Wednesday, October 26, 2011

হিমালয় দর্শন - ৩য় দিন

উগেন আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল ক্লক টাওয়ারের সামনে। হোটেলে ঢুকতে ইচ্ছে হলো না এত তাড়তাড়ি। শেষ বিকেলের থিম্ফু। ফুটপাত ব্যস্ত। মানুষ দেখতে লাগলাম হাঁটতে হাঁটতে। এই সময়ে ফুটপাতটা দিনের সবচেয়ে ব্যস্ত। তবু ঢাকার যে কোন ফুটপাতের চেয়ে কম ভীড়। বাড়ি ফিরছে লোকজন কাজ সেরে। বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরছে। আধুনিক আর ট্রাডিশানল দুরকম পোষাকের ছড়াছড়ি রাস্তায়। মানুষ, দোকান, রাস্তা ইত্যাদি দেখতে দেখতে ভুটানী মানস আবিষ্কারের চেষ্টায় থাকি। ভুটানের আসল সংস্কৃতি কি? সরকার চায় মানুষ ঐতিহ্যকে ধরে রাখুক। মানুষ চায় আধুনিক ফ্যাশান। দোকানপাট দেখে তাই মনে হলো। এখানে কোথাও কি একটা সুক্ষ্ণ দ্বন্দ্ব আছে? সত্যি কি ভুটানীরা সব সুখী মানুষ? আমি পরিসংখ্যানের মিথ্যা দেখে অভ্যস্ত। তাই মানুষের সাথে কথা বলে, চেহারা দেখে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি লুকোনো কোন দুঃখ বঞ্চনা। কিন্তু সহজ সরল হলেও খুব চাপা ওরা। বোঝা গেল না।



হাঁটাহাটিতে হাটু ব্যাথা করা শুরু করতে হোটেলে ফিরলাম। রুমে গিয়ে পোষাকআশাক বদলে, শাওয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ পর তেতলার রেষ্টুরেন্টে নেমে এলাম। হালকা পানীয়ের তেষ্টা পেল আমার সঙ্গীর। একটা টেবিল দখল দিয়ে বসে অর্ডার দিলাম। হঠাৎ রেষ্টুরেন্টের ওই পাশ থেকে একটা বাংলা কন্ঠ বলে উঠলো 'দাদারা বাঙ্গালী মনে হচ্ছে!' তাকিয়ে দেখলাম কন্ঠের মালিক আমাদের লক্ষ্য করেই বাক্যটা নিক্ষেপ করেছেন। আমার সঙ্গী রিজওয়ান ভাই পাল্টা বাক্য ছুড়লেন, 'বাঙালী আর থাকতে পারলাম কই, কাঁটাতার দিয়ে আমাদের তো বাংলাদেশী বানিয়ে দিলেন।' সেই শুরু। খোঁচাখুচি বাক্য বিতন্ডার পাঁচ মিনিটের মাথায় কৃষানু ব্যানার্জি আর অনিন্দ্য চ্যাটার্জী আমাদের টেবিলে এসে যোগ দিলেন। শুরু হলো জমাট আড্ডার এক আসর। রাজনীতি, অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্য, মাছের বাজার, জীবনযাত্রা সকল বিষয় নিয়ে প্রায় তিনঘন্টা ব্যাপী আড্ডা। রাত এগারোটায় নেহাত বাধ্য হয়ে ইস্তফা দিলাম আমরা। পরদিন আমাদের পারো ফিরে যাবার কথা। পারোতে হোটেল বুকিং দেয়ার জন্য ট্যুর অপারেটরকে খুব পীড়াপিড়ি করছিলাম সন্ধ্যার সময়ও। কিন্তু এই আড্ডার শেষে রিজওয়ান ভাই কাউন্টারে গিয়ে বললেন, কালকে পারো যাচ্ছি না আমরা। এখানেই থাকছি আরো একদিন।

পরদিন সাড়ে সাতটায় ডাইনিং এ হাজিরা দিলাম। দোচুলা যাবো আজকে। ড্রাইভার বলে রেখেছে সাড়ে সাতটায় তৈরী হয়ে থাকতে। দেরী হলে হিমালয় দেখা যাবে না। বেলা বাড়তে বাড়তে মেঘ এসে ঢেকে দেবে। আমরা জানি রোদ উঠলে কুয়াশা মেঘ সরে দিন আরো স্পষ্ট হয়, কিন্তু এই লোক বলে উল্টা। ব্যাপার কি। তবু তার কথামতো সাড়ে সাতটায় ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি এখনো কেউ জাগেনি। ওদের রেস্তোঁরা কিচেন খোলে আটটার পর। আমরা আগের রাতে বলে রাখাতে হোটেল মালিক মালিক দীপক গুরুং নিজে এসে আমাদের জন্য টোস্ট জেলী অমলেট কফি ইত্যাদি বানিয়ে দিলো। আমাদের দেশে এরকম সার্ভিস কষ্ট কল্পনা। খেতে খেতে দেখি উগেন এসে গেছে। মুখে সারল্যমাখানো হাসি। এত নিরীহ গোবেচারা লোকের বন্ধু হতে পারে কোন ইমিