বেড়ানোর সুশীল জায়গাগুলোতে অরুচি ধরে গেছে। কক্সবাজার, রাঙামাটি বান্দরবান, সেন্টমার্টিনের কথা শুনলেই গা গুলায়। এত এত মানুষের ভীড় যেন বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যুতসই জায়গা খোঁজার জন্য গুগল আর্থের সহায়তা নিলাম। চট্টগ্রামের আশেপাশে হাতের নাগালে মানুষ যেখানে যায় না সেরকম অজনপ্রিয় একটা গন্তব্যের জন্য খোঁজ দ্য সার্চ লাগিয়ে প্রায় ঘরের কাছেই ৫০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে পছন্দ করে ফেললাম দুদুটো জায়গা। তারই একটাতে গিয়ে ২০১০ সালকে বিদায় দিলাম ৩১শে ডিসেম্বর।
সেটির কথাই বলি এখন। জায়গাটা চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ২০ কিমি দূরে পটিয়ার রিজার্ভ ফরেষ্টে।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাবার পথে কর্ণফুলী নদীটা পেরিয়ে ডানদিকে আনোয়ারাকে রেখে বামদিকে আধাঘন্টা চলার পর পটিয়ার যানজটের পাল্লায়। মফস্বলের এই যানজট ঢাকাবাসীর কাছে নস্যি হলেও ভ্রু কুঁচকে উঠবে অজান্তেই। পাড়া গাঁয়ে কিসের এত যানজট! পনেরো মিনিটের সেই জট পেরিয়ে খানিকটা আরো দক্ষিনে গেলেই নির্ঝঞ্জাট পথের শুরু। শ্রীমাই খাল পেরিয়ে যাবার সময় বামদিকে সবুজ অনুচ্চ পাহাড়ের দীর্ঘ সারিগুলি ঠিক হাতছানি দেয় না, কিন্তু রহস্যপ্রিয় মানুষের কৌতুহলের যোগান দেয়। কি আছে ওই পাহাড়ের অরণ্যে?
আরো কিছুদুর গেলে কমল মুন্সির হাট। তারপর দুপাশে মেহগনি গাছের সারির ছায়ার পথ পেরিয়ে মাইলখানেক গেলেই একটা মসৃন সেতু যার তলা দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা পাহাড়ী ছড়া। খরনা খাল বলে জনপ্রিয় সেটি। সেতুটা পেরিয়ে দক্ষিনে আরো দুশো গজ গেলে খরনা রাস্তার মাথা। ডানদিকে আজিমপুর গ্রাম আর বামদিকে একটা ছোট্ট পিচঢালা পথ পূর্ব দিকে চলে গেছে ধানক্ষেত চিরে।
ওইপথ দিয়ে কিছুদূর গিয়ে প্রাচীন একটা বৃটিশ আমলের রেল লাইন, এখনো টেনেটুনে দৈনিক একটা ট্রেন আসে আঁকাবাঁকা লাইন দিয়ে, তার পাশেই খরনা স্টেশানের প্রাচীন জরাজীর্ন লাল কুটির। কিছু দোকানপাট আর রেল লাইন পেরিয়ে পুবে আরো আধমাইল গেলে পথ শেষ। এখানে রিকশা বা গাড়ী থেকে নেমে পায়ে হাঁটা পথ।
ঠিক সোজা নয় তবে পুব দিকে যে পথটা একে বেঁকে চলে গেছে দিগন্তের দিকে সে পথে হেলে দুলে হাঁটতে হবে। কিছুদূর পর পর লোকজন দেখলে জিজ্ঞেস করতে হবে খরনা পাহাড় কতদূর? কোন পথে যেতে হবে? উত্তর আসবে, 'ওখানে কি, কেন যাবেন?' বলতে হবে, 'বেড়াতে যাবো, পাহাড় দেখবো।'
শুনে ওরা অবিশ্বাসের দৃষ্টির সাথে ফিসফিস করে স্থানীয় ভাষায় বলবে, 'বেয়াক মিছা হতা, জাগা কিনতো আইসসেদে'। (সব মিথ্যে কথা, জমি কিনতে আসছে)
আরো কিছুদূর পেরিয়ে গেলে লোকালয় একেবারে শেষ। টুকরো টাকরা টিলা জঙ্গলের শুরু। তার আশেপাশে সবজী ক্ষেতে নিড়ানি দিচ্ছে কৃষক। নতুন লোক দেখে সবার কৌতুহলী দৃষ্টি। জিজ্ঞেস করবে 'ওবা হন্ডে যদ্দে' (কোথায় যাচ্ছো ভাই?)। বলা হবে, 'ওই পাহাড়ে যাচ্ছি, যেখান থেকে খরনা খাল নেমে এসেছে।'
বলবে 'বেশীদূর ন যাইয়ু, আতি আছে এন্ডে' (বেশীদূর যাবেন না, হাতি আছে ওদিকে)।
জুতো স্যান্ডেলে চলার পথও শেষ হবে একসময়। দিগন্তে বিলীন জঙ্গলের রেখাগুলো এখন পাহাড়ের চেহারায় ধরা দেবে। বুনো গাছপালাগুলো অনেকটা স্পষ্ট এখন। রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখা যাবে কলকল শব্দে স্বচ্ছ জলের খরনা খালের ধারা বাঁক ঘুরে চলে গেছে অনেক গভীর অরণ্যে। এখান থেকেই খরনা খালের পাহাড় যাত্রা। এখান থেকেই সত্যিকারের অরণ্য ভ্রমণ শুরু। আনন্দেরও।
সম্মুখে দাঁড়ানো করলডেঙ্গা পাহাড় শ্রেনী। কর্ণফুলী নদী থেকে শংখ নদী পর্যন্ত উত্তর দক্ষিনে আঠারো মাইল বিস্তৃত বিশাল এই বনভূমি। অনুচ্চ সবুজ পাহাড়গুলো মোটামুটি ১৫০ থেকে ৩০০ ফুটের মধ্যে অবস্থিত। যার অতি সামান্য অংশে মানুষের যাতায়াত সম্ভব। পুরো এলাকাই দুর্গম। বন্য হাতির রাজত্ব বলে বাইরের মানুষেরা আসতে সাহস পায় না।
==
==
==
==
লোকালয়ের এত কাছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বিশাল একটা খনি এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে ভাবতেই অবাক লাগে। আট দশ মাইল দুরের পাহাড় চুঁইয়ে নেমে আসা এই ঝরনাটি আমার গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে, অথচ একবারও যাইনি ওই পাহাড়ে। ছেলেবেলায় দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে মেঘের ছায়া পড়তে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। বড় হবার পর পাহাড়টা কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল। আসলে দৃষ্টিসীমার ভেতর গ্রামের গাছপালাগুলো বেড়ে গিয়ে ঢেকে দিয়েছিল আর চাপা পড়ে গিয়েছিল পাহাড়ে যাবার বাসনাও।
অনেক বছর পেরিয়ে যাবার পর এই স্বপ্নটা সত্যি সত্যি পূরন হলো। এবারের যাত্রা ছিল পথের নিশানা চিনে আসার যাত্রা। রাত্রিযাপনের স্বপ্নটা আপাততঃ মূলতবী রইল। পরের বারে যাত্রা হবে আরো গভীরে, আরো রহস্য রোমাঞ্চের প্রতিশ্রতি নিয়ে।
সবশেষে, ফিরে আসার সময় ঝোলানো ক্যামেরায় যেমন খুশী তেমন তোল - অনির্দিষ্ট ফোকাসের তিন মিনিটের ভিডিওচিত্র। আগ্রহীরা ক্লিক করে দেখতে পারেন। এখানে কান পেতে কি অরণ্যের ডাক শোনা যায়?
আরো কিছু ছবি দেখতে এখানে
http://www.flickr.com/photos/hrrh69/sets/72157625609627663/
No comments:
Post a Comment