Saturday, January 8, 2011

ঘুম পায়

ইঁচড়ে পাকা বয়সে আমার এক গুরুবন্ধু বলতো,- 'মানুষের জীবনে তিনটা মাত্র মৌলিক বিষয়, বাকী সব ফালতু। তিনটা হলো, আহার, নিদ্রা, ত্যাগ। বুঝলি'?

আমরা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলেছি, 'হুম বুঝেছি'।

বললো, 'কি বুঝলি বল।'

কি মুসিবত! আহার নিদ্রা না বোঝার কি আছে? তবে ত্যাগ নিয়ে আসলেই সন্দেহ ছিল। কারণ বাবা মা পরিবারকে ত্যাগ করাটাও যদি মৌলিকত্বে পড়ে আমি তাতে নেই। মিনমিন করে বললাম, 'ত্যাগ বাদে সব পারবো। পরিবার ত্যাগ করে থাকা সম্ভব না।'

গর্দভ!!! ধমকে উঠলো সে। 'হাঁদারাম এই ত্যাগ সেই ত্যাগ নয়। ভদ্রভাষায় বলেছি। এটা তোর প্রাত্যাহিক ত্যাগের বিষয়, প্রকৃতির ডাক।'
.
এরকম গুরুকে মান্য না করে যাবে কোন গর্দভ?
.
আজকের কথা সেই তিন মৌলিকত্বের একটা নিয়ে। ঘুম।
.
ঘুম একটি অবশ্য করণীয় আচার। আহার বাদ দিয়েও ঘুমকে প্রতিদিন প্রয়োজন। কিন্তু এই মৌলিক বিষয়টিও কি কখনো কখনো অসভ্যতার আওতায় পড়ে? তাহলে আমার সভ্য হওয়া হলো না এই জীবনে।
.
মানুষ কোথায় কোথায় ঘুমায়? বিছানা বালিশ বাদেও বাসে-ট্রেনে-আকাশে-পানিতে-মিলাদে-মসজিদে-সেমিনার-সভাসমিতি-কর্মশালায় কোথায় নয়? দৌড়াতে দৌড়াতেও নাকি কেউ কেউ ঘুমায়।
আমার এক বন্ধু আছে এক বাড়ীভর্তি হৈ হল্লার মধ্যে দিব্যি ঘুমিয়ে যেতে পারে। আরেকজন আছে মাথার উপর/পাশ দিয়ে ট্রাক চলে গেলেও বেঘোরে ঘুমোবে। পরীক্ষিত তথ্য।
.
কিন্তু ঘুমকে প্রচন্ড ভালোবাসলেও তাকে সহজে পেতাম না। আমাকে প্রচুর কায়দা কানুন করতে হতো। সমস্ত বাড়ী সুনসান নীরব এবং নিশ্ছিদ্র অন্ধকার না হলে আমার ঘুম আসতো না। বাড়ীর দূরের কক্ষ থেকে প্রতিফলিত সামান্য আলো কিংবা শব্দও আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতো। বিছানা শোবার অন্ততঃ তিন ঘন্টা পরে ঘুম আসতো কোন কোন রাতে। কোন কোন রাত একদম নির্ঘুম কাটিয়েও সকালে উঠে পড়তাম। বাসায় বন্ধুরা কেউ থাকতে এলে আমার কায়দা কানুনে ত্যক্ত হতো।
.
আমার ঘুমের কষ্ট দূর হয় চাকরী জীবনে এসে। অফিস থেকে ফিরে খেয়ে শুতে না শুতেই ঘুম। সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত অফিস করে এমন মরার ঘুম হতো, মাথার উপরে সিলিং ফ্যানের মিগ২৯ গর্জনও আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারতো না। বরং সেই মিগ২৯ গর্জনকে এত ভালোবেসে ফেলি যে অন্য কোথাও গেলে নিঃশব্দে ফ্যান ঘুরতে দেখলে অবাক লাগতো, এরা এরকম অরক্ষিত অনাবৃত ঘুমায় কিভাবে? বাইরে টুং করে রিকশার ঘন্টি বাজলেও তো ঘুম ছুটে যাবে। আমার ফ্যানটা যখন চলতো তখন বাইরের মহাসড়কে ট্রাক চললেও কোন শব্দ হতো না। সব শব্দ গিলে ফেলা সেই ফ্যানটি যেদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো, মরচে ধরা ব্লেডের দিকে তাকিয়ে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। আবার কবে এরকম একটা গর্জন ফ্যান পাবো।
.
কথায় আসি।
ভাইসব, ঘুম নিয়ে আমার কষ্ট দেখে কেউ চিন্তিত হবেন না। আজকাল আমার বেশ ঘুম হয়। তবে নির্দিষ্ট কিছু জায়গা বাদে। ট্রেনের প্রথম শ্রেনী, বাসের প্রথম শ্রেনী আর প্লেনের সীট যেখানে ঘুমানোর সমস্ত সুব্যবস্থা আছে সেসব জায়গায় আমার দুচোখ সারাদিন এক করে রাখলেও ঘুম আসে না।
.
আমার ঘুম আসে আজব কিছু জায়গায়। সবচেয়ে বেশী ঘুম আসে সেমিনার বা ওয়ার্কশপে কিংবা জুম্মার খোতবায়। আজকাল কোন সেমিনার কিংবা ওয়ার্কশপে যোগ দিতে ভয় পাই, ঘুমের ভয়ে। হলভর্তি জ্ঞানীগুনী লোকের মধ্যে একজন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, খুব অশোভনীয় ব্যাপার।
.
মসজিদে জুমার খোতবায় কতো জরুরী বিষয়ে ফতোয়া দিচ্ছে হুজুর, কিন্তু এক পাপী বান্দা ঢলে পড়ছে পাশের মুসল্লীর ঘাড়ে। কত্তবড় বেত্তমিজ লোক! কথার সামারি হলো, মোটামুটি যেসব জায়গায় জেগে থাকা ফরজ, সেখানে আমার ঘুম জেঁকে আসে।
.
তবে আরো দুটো জায়গার কথা না বললে নয়। এট দুটো জায়গায়ও আমার খুব ভালো ঘুম হয়। ভীড় ঠেলাঠেলি সমৃদ্ধ নড়বড়ে সিটি সার্ভিস বাস আর ভটভট করে চলা সিএনজি টেক্সী।
.
সিএনজি টেক্সীতে চিড়িয়াখানার মতো খাঁচার হুকুমে সবাই অখুশী হলেও আমি হইনি এই কারনে। কারন খোলা টেক্সীতে ঘুমিয়ে পড়লে গড়িয়ে রাস্তায় চলে যাবার সম্ভাবনা।
এরপর আসি নড়বড়ে শহর এলাকার বাস সার্ভিসে। বাসের ভীড়ে পকেট দুটো টাইট করে সামলে সীটের হেলানে ঘাড়টা তিনি মিনিট ফেলে রাখলেই ঘুমটা আলফা লেভেলে চলে যায়।
ভাবছেন পকেটমার হলে কিভাবে ঠেকাই?
বিশ্বাস..., বুঝলেন মশাই? বিশ্বাসের উপর কোন কথা নেই।
.
বিশ্বাস করি মাথার উপরে ছাদের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকা যাত্রীরা আমার পকেটের পাহারাদার। কেউ পকেটে হাত দিলেই পাশের জন অটোমেটিক্যালি খপ করে ধরে ফেলে চিৎকার দেবে, পকেট সামালকে!!
.
অবাক হচ্ছেন, বাঙালীর উপর এত বিশ্বাস দেখে?
অবাক হতে পারেন, কিন্তু কেউ কেউ বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বললেও বাঙালীর এই নৈতিকতার উপর আমার বিশ্বাস এখনো অটুট।
.
আচ্ছা বাঙালীর নৈতিকতা কি?
গুরুগম্ভীর বিষয়। তবু চেষ্টা করে দেখা যাক। উত্তরাধূনিক ভাষায় নৈতিকতা হলো...........এবং........বাঙালী হলো...।... অতঃপর..........অতএব.........
.
নাহ আর পারছি না......হাই উঠছে........এটা নিয়ে আরেক ইনিংসে বলতে হবে। এখন যাই, ঘুম পাচ্ছে।
.
আজকাল ব্লগ লিখতে বসলেও ঘুম পায়।

No comments: