসেট প্লেয়ারে। মান্না দের সুরেলা কন্ঠস্বর আমাদের মুগ্ধ করছিল। আমরা সবাই তখন পারমিতাদের বাসায় জড়ো হয়েছি। পারমিতার ক্যাসেট প্লেয়ারে ওই গানটা বাজছিল। সেদিন সজল বিদেশে চলে যাচ্ছিল। বিদায় অনুষ্ঠানে বিষন্ন সঙ্গীত। কিন্তু আমরা সবাই আনন্দে ভাসছিলাম। বাসায় আত্মীয় স্বজন সবাই আছে। কিন্তু গানটা তিনজন মানুষকে লক্ষ্য করে বাজছিল। সজল, পারমিতা, আমি। সজল গানটার শুনে আমাকে ইঙ্গিত করছিল পারমিতার দিকে। আমি হাসছিলাম। কয়েকদিন আগে সে আমাকে জানিয়েছে পারমিতার প্রতি তার মুগ্ধতার কথা। সে ফিরে এসে পারমিতাকে বিয়ে করবে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিল। বলছিল পারমিতারও সম্মতি আছে তাতে। আমি পারমিতাকে লক্ষ্য করছিলাম। কোনোরকম পরিবর্তন দেখা যায় কিনা চেহারায়। কিন্তু পারমিতা যথারীতি আমার পাশে পাশে ঘুরছে। আমি এক ফাঁকে পারমিতাকে লক্ষ্য করে গানটার অর্থবোধক একটা ইঙ্গিত করলাম যেখানে সজলের সাথে ওর সম্পর্কের কথাটা বোঝা যায়। শুনে পারমিতা আমার দিকে কটমট করে তাকালো। সেই দৃষ্টি আমাকে বলে দিল সজলের প্রতি ওর মোটেও আগ্রহ নেই। ওর সকল মনোযোগ আমার দিকে। সজল যদি ওটা জানতে পারে তাহলে কষ্ট পাবে। তাই আমি সজলের পক্ষে সায় দিয়ে গেলাম। অভয় দিলাম, সে নিশ্চয়ই ফিরে এসে ওকে বিয়ে করবে। তাদের প্রেমের সাফল্য কামনা করলাম। পারমিতা আমাকে বারবার ইঙ্গিত করছিল ওর কাছে যাওয়ার জন্য। আমি সেটা এড়িয়ে থাকলাম। এই সময়ে সজলকে আমি কষ্ট দিতে পারি না। সজল জানে পারমিতা ওকেই ভালোবাসে। সজল গানটা আবারো বাজাতে দিল। পারমিতা সেটা নিয়ে খানিক বিরক্ত চেহারা দেখেই অনুমান করলাম। কিন্তু কিছু বললাম না। আমার তখন এমন অবস্থা আমি পারমিতার প্রেমে হাবুডুবু খেতে পারি না। আমাদের পারিবারিক সম্পর্কটা তেল আর জলের মতো। মুখে কিছু না বললেও পারমিতা সেই দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য আকুল। গত কয়েক বছর ধরে সেটা টের পাচ্ছিলাম। গ্রামে গেলেই বেশি বোঝা যেতো। বাধানিষেধ থাকতো না কাছাকাছি থাকতে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ২য় বর্ষে। পারমিতা এসএসসি দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে বোধহয়। ওর ১৮ আমার ২১। সে বছরই আমার সবচেয়ে কাছাকাছি এসে গিয়েছিল সে। আমরা মুখফুটে কিছু বলিনি কিন্তু দুজনই জানি সত্যিটা। সত্যিটা প্রকাশ হবার জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায়। মান্না দের গানটা সবার অলক্ষ্যে আমাদের দুজনকে আলোড়িত করছিল সেই বিকেলে। বিকেলটা আমি কখনো ভুলবো না।
কিন্তু পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে কত কিছু ঘটে গেল। আমরা কে কোথায় ছিটকে চলে গেলাম। পারমিতার বিয়ে হয়ে গেল। সজল বিদেশ থেকে বিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে এলো। আমি চলে গেলাম বিপরীত পথে। আমাদের কারো জীবন কারো জীবনের সাথে যুক্ত থাকলো না। জীবনটা এরকমই। কিছু কিছু মুহূর্তে স্বপ্ন হয়েই স্মৃতির সাথে লেপ্টে থাকে। মান্না দে আমাদের তিনজনের জীবনে পাথরের স্মৃতি হয়ে থাকলো। সাথে সেই বিকেল।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব –
প্রতি সন্ধ্যায় কে যেন
ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে –
আমি চুপ করে বসে থাকি –
অন্ধকারে নীল ফানুস উড়িয়ে দেয় কারা,
সারারাত বাজি পোড়ায়
হৈ-হল্লা – তারপর হঠাত্
সব মোমবাতি ভোজবাজির
মতো নিবে যায় একসঙ্গে –
উত্সবের দিন হাওয়ার
মতো অন্যদিকে ছুটে যায়,
বাঁশির শব্দ আর কানে আসে না –
তখন জল দেখলেই লাফ
দিতে ইচ্ছে করে আমার
মনে হয় – জলের ভেতর – শরীর ডুবিয়ে
মুখ উঁচু করে নিশ্বাস নিই সারাক্ষণ–
ভালো লাগে না সুপর্ণা,
আমি মানুষের মতো না, আলো না, স্বপ্ন না –
পায়ের পাতা আমার
চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশ –
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি,
ঘড়ির কাঁটা আঙ্গুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন –
আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব!
একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঘ
ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম জানলার
কাছে –
চারিদিকে অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যচ্ছিল
না সেদিন –
সেইদিন তোমার কথা মনে পড়তেই
আমি কেঁদে ফেলেছিলাম –
চুলে দেশলাই জ্বালিয়ে চুল পোড়ার
গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
আবার -এখন আমি মানুষের মতো না –
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাত্ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার
– ভালোবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নিচু
করে বসে থাকতে ভালো লাগে না –
আমি মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই
তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি এখন – যে-দিক
দিয়ে আসি, সে-দিকেই দৌড় দিই
কেন এই দৌড়ে যাওয়া?
আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব ।।
____________________________________________________________________
কবিতা: ভাস্কর চক্রবর্তী - শীতকাল কবে আসবে সুপর্না
No comments:
Post a Comment