"ঘোড়া একটা অতিশয় ভদ্র প্রাণী, অসম্ভব কষ্টসহিষ্ণু একটা প্রাণী, জগতের সকল প্রাণীর তুলনায় দয়ালু" ইত্যাদি বিশেষণ যার উদ্দেশ্যে মনে মনে বিড়বিড় করছিলাম তার চেহারায় বিন্দুমাত্র সন্তুষ্টির চিহ্ন দেখা গেল না।
এই নিজস্ব মন্ত্র উচ্চারণের কারণ ঘোড়াটা যেন পাহাড়ে ওঠার সময় বিগড়ে না যায়।
কিন্তু তার বিমর্ষ চেহারা আমাকে খানিক চিন্তায় ফেলে দিল। বিমর্ষতার কারণ বুঝলাম যখন গাইড ছেলেটা বললো দিনে তিনবার ঘোড়াটা ওই দুরূহ পর্বতের মাথায় চড়ে টুরিষ্ট নিয়ে। ইউরোপীয়ান টুরিষ্টই বেশী। ওদের সাইজ আমার তিনগুন। হয়তো খানিক আগে আড়াইশো পাউন্ডের কোন হোৎকাকে নিয়ে পাহাড়ে চড়ে এসেছে। ইচ্ছে ছিল একটু খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নেমে। কিন্তু সেই সময়ই আমি ওর পিঠে চড়ে বসলাম দেড় মন+ ওজন নিয়ে। বেজার হবার এরকম নানাবিধ কল্পনা মাথায় ঘুরতে থাকলো আর দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকলো। ঘোড়াটা দপ দপ করে পাথুরে পথ পেরিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল আমার আসনটা ধরে শক্ত করে বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। চারপাশের প্রকৃতি অতীব মনোরম। পাইনের জঙ্গল ভেদ করে ট্রেইলটা পর্বতের উপর উঠে গেছে। আশেপাশে বেশ কটা ছোট ছোট ঝরনাধারা নেমে আসছে পর্বত থেকে কলকল শব্দ নিয়ে। এত গহীন জঙ্গল কিন্তু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না।
এই ঘোড়ার কোন লাগাম নেই, থাকলেও লাভ হতো না, আমি অশ্বচালনা দূরে থাক জীবনে এই প্রথম একটা ঘোড়ার পিঠে চড়েছি। ঘোড়ার মালিক/পরিচালক বলে দিয়েছিল, শক্ত করে আসনটা ধরে বসতে। সাদা রঙের ঘোড়াটি তার মালিকের মুখের বিচিত্র শিসের ইশারায় চলে।
আমি বাল্যকালে দস্যুবনহুরকে অসংখ্যবার ঘোড়ায় চড়ে দুর্গম পাহাড় বাইতে পড়েছি। আজকে যে পাহাড়টায় উঠতে যাচ্ছি সেটি অতীব দুর্গম চেহারার। দূর থেকে তার কালচে পাথুরে খাড়া চেহারা দেখেই মেরুদন্ড বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করেছিল। যেন আমি ওই পাথুরে পাহাড়ে টিকটিকির মতো বেয়ে উঠবো। আমার সঙ্গীকে কোনমতেই রাজী করাতে পারলাম না ওই পর্বতে উঠতে।
পনেরো মিনিট যাবার পর জঙ্গল শেষ হয়ে গেল। এখানে পাহাড় উন্মুক্ত অনেকটা। পথও বিশেষ সরু। হাতের বায়ে ভয়ানক খাড়াই। দূরে তাকিয়ে অপূর্ব সবুজের সমারোহ দেখে মুগ্ধ হলাম। পারো উপত্যকাটা থিমফুর চেয়েও সুন্দর কোন সন্দেহ নেই। যেদিক উঠছি কলকল করে পাহাড় থেকে ঝরনা নেমে আসছে। ঝরনার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই চারপাশে। সুনসান প্রকৃতি।
রোদ বাড়ছে, গরমে মাথাটা তেতে উঠছে। চলার পথ রুক্ষ হচ্ছে। আধঘন্টা পরই ঘোড়াটা হাঁপাচ্ছে রীতিমতো। আরো দেড়ঘন্টার পথ। এখানেই হাঁপিয়ে গেলে বাকী পথ কেমনে উঠবে? খানিক পর একটা সিমেন্ট বাধানো পানির হাউস দেখা গেল পথের ধারে। ঘোড়াদের পানি খাবার সরকারী ব্যবস্থা। ঘোড়াটা ওখানে দাঁড়িয়ে পানি খাওয়া শুরু করলো। পানি খেয়েও নড়ছে না, দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে আসছিল ঘোড়ার শিস পরিচালক। শিস দিয়ে সে ঘোড়াকে চলতে হুকুম দিল। ঘোড়া মাটিতে পা ঠুকে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলো। তারপর চলতে শুরু করলো।
কিছুদুর ওঠার পর আবারো হাঁপাচ্ছে ঘোড়াটা। এখানে আর গাছপালা নেই। ট্রেইলটা একদম সরু, রুক্ষ পাথুরে, ডানপাশে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে, বামদিকে নেমে গেছে কমসে হাজার ফুট। দূরের পাহাড়গুলো অনেক নীচে। আমার গলা শুকিয়ে গেল এই জায়গায় এসে। সম্ভবতঃ ঘোড়াটিও ক্লান্ত হলো এই জায়গায় এসে। থম করে দাড়িয়ে পড়লো। এই ঘোড়ার একটা বদ স্বভাব হলো সে চলে একদম কিনার ঘেষে। যেখানে এক ইঞ্চি ভুল পা দিলেও পতন অনিবার্য।
আর এখন সে গ্যাট ধরে যেখানে দাড়ালো সেটা চরম বিপজ্জনক একটা জায়গা। এটা একটা ভি আকৃতির বাঁক। আমরা দাঁড়িয়ে সেই ভি এর কোনাটাতে, যেখানে সামনে পেছনে বায়ে সবদিকেই খাড়াই। পাখা থাকলে উড়াল দিতাম সেই মুহূর্তে। কিন্তু তখন নড়তেও ভয় করছে, ঘোড়ার পিঠ থেকে নামা তো অসম্ভব ওই সরু জায়গায়। মাথার উপরে কড়কড়ে সূর্য। ঘামতে ঘামতে আমি ঘোড়ার মেজাজ বোঝার চেষ্টা করছি। কি ব্যাপার নড়ে না কেন ব্যাটা?
অবলা প্রাণীটার মর্জির সুতোয় ঝুলছে আমার জীবন তখন। সে যদি চায় পিঠে হালকা ঝাকুনি দিয়ে আমাকে নীচে ফেলে দিয়ে ঝামেলা দুর করতে পারে। মতলব কি রে তোর? বাংলা ইংরেজী কোন ভাষা বোঝে না ব্যাটা। পেছনে তাকিয়ে দেখি ঘোড়া চালকও কোথায় উধাও। আমি একা। ধ্বক করে উঠলো বুকটা। এই প্রথম আক্ষেপ হলো কেন পায়ে হেঁটে পাহাড়ে চড়লাম না। নবাবী করতে গিয়ে ধরা। লাঠি নিয়ে পাঁয়ে হেটে ওঠা অনেক নিরাপদ ছিল এর চেয়ে। ঘোড়াকে ধমক দিতেও সাহস পাচ্ছি না। ব্যাটা বিগড়ে গেলে আরো মুশকিল। এখন এমন জায়গায় সে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে নীচে নামতে হলে প্যারাস্যুট লাগবে।
মাত্র দুই মিনিট। দুই মিনিটকে মনে হলো দুই ঘন্টা। অবশেষে পেছন থেকে শিস শোনা গেল। তখন ঘোড়া নড়তে শুরু করলো আবার। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
কিছুদূর যাবার পর দেখি তিনচারজন বুড়োবুড়ির একটা দল। ষাট সত্তরের কম হবে না একেকজনের বয়স। ওরা পায়ে হেটে লাঠিতে ভর দিয়ে পর্বত আরোহন করছে। এই বেলা চরম লজ্জা এসে গ্রাস করলো আমাকে। এরা পায়ে হেটে উঠছে আর আমি দামড়া জোয়ান ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ে উঠছি। মনে মনে ধিক্কার দিলাম ঘোড়ায় চড়ার আয়েশী বুদ্ধিটাকে। কাছাকাছি যেতেই বুড়োবুড়ির দল আমাকে দেখে হেসে উঠলো। মুখে বললো 'হাই, হ্যালো'। আমিও হ্যালো বললাম কাষ্ঠহাসিতে। মনে মনে নিশ্চয় বলছে "ব্যাটা রামছাগল ঘোড়ার পৃষ্টে চড়িয়া পাহাড়ে উঠতাছে।"
তাড়াতাড়ি বুড়োবুড়ির দলকে পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম। পথটা যত উপরে যাচ্ছে কঠিনতর হচ্ছে। ঘোড়ার পিঠটা খুব নড়ছে এখন। সোজা বসে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাটা ঝপাত করে বসে পড়লে তো সোজা নীচে। রাস্তা ফুরায় না। আর কতোদুর? গলায় ক্যামেরা ঝুলানো আছে ঠিকই কিন্তু ফটো তুলতে গেলে হাত ছেড়ে দিতে হবে। তাই ছবি তোলা বাদ। এই বদ ঘোড়াটার কোন বিশ্বাস নাই। ঝাঁকুনি দিতে পারে যে কোন মুহুর্তেই। আমার ভ্রমন সঙ্গী রিজওয়ান ভাই আর গাইড উগেন তো নীচে রয়ে গেছে। চারঘন্টার মধ্যে না ফিরলে ওরা আমাকে রেখে হোটেলে চলে যাবে। পরে ড্রাইভার এসে আমাকে নিয়ে যাবে। দ্রুত উঠতে চেষ্টা করছি। মানে ঘোড়াকে মনে মনে বলছি দ্রুত চলতে। কিন্তু সে তার গতিতেই যাচ্ছে।
খানিক পর একটা সমতল চত্ত্বরের মতো একটা জায়গায় এসে ঘোড়া থেমে গেল। পেছনে আসা ঘোড়াচালক জানালো ঘোড়ার দৌড় শেষ। বাকী পথ তোমাকে হেঁটে উঠতে হবে। আশপাশের প্রকৃতি খুবই সুন্দর, কিন্তু ওই ভর দুপুরের গরমে আর পথে ঘোড়ার ধকলের জন্য সৌন্দর্যটা আমাকে তেমন আকৃষ্ট করলো না। তবু ক্যামেরা তাক করে চতুর্দিকের দিগন্তের পর্বতগুলো ক্যামেরার ফ্রেমে আনতে চাইলাম। পছন্দ হচ্ছে না ছবিগুলো। অভিজ্ঞতা থেকে জানি এরকম রোদে ছবি ভালো আসে না। আর এই দিগন্তজোড়া সৌন্দর্য গতকালকের দোচুলার সৌন্দর্যের সাথে তুলনাও করা যায় না। দোচুলা অসাধারণ। উচ্চতায় থাকসানের চেয়ে দোচুলা এগিয়ে। ওটি আগে দেখে আসার ফলে থাকসান এলাকার পর্বত আমাকে তেমন মুগ্ধ করছে না।
বাকী পথ আরো দেড় ঘন্টার। এই জায়গায় একটা রেস্তোঁরা আছে। রেস্তোঁরার পাশে দাড়িয়ে সামনেই দেখা গেল কাংখিত সেই থাকসান মনেষ্ট্রি যা দেখার জন্য হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসে। রেস্তোঁরার ভেতরটা গমগম করছে নানান দেশী টুরিষ্ট। এই নির্জন পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে এসে এখানকার এই কোলাহলটা কেমন বেমানান লাগলো। আমি ঘড়ি দেখলাম বারোটা বাজে। উপরে উঠতে গেলে দেড়টা। ওখান থেকে নীচে নামতে তিন ঘন্টা। মাথার উপর চান্দিপোড়া সূর্য। পুরো পাথুরে এলাকা এটা। সারা ভুটানে এত ঠান্ডা দেখলাম, কিন্তু এখানে সূর্যটা যেন বেশী রকমের তেতে আছে। মোবাইল বেজে উঠলো। নীচ থেকে গাইড ফোন করেছে। বললো, তুমি কোথায়, কতক্ষণ লাগবে নামতে।
বললাম, আমি তো এখনো পুরোটা উঠতেই পারিনি। মাত্র অর্ধেক এলাম।
সে বললো, তোমার সঙ্গী তো ফিরে যেতে চায়। তুমি থাকো নাকি?
আমি উপরে ওঠানামার সময়টা হিসেব করে সিদ্ধান্ত নিলাম, যথেষ্ট হয়েছে, ফেরা যাক এখান থেকেই। মাথার উপরে এরকম হিটার নিয়ে বাকী পথ উঠে দিনটা এখানে কাবার করার কোন মানে হয় না।
উগেনকে তাড়াতাড়ি বললাম, 'আরে না গরমে আমার মাথা ঘুরাচ্ছে এই পর্যন্ত এসে। বাকীপথ উঠতে পারবো না বোধহয়। থাকো তোমরা। এখুনি নেমে আসছি আমি'। ওখানে হাঁটাহাটি করে বেশ কিছু ছবি তুললাম থাকসান মনেষ্ট্রির। তারপর নামতে শুরু করলাম। নামার সময় ঘোড়া নাই। আমি মরে গেলেও ঘোড়ায় চড়ছি না আর এই পথে। একটা হারামী ঘোড়া।
নামতে আর কতক্ষণ লাগবে। ভাবলাম আমি। কিন্তু এখুনি নামছি বললেও নামছি তো নামছি, নামছি তো নামছিই, পথ ফুরায় না যেন। প্রায় এক ঘন্টা নামার পর ঝরনার জায়গাতে আসলাম। ততক্ষণে পায়ের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ। অনেকদিন এরকম হাঁটাহাঁটি করিনি। পা সোজা রাখা দায় হয়ে গেল। হাটু ভেঙ্গে আসছে। বিশ্রাম নিলাম দুয়েকটা জায়গায়। প্রায় ঘন্টা দেড়েক হাঁটার পর গাড়ির কাছে পৌছাতে পারলাম প্রায় বিধ্বস্ত। নামতে নামতেই পায়ের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে, উঠতে হলে না জানি কী দশা হতো।
উগেনকে বললাম, এবার হোটেলে নিয়ে চলো। একটা কঠিন ঠান্ডা শাওয়ার দরকার। নইলে সামনের বরফগলা নদীতে নেমে যাবো। গলা শুকিয়ে শিরিষ কাগজ। পানি খেলাম ঢকঢক করে আধবোতল। গাড়িতে রাখা শীতল জলের পানিও দেখি গরম হয়ে গেছে।
কিন্তু গাড়ী চলতে শুরু করলো আরেক গন্তব্যে। উগেন বললো, পারো জং দেখে যাই চলো। প্রাচীন একটা দুর্গ। আমি বেজার মুখে রাজী হলাম। দু্র্গের কাছে গিয়ে দেখি গেট বন্ধ। দুর্গ দেখা যাবে না। গত ভূমিকম্পে যে ক্ষতি হয়েছে তা মেরামতের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। খুশী হলাম মনে মনে।
ফেরার সময় খিদে পেয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখি হাতের ডানদিকে একটা সাদা কি যেন দেখা যায় আকাশের গায়। দুটো পর্বতের মাঝখানে আরেকটা সাদা পর্বত যেন। উগেনকে বললাম, গাড়ি রুখখো!!!!
অদ্ভুত সুন্দর আরেকটা পর্বত। এটা আমাদের প্ল্যানে ছিল না। যেন অলৌকিক ভাবে হাজির হয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর ছবিটবি তুলে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। ওই চুড়াটার নাম মনে নেই। তবে ওটাকে কাঞ্চনজংঘার প্রেয়সী বলা হয়। সিকিম তিব্বত আর ভুটান সীমান্তে অবস্থিত সেটি।
হোটেলে পৌছে শাওয়ার নিলাম। তারপর কাপড় বদলে নীচে ডাইনিং টেবিলে গেলাম। হোটেল জিগম্যালিনের রেষ্টুরেন্টটা বেশ গোছানো। কারুকার্যময়। খাবার মেনু বুফে। সাত আটটার মতো আইটেম। ওখান থেকেই খেতে হবে। খাওয়া শেষ করে বেরুলাম আবার। উগেন এবার নিয়ে গেল ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। ওখানে ক্যামেরা গেটে জমা রেখে ঢুকতে হয়। টিকেট কাটতে হলো ৫০ গুলট্রাম করে। ওটাও একটা পাহাড়েরর মাথায়। পারো ভ্যালীটা খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে ওখান থেকে। কিছু সময় পার করে নেমে এলাম। তারপর গেলাম একটা পুরোনো সেতুর কাছে। সেতুটা সুন্দর। নির্জন পাহাড়ের পাশে। এই শহরটা একদম নিরিবিলি। রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই। মোড়ে একটা মজার দৃশ্য দেখলাম। এই মোড়টা এত নির্জন যে এখানে কটা গরু আড্ডা জমিয়েছে রাস্তার উপর। এই প্রথম গরু দেখলাম শহরের কেন্দ্রে। আরেকটু এগিয়ে দুটো ঘোড়াকে দেখলাম রাস্তার পাশে প্রেম করছে। কালো ঘোড়াদুটি দেখে পছন্দ হয়ে গেল, ছবি তুলে ফেললাম। তারপর ব্রীজের উপর উঠে গেলাম। এই ব্রীজের সামান্য দূরে একটা বাড়ি। বিরাট দেয়াল ঘেরা। এটা ভুটানের রাজার পারো শহরের আবাসভবন। আগামী পরশুদিন রাজা এখানে আসবেন বিয়ের দ্বিতীয় অনুষ্ঠান করতে।
ব্রীজ দেখা শেষ করে বললাম, আজকের মতো আর না, পা ব্যাথা হয়ে গেছে আমার। আমার সঙ্গী বললো যাবার সময় মার্কেটে ঘুরে যাই। পারোতে প্রধান সড়ক একটাই। ওটার দুপাশে যা আছে সেগুলোই মার্কেট।
মার্কেটে ঘুরতে ইচ্ছে হলো না। একটা ছোট্ট মুদী দোকানে গিয়ে জুতোর ব্রাশ কিনলাম ৩৫ টাকা দিয়ে। কেডসের চেহারা থাকসানের ধুলোর আড়ালে হারিয়ে গেছে। এটা নিয়ে ভদ্রসমাজে মেলামেশা করা অসম্ভব। গাড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে ধুলো ঝেড়ে ভদ্র হলাম। আমার সঙ্গী কেনাকাটা করছে ঘুরে ঘুরে। আমি একটা দোকানে ঢুকে কয়েকটা সাবান আর এয়ারফ্রেশনার কিনলাম। ভুটানের নিজস্ব প্রোডাক্ট খুব কম, এটি তার একটা। তারপর হোটেলে ফিরে গেলাম। উগেন আমাদের রেখে চলে গেল। বাকী সময় আমাদের নিজস্ব। গাইড ছাড়া আশেপাশে ঘুরবো। সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। রুমে ঢুকে গেলাম যার যার।
হাতমুখ ধুয়ে টিভি ছাড়লাম। ডায়েরী লিখলাম। দিনের কর্মসূচি লিপিবদ্ধ করলাম। কেমন ক্লান্তি সমস্ত শরীরজুড়ে। দুটো বিছানা পাতা আছে। মানুষ আমি একজন। খানিক ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। ডানদিকের বিছানায় ঢুকে গেলাম। উষ্ণ লেপের নীচে। টিভিতে রাজার বিয়ে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। এদের যত জিনিস দেখেছি সবচেয়ে বোরিং বিষয় হলো টিভি। ভুটানের নিজস্ব চ্যানেলগুলো স্রেফ অখাদ্য। এইচবিও খুজে বের করলাম। জেমসবন্ডের একটা মুভি দেখাচ্ছে। আগেই দেখা। দেখতে দেখতে ঘুম এসে গেল। ঘন্টাখানেক ঘুমানোর পর জেগে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। রাস্তায় কোন লোকজন নেই। মনে হচ্ছে মাঝরাত পেরিয়েছে। আশ্চর্য একটা শহর এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে? কেডস পরে পকেটে পাসপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় হাটবো। একা একা বেরুলাম নির্জন রাস্তাটায়। এরকম সুনসান কোন শহর আমি দেখিনি। মাথার উপর চাদটা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে। শীতটা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে এখন। দোকানপাট সব বন্ধ। কেবল বারগুলো খোলা আছে। লোকজন পান করতে ব্যস্ত। এই সময় কারো কিছু করার নেই। কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ফিরে এলাম।
হোটেলে ফিরে শুনলাম খাবার তৈরী। বসে গেলাম। রাতের খাবার সারলাম রুটি ভাজি মুরগী ডালভুনা ইত্যাদি দিয়ে। খেয়ে আবার বেরুলাম সঙ্গীসহ। দুজনে এবার গেলাম একেবারে নদীর ধারে। নদীটাও কাছাকাছি দুই ব্লক পরে। নদীর ধারে পুলিশফাড়ি বা থানা। রেলিং ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে পাহাড়ের খাজে খাজে মানুষের ঘরবাড়ি গুলো দেখতে লাগলাম। অন্যরকম একটা শহর। আস্ত একটা গ্রাম কেউ এই শহরে ঢুকিয়ে দিয়েছে যেন। এত সুন্দর গ্রাম আর যেন দেখিনি। নদীর কলকল শব্দ ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। ঝরনাময় নদীর এই শব্দটা এত চমৎকার করে বাজে সারারাত শুনলেও বিরক্তি আসবে না বোধহয়। কুকুরে আনাগোনা মানুষের চেয়ে বেশী মনে হলো। নদীর ধার থেকে এবার শহরের নির্জন রাস্তগুলো দিয়ে হাটা শুরু করি। কালকে রাজার বিয়ে, সবাই দোকান বন্ধ করে বাইরে সাজাচ্ছে। মজাই লাগলো দেখে। রাজা যে পথে যাবে সেই পথগুলো বিশেষ কায়দায় সজ্জিত হচ্ছে।
দশটার আগেই হোটেলে ঢুকে গেলাম। ঘুমোতে হবে আজকে বেশ করে। ভুটানে আমাদের শেষরাত।
No comments:
Post a Comment