১.
চাঁদের গাড়ীটা যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে পথ ওখানেই শেষ। এর পরে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটাপথ মাইল খানেক। মাইল খানেকই হবার কথা। ম্যাপ তাই বলছে। শীতের বিকেলে রোদ বেশীক্ষণ থাকে না। রোদ থাকতে পৌঁছে যেতে হবে। নইলে পথ হারাবার সম্ভাবনা।
.
বাতাসে বুনো একটা মিষ্টি গন্ধ। অসংখ্য পাখির বিচিত্র কিচিরমিচির শব্দে কান ঝালাপালা হবার যোগাড়। খিদে তেষ্টা দুটোই আকড়ে ধরেছিল দীর্ঘ লক্কর ধক্কর যাত্রায়। কিন্তু এই পাহাড়ী বুনো পথে নামার পর কোথাও উধাও হয়ে গেল সব খিদে ক্লান্তি। এই জায়গাটা কত উঁচু এতক্ষন খেয়াল করা হয়নি। নীচের পাহাড়ের উপর ভেসে থাকা ধোঁয়াগুলো যে আসলে মেঘ তা বুঝতে পেরে চমকে উঠি। ওরা ঠিকই বলেছিল। এখান থেকে মেঘ ছোঁয়া যায়। কিন্তু শীতকালে মেঘ অত নীচে নামে?
.
পথটা ঢালু বলে দৌড়ে দৌড়ে নামছি প্রায়। কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে ম্যাপে চোখ রাখা হচ্ছে না। পথ হারিয়ে ফেললে রাতে কি হবে? এই অঞ্চলে কোন লোক বসতি নেই। অন্তত কয়েক বর্গমাইল নিথর পাহাড় সারি। সেই কুটিরটা খুঁজে না পেলে জঙ্গলের জীব জন্তুদের সাথেই রাতটা কাটাতে হবে। শহরের ফুটপাতে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা থাকলেও এখানে তা কাজে আসবে না। চেনা শহরের ফুটপাত আর অচেনা পাহাড়ের জঙ্গল এক নয়। এখানে বুনো জন্তুর চেয়েও ভয়ংকর হলো মশা। যদিও এই মশাগুলোর ব্যবস্থা করার জন্য অডোমস ক্রীম আছে সাথে। শহুরে মশা ধারে কাছেও ঘেঁষেনা এটা গায়ে মাখলে। বুনো মশার জন্য কতোখানি কাবিল তা প্রমান করতে অপেক্ষা করতে হবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সবকিছু ঠিক থাকলে আধাঘন্টার মধ্যে খুঁজে পাবার কথা কুড়ে ঘরটা।
.
এটা একটা নিয়মিত হাঁটা পথ ছিল এককালে। ঝোপঝাড়গুলো দেখে বোঝা যায়। ঘাসের চাপড়াগুলোর সাইজ দেখে মনে হয় খুব বেশীদিন না, হয়তো বছরখানেক আগেও নিয়মিত যাতায়াত ছিল এই পথে। উপজাতি গ্রামগুলো এখান থেকে আরো গভীরে। এদিকে রাস্তাটা ঢাল বেয়ে নেমে গিয়ে কিছুদুরে খাড়া পর্বত উঠে গেছে। ওটার উল্টো দিকেই শংখ নদী বয়ে গেছে।
.
২.
অভীকদের দলটা ছিল ট্রেকার, আমার মতো অবকাশবিলাসী কেউ না। ট্রেকিং শেষে ফেরত আসার পথেই সেই নির্জন কুটিরের দেখা পায়। একটা গা ছমছমে রহস্যময় রাত কাটায় ওরা দলবেধে। রহস্যময় মানে ভয়ের কিছু ছিল না বরং সেই রাতটার বর্ণনায় কেমন একটা রহস্যময়তার গন্ধ ছিল। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যদি সুযোগ পাই অন্ততঃ একটা সপ্তাহ ওই কুটিরের নির্জনতায় কাটাতে হবে। ওদের কাছ থেকে পথের একটা ম্যাপ যোগাড় করে রেখেছিলাম তখন। আজকে সুযোগ পেয়েই বেরিয়ে পড়েছি। কেউ জানে না আমি এখানে আসবো। যোগাযোগ করার সমস্ত যন্ত্রপাতি রেখে এসেছি বাসায়। ক্যানভাসের ব্যাগে কটা কাপড়চোপড়, শুকনো কিছু খাবার, টুকটাক জঙ্গলে দরকার কিছু জিনিসপত্র আর একটা ডায়েরী ছাড়া আর কিছু নেই।
.
পাখির ডাকগুলো আস্তে আস্তে কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে। যতই এগোচ্ছি জঙ্গল যেন ঘন হচ্ছে। ব্যাগের পকেট থেকে ছোট চাকুটা বের করতে হলো। ঝোপ ছেটে ছেটে এগোতে হচ্ছে এবার। ঠিক পথেই তো এগোচ্ছি মনে হয়। সূর্যের বিপরীতে হাঁটলে ডানদিকে নীলচে পাহাড়টা আর বামদিকে নদীর বাঁকটা দেখা যাবে। সব ঠিকই আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু সোজা এগোনো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে জঙ্গল এতটা ঘন যে চাকুটা কাজে আসছে না। ঘুরে পথ পেরোতে হচ্ছে। শিমুল গাছ নাকি এটা? সারা গায়ে কাটা কাটা? ওটার নীচে এসে দম নিতে থামলাম।
.
তখনই মনে হলো কি চরম বোকামী করতে যাচ্ছিলাম। ওরা যে পথে এসেছিল সেই পথে তো ঝোপঝাড় কাটা থাকার কথা। কিন্তু এই পথে সব আদিম জঙ্গল। ভুল হয়ে গেছে। ওরা এই পথে যায় নি। এত্ত বড় একটা গাছের বর্ণনা এড়িয়ে যাবার কথা নয়। এই সহজ কথাটা প্রথমেই মাথায় এলো না কেন? আবার উল্টো পথ ধরলাম। এটা কঠিন হয়ে গেল। ঢাল বেয়ে নামা যত সহজ ছিল, ওঠা তারচেয়ে দশগুন কঠিন। নামতে আধাঘন্টা লেগেছিল, উঠতে এক ঘন্টার কম না।
.
সূর্য দ্রুত নেমে যাচ্ছে। যেখানে একটু আগেও রোদ, এখন সেখানে ধোঁয়াটে ছায়া। দূরে নদীর ওপাশের উপত্যকায় কোথাও চুলোয় আগুন দিয়েছে কোন পাহাড়ী গিন্নী। তারই ধোঁয়াগুলো ভাসছে মেঘের মতো। কুয়াশা এসে ঘিরে ধরছে চারপাশ। এসব কি কুয়াশা? নাকি মেঘ? আমি কি মেঘ ছুঁয়ে উঠছি? দ্রুত উপরে ওঠার চেষ্টা করলাম। খিদেটা আবার মোচড় দিল। কিন্তু বসে খেয়ে নেবো উপায় নেই। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
.
৩.
হাচড়ে পাচড়ে অবশেষে যেখান দিয়ে নেমেছিলাম সেই জায়গায় পৌঁছালাম, তারপর ধপাস করে ঘাসের উপর বসে পড়লাম। গলা শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খেলাম। সূর্যটা নেমে গেছে। পুরো উপত্যকা জুড়ে ছায়ার মেলা। এই পাহাড়ের ছায়া ওই পাহাড়ে, ওই পাহাড়ের ছায়া তারো পরে। মাঝে মাঝে ছোপ ছোপ মেঘ বা কুয়াশা মাকড়সার জালের মতো ঝুলে আছে এখানে সেখানে। প্রচন্ড শীতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে হাতের তালুতে কিন্তু শরীরের ভেতরটা জ্বলছে বলে চামড়ায় হুল ফুটিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারছে না শীত।
.
বিস্কুট আর পানি দিয়ে খিদেটাকে একটু চাপা দিলাম। চিড়ে আর গুড় আছে ব্যাগে। ওগুলো রাতে খাওয়া যাবে। এখন বরং কুটিরে পৌঁছার সূচনা পথটা খুঁজে বের করি। কিন্তু এই সময়ে পথ খুঁজতে বেরুনো কি ঠিক হবে? আলো নিভে আসছে। অন্ধকার জঙ্গলে বাঘভালুক না থাক, সাপখোপ থাকতে পারে। নাহ, তার চেয়ে এখানেই রাতটা পার করি। কয়েক হাত সামনে মোটা গুড়ির একটা গাছ। ওটার সামনে আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। গাছটার দুটো শেকড় দুপাশে ছড়িয়ে মাঝে একটা খোপের মতো আসন সৃষ্টি করেছে। ওখানে লতাপাতা বিছিয়ে বসে পড়তে পারলেই সাক্ষাত বমজন হয়ে যেতে পারি একরাতের জন্য। বোধি বৃক্ষ হিসেবে অশ্বত্থের খ্যাতি প্রাচীনকাল থেকেই। এটা আসলে অশ্বত্থ তো? গাছটায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসলাম। এই আশ্রয়টা পেয়ে নিশ্চিন্ত লাগছে একটু।
.
৪.
আশ্রয়। অদ্ভুত একটা শব্দ। মানুষের জীবনটা অন্য প্রাণী থেকে একটা কারণে আলাদা। সেটা হলো আশ্রয়। মানুষের সব থাকলেও আশ্রয় না হলে চলে না। প্রত্যেক সুস্থ মানুষের দুটো করে আশ্রয় লাগে। একটা শারীরিক আশ্রয়, আরেকটা মানসিক। বেশীরভাগ মানুষ শরীরের জন্য আশ্রয় খুজে পায়, মনের আশ্রয়ের সন্ধানে সারাজীবন হন্যে হয়ে ঘুরে। তখন সে নিজেই জানে না সে কি খুজছে। ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে লাইটারে আগুন দিলাম। আয়েশে চোখ বুজে এল প্রায়। আহ পর্বতের নির্জনে অবশেষে।
.
কোথা থেকে যেন একটা আলো আসছে। মৃদু আঁচের আলোটা নেচে নেচে হাঁটছে। কে ওখানে? কেউ হাতে করে এক টুকরো আলো নিয়ে জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেমন একটা নেশা জাগালো আলোর ছন্দটা। আলোটার উৎস খুঁজতে খুঁজতে আরো গভীরে চলে গেলাম। কিন্তু আলোটা যেন লুকোচুরি শুরু করেছে। আমি যতই কাছে যাচ্ছি আলোটা ততই দুরে চলে যাচ্ছে। আলোটাকে আমার ছুঁতেই হবে এরকম একটা অনিবার্য নেশায় পেয়ে বসেছে।
.
জঙ্গলের লতাপাতা এড়িয়ে ছুটছি এলোপাথাড়ি। ঢালুতে পা পিছলে পড়ে যেতে গিয়ে একটা গাছের ডাল ধরে কোনমতে সামলে নিলাম। আলোটাও এখন স্থির। ডিমের কুসুমের মতো মসৃন আভার একটা আলো। কেবল নিজেকে আলোকিত করে রেখেছে। সাপের মনি টনি নয়তো? ভয় লাগলেও নেশা ছুটলো না। আবারো ছুটতে গেলে কোথা থেকে চিকন তারের একটা পিন এসে তীরের মতো গলায় আমুল ঢুকে গেল। বিষাক্ত তীর। ব্যথায় এবং মৃত্যুযন্ত্রনায় চীৎকার করে উঠি।
.
৫.
নাহ মরিনি। লেখাটা ব্লগে দেবার জন্য বেঁচে আছি। জেগে উঠে টের পেলাম ওটা ছিল সেরিব্রাল ম্যালেরিয়াবাহী হুলডোজার মসকুইটো।
.
রাতে আর কোন বিপদ হয়নি। আশেপাশে প্রচন্ড ভনভন করলেও অডোমাসের কল্যানে হুলডোজার তীর বর্শা ছোড়েনি। বোতলের পানি দিয়ে চিড়ে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে রাতের ডিনার সেরে নিয়েছি। চায়ের বদলে কফিক্যান্ডি দিয়ে মুখের তিয়াস মিটিয়েছি। প্রচন্ড কুয়াশায় ভিজে যাবার দশা। ভাগ্যিস টাফেটা কাপড়ের একটা আউটওয়্যার ছিল, তা দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে নিয়েছিলাম। মাথায় চওড়া কার্নিশের ক্যাপটা খুব কাজে দিয়েছিল। তবে শীতের তীব্রতা টের পেয়েছে নাক আর চোখদুটো। ওগুলো ঢাকতে পারিনি কিছু দিয়ে।
.
রাতের পরিবেশটা আমার মতো লোকের জন্য বর্ণনাতীত। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস্য মনে হবে না। বিচিত্র শব্দগুলো ৩ ডি সাউন্ডের মতো মাথার চারপাশে বনবন করতে থাকে। খানিকক্ষণ শোনার পর ছন্দটা বোঝা যায়। হাজার লক্ষ পোকামাকড়ের আজব শব্দের তানে এমন একটা উল্লাস সৃষ্টি হয় যা পৃথিবীর মধুরতম সঙ্গীতকেও হার মানাবে। মুগ্ধ হয়ে সেই শব্দের মাঝে হারিয়ে যাই। ভয়, বিস্ময়, রহস্য এই ব্যাপারগুলোর একটা অদ্ভুত সমাহার ওই শব্দের গুঞ্জরনের মধ্যে খুজে পাওয়া যায়। প্রতিটি শব্দ আলাদা করে বোঝা যায়। ওরা নিজেদের মধ্যে কেমন একটা ঐক্যতান সৃষ্টি করে নিয়েছে।
.
৬.
ভোরে ঘুম ভাঙলে নিজেকে মেঘের রাজ্যে আবিষ্কার করি। আমি আর আমার আশ্রয়দাতা গাছ বাদে বাকী জগত অন্ধকার। না ঠিক অন্ধকার নয়। আলোর আভা আছে। এই আলোটা কেবল পাচ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। তার বাইরে কোন জগতের অস্তিত্ব নেই। তবে এই জগতে আমি ছাড়াও আরো কিছু প্রাণি আছে। রাতের পোকামাকড়ের শব্দগুলো বদলে গিয়ে নানা জাতের হাজারো পাখপাখালীর শব্দ ভেসে আসছে অদৃশ্য কোন স্থান থেকে। ওরা আমকে দেখছে না, আমি ওদের দেখছি না। চারদিক কেবল সাদা সাদা সাদাময় জগত। নেই কেবল ছায়া। আমার ছায়া নেই আশ্রয়দাতা গাছের ছায়া নেই, ভুতরাজ্যের বাসিন্দা হয়ে হঠাৎ এক বিজাতীয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠি। যে নির্জন একাকীত্বের বাসনায় এই পর্বতে আসা যেন সেটার সন্ধান পেয়ে গেছি।
.
পেছনে সরসর শব্দ শুনে গাছটির উল্টোপিঠে তাকাতেই দেখি গলায় লালের আভা নিয়ে একটা সবুজ গিরিগিটি আমার কাছ থেকে একফুট দুরে নিষ্পলক চেয়ে আছে। ছেলেবেলায় এই নিস্পলক চাউনিকে এত ভয় পেতাম যে গিরিগিটি দেখামাত্র গুলতির আদেশ ছিল। গলার ওই লাল রং নাকি মানুষের রক্ত থেকে আসে। গিরিগিটি চোখ নিয়ে মানুষের রক্ত গিলে খায় দুর থেকে এরকম একটা কঠিন বিশ্বাসে বহুকাল আবদ্ধ ছিলাম। আজ সেই রক্তচোষা গিরিগিটিকে এই অরণ্যে একমাত্র বন্ধুর মতো মনে হলো। পৃথিবীতে আমি আর গিরিগিটি বাদে আর কেউ নেই। সে তো এই অরন্যের নাগরিক আমি নিতান্তই ইমিগ্রান্ট।
.
বললাম, বন্ধু নেবে আমাকে তোমার সাথে? আমার কথা শুনেই যেন লজ্জিত গিরিগিটি সুরুত করে লাফ দিয়ে নেমে গেল গাছ থেকে। জগতে আবারো আমি একা। তখনই গাছের কান্ডে ছুরি দিয়ে কাটা দাগগুলো দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে দেখি ওগুলো দাগ নয়। ওটায় লেখা আছে AVIK.
.
৭.
তার মানে অভীকদের দলটা এদিকেই গিয়েছিল। গন্তব্যের খুব বেশী দুরে নেই ভেবে আনন্দে আরেকটা লাফ দিলাম। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে মেঘগুলো সরে গিয়ে সমস্ত উপত্যকাটা উন্মুক্ত হলো। সূর্যের দেখা নেই এখনো। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে ভীষণ। ওই কুটিরে একটা স্টোভ কিংবা চুলো থাকার কথা। সাথে টিব্যাগ আর কফিপ্যাক আছে। চা কফি বানিয়ে আয়েশ করে খাওয়া যাবে।
.
পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে যাত্রা শুরু হলো। এবারে খুব বেশী খুঁজতে হলো না। ঠিক রাস্তায় এগিয়েছি। আধঘন্টা হেঁটেই পৌঁছে গেলাম সেই কুটিরে। ছোটখাট একটা বেড়ার ঘর। বাঁশের মাচার উপর বানানো। যেখানে পাহাড়টা ঝুপ করে নেমে গেছে অনেক গভীর খানে তার কিনারায় দুটো গাছের গুড়ির সাথে দড়ি দিয়ে আটকানো একটা ঝুলন্ত বারান্দার মতো ঘর। উপরেও বেড়ার ছাউনি। দরোজা বলে কোন বস্তু নেই। যে ফোকর দিয়ে কুটিরে প্রবেশ করতে হয় ওটা কেবলই একটা বাঁশের ফোকর। ঘরের এককোনে দুটো চাটাই। আরেক কোনায় সত্যি সত্যি একটা কেরোসিন স্টোভ।
.
কেউ কি থাকে এখানে? এই স্টোভ রাখলো কে? চাটাই আর স্টোভ ছাড়া আর কোন আসবাব নেই। যেদিকে শংখ নদী বয়ে গেছে অনেক নীচ দিয়ে সেই দিকটাতে আগাগোড়া বেড়ার চৌকোনো ফোকড়। চাইলে শুয়ে শুয়েও উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কেবল একটা জিনিস অস্বস্তি লাগে, পায়ের নীচের বেড়ার মচমচ শব্দ। পর্বতের এই নির্জনতার গাম্ভীর্যকে একটু ক্ষুন্ন করছে এই শব্দ। নিথর নির্জন এলাকা বলেই ছোট্ট শব্দকেও বহুদুর বয়ে নিয়ে যায় বাতাস।
.
আপাততঃ নিরুপদ্রপ কয়েকটা দিন। খাবারদাবারে সমস্যা হবে বলে ইনস্ট্যান্ট খিচুড়ীর কয়েকটা প্যাকেটের সাথে, আচার, সস, বাদাম, টোষ্ট, পনির ইত্যাদি খিদে নষ্টকারক শুকনো খাবার এনেছি ব্যাগে করে। কেবল পানিটা সমস্যা হতে পারে। কিন্তু মাইলখানেকের মধ্যেই শংখ নদীটা। দুই লিটারের বোতলে করে দৈনিক একবার আনলেই হবে। আসার পথে বুনো জাম্বুরা আর পেপে গাছে ঝুলন্ত ভক্ষনযোগ্য ফল দেখা গেছে। কলাগাছের সন্ধান করেছিলাম, এখনো চোখে পড়েনি।
.
সারাদিন এখানে সেখানে আনাড়ী ট্রেকিং করে মতো কাটালাম। সন্ধ্যার পরপর কুটিরে ঢুকে গেলাম। খিচুড়ি রান্না করলাম। খেয়েদেয়ে আর সময় কাটে না। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না। যদিও মোম আছে। তারচেয়ে এই ঘরে জোনাকিটা ঢুকে আলো করে দিক। ‘গ্রেভ অব ফায়ারফ্লাইস’ ছবিটাতে ছো্ট্ট মেয়েটি লুকোনো বাংকারে মশারির ভেতর জোনাকীর আলো মেখে ঘুমিয়েছিল। দৃশ্যটা আমি ভুলতে পারি না। কিন্তু এখানে জোনাকীরা ঘরে আসছে না। অদুরে অন্ধকার জঙ্গলে লক্ষকোটি তারকার মতো জ্বলছে।
.
ক্লান্তিতে ঘুম এসে গিয়েছিল কখন। মাঝরাতে মচমচ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভুমিকম্প হচ্ছে পাহাড়ে? এত নড়ছে কেন কুঁড়েটা? ভেঙ্গে পড়ে যাবে নাতো? কুঁড়ের চালের উপর যেন গজব নেমেছে।
.
No comments:
Post a Comment