Sunday, January 9, 2011

বিস্ময় ও প্রযুক্তি

মানুষের আনন্দিত হবার ক্ষমতা নাকি নির্ভর করে বিস্মিত হবার ক্ষমতার উপর। যার চোখে যত বেশী বিস্ময় সে তত বেশী সুখী মানুষ। শিশুরা যা দেখে তাতেই বিস্মিত হয়, আগে কখনো দেখেনি বলে। তাই শিশুদের জগত আনন্দময়। সে বস্তি শিশু হোক কিংবা প্রাসাদ শিশু। পার্থক্য এক জায়গাই, বস্তি শিশু কাঁদে ক্ষুধার যন্ত্রনায়, প্রাসাদ শিশু কাঁদে খাবার নিয়ে পীড়াপীড়ি যন্ত্রনায়।

প্রসঙ্গ বদলে যাবার আগে লাইনে ফিরে আসি। বিস্ময় বনাম আনন্দ।
আধুনিক মানুষের সবচেয়ে আনন্দের জগতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি করছে প্রযুক্তি। যে যত বেশী প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, সুখী হবার ক্ষমতা তার ততই অবমূল্যায়িত। রেডিওর মতো তুচ্ছ জিনিসের কথা নিউটন কিংবা আর্কিমিডিসের মতো মহাবিজ্ঞানীও কল্পনা করতো না। একটা সাধারন নকিয়া ১২০০ মডেলের মোবাইল দেখেও স্বয়ং আইনস্টাইন লাফ দিয়ে উঠতো, আর আইফোন বা গ্যালাক্সী দেখলে নিশ্চিত ফিট খেতো। আজকাল চারপাশে প্রযুক্তি পকেটে পকেটে। আগামী ৫০ বছরে প্রযুক্তি কোথায় পৌছাবে সেটা কল্পনা করাও মুশকিল। প্রযুক্তির প্রবৃদ্ধি হয় গানিতিক হারে।

প্রযুক্তি সুখ কেড়ে নিচ্ছে কিভাবে? বই পত্রিকা লেখালেখি, অবসরে সাহিত্য রসিক মানুষদের তিনটি প্রিয় বিষয়। আজকাল প্রযুক্তি আমাদের সময় দখল করে নিয়েছে অনেকটাই, দিনে ২৪ ঘন্টা সময়ে কুলোয় না। একদিনে নিদেন পক্ষে ৩৬ ঘন্টা থাকা দরকার।

দিনের মধ্যে কাজ দশ ঘন্টা, ঘুম ছয় ঘন্টা বাদ দিলে, বাকী ৮ ঘন্টার ৪ ঘন্টা রাস্তার জ্যামে, বাকী ৪ ঘন্টা মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, আর টেলিভিশনের দখলে। এই চার জিনিস মিলে আমাদের অবসরগুলো খুবলে খুবলে খেয়ে নেয়। আর বই, খাতা, কলম হাতে নিয়ে বসার ইচ্ছে টুকু প্রতিদিন একটু একটু মরে যায়। যারা ইন্টারনেট ব্লগ ফেসবুকে আটকানো থাকে তাদের কেউ দিনে একবারও বই খাতা কলম এই তিনের একটাও স্পর্শ করে কিনা সন্দেহ আছে। নিজের কথা ধরে বলি, সাইন করা ছাড়া কলম দিয়ে অন্য কোন কাজ করিনা বহুদিন।

প্রযুক্তির সাথে আনন্দ একেবারে নেই সেটা ঠিক না। আনন্দ আছে কিন্তু সেটা খুব সংক্ষিপ্ত। ফাষ্ট ফুডের মতো। আগে মনে হতো পুরোনো দিনের মানুষ কতো দুর্ভাগা ছিল। প্রযুক্তি বিহীন দিন কাটিয়ে মরে গেছে বেচারারা। আর আজকাল মনে হয়, ওরাই ভাগ্যবান ছিল। এখন জীবিত যারা, তাদের মধ্যে বয়স্করা সবচেয়ে কম প্রযুক্তি জীবন কাটিয়েছে, তারাই সবচেয়ে বেশী আনন্দময় সময় পেয়েছে জীবনে। যারা কমপক্ষে চল্লিশোর্ধ তারাও জীবনের ২/৩ অংশ প্রযুক্তিবিহীন সময় পেয়েছে।

কিন্তু যারা সদ্য বিশ পেরিয়েছে? তারাতো প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই প্রযুক্তির জালে আটকে পড়েছে। আর যেসব শিশু এখনো পাঁচ বছর পেরোয়নি, তারাতো প্রযুক্তির উপর পা দিয়ে হাঁটছে। আমার দেড় বছরের সন্তান এখনো কথা শেখেনি, বাবা মাকে স্পষ্ট করে ডাকতে পারে না, কিন্তু মোবাইল দেখামাত্র হাতে নেবার জন্য তীব্র চিৎকার জুড়ে দেয়, এবং মোবাইল হাতে পেলে সাথে সাথে কানে ঠেকিয়ে কা কা, কে কে করে আলাপ জুড়ে দেয় অজ্ঞাত বন্ধুর সাথে।

মোবাইল বস্তুটা আমার কাছে যাদুকরী যন্ত্র মনে হয়, নইলে ছেলে বুড়ো সবাইকে এরকম আবিষ্ট করে রাখে কেন? টিভিতে, পত্রিকায় মোবাইল কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে মনে হবে দেশের মানুষের একমাত্র কাজ হলো কথা বলা। মানুষকে দুটো বেশী কথা বলানোর জন্য মোবাইল কোম্পানীগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে।

এই মোবাইল বস্তুটা আমাদের বিস্ময় নষ্ট করেছে মারাত্মকভাবে। এটা দিয়ে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করা যায়, মুঠোর ভেতর বিশ্ব যেন। আজকাল প্রযুক্তিও অনেকটা মোবাইল কেন্দ্রিক হয়ে গেছে, কোম্পানীগুলো সব প্রযুক্তিকে এই ছোট্ট যন্ত্রটার ভেতরে সেঁদিয়ে দেবার জন্য হেন কাজ নেই করছে না। মোবাইলে কি কি প্রযুক্তি ঢুকে গেছে তা বলতে গেলে বেকুব হয়ে যাবো, তাই কি কি এখনো ঢোকেনি তার কয়েকটা বলি।

১. মোবাইল সেট টিপে এখনো খাবার বের করা যায় না। (মোবাইল টিপে খাবার বাসায় চলে আসে, সেটার কথা বলা হচ্ছে না)
২. মোবাইলে চড়ে এখনো কোথাও যাওয়া যায় না।(মোবাইল টিপে গাড়ী চলে আসে বাসায়, সেটার কথা বলা হচ্ছে না)
৩. মোবাইল টিপে গার্লফ্রেন্ডকে পাশে এনে বসিয়ে দেয়া যায় না (মোবাইল টিপলে বান্ধবী বাসায় চলে আসে, সেটার কথা বলা হচ্ছে না)

এরকম কিছু ব্যাপার বাদে বাকী সবকিছু মোবাইলে ঢুকে গেছে। যোগাযোগ, কাজ, বিনোদন, শিক্ষা সবকিছুই এর ভেতর আছে। ব্ল্যাকবেরী যখন প্রথম বেরুলো, শুনলাম ওটার ভেতর নাকি আস্ত সৌরজগত আছে। গ্রামীনে গেলাম ব্যাপার কি জানার জন্য। কৌতুহল নিবৃত্ত করার চেষ্টার মুখে ঝামা ঘষে দিল গ্রামীনের সেলসম্যান। হামবড়া মুখ নিয়ে যা বললো তার সারমর্ম হলো, ওটা তারা আমাদের মতো আমজনতার কাছে বিক্রি করবে না। পত্রিকায় ছবি দেখেছি এই ঢের। তাছাড়া দামও সাত আসমানের উপর।

মনে কষ্ট পাইনি তেমন। কারণ মোবাইলে আমি ফ্যান্সি নই। প্রযুক্তি বান্ধব মানুষ হয়েও মোবাইলে প্রাচীনতায় অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু কদিন আগে প্রয়োজনে একটা প্রযুক্তি বান্ধব মোবাইল কিনতে হলো। দামে ব্ল্যাকবেরীর ১/৪ অংশ, কিন্তু সুবিধাগুলো দেখি আইফোন ছুঁই ছুঁই, ব্ল্যাকবেরীও এখানে পাত্তা পায় না। কি বিস্ময়, পরতে পরতে, মুগ্ধ হয়ে গেলাম রীতিমতো। হঠাৎ গ্রামীণ সেলসম্যানের সেই কথাগুলো মনে হলো। একচোট হাসলাম। ওই তাচ্ছিল্যটাও এত দিন পর একটা আনন্দ দিল।

এই পর্যন্ত এসে মনে হলো, কি নিয়ে লিখতে বসেছি তা ভুলে অন্য রাস্তায় চলে এসেছি যথারীতি। কথার সারমর্ম হলো দুটো লাইন মাত্র।

প্রযুক্তি আমাদের বিস্মিত হবার ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, তাই মানুষ কোন কিছুতে বিস্মিত হয় না আজকাল। আনন্দের দিনগুলোও হারিয়ে গিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর বিষন্ন দিন দখলে নিয়েছে জীবন। সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের কোন প্রতিফলনে মুগ্ধতা আসে না। ছেলেভুলানো ছড়া দিয়ে কান্না থামাতো আগের দিনের মায়েরা, আজকাল আইফোনে la isla bonita ডান্স দেখিয়েও কান্না থামানো যায় না, প্রতিদিন এক জিনিস কাহাতক সহ্য হয়। একটা খেলনা দিয়ে ১২ ঘন্টাও পোষায় না। নতুন কিছু চাই!

আমরা সুখী হতে বেগ পাচ্ছি, সুখ আমাদের ছুয়ে ছুয়ে চলে যাচ্ছে প্রাচীন কোন রাজ্যে। যায় দিন সবসবয় ভালো হবেই, আসে দিন নয়।
দিনশেষে যাযাবরের সেই কথাগুলো সত্যি মনে হয়, প্রযুক্তি দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাই না?

No comments: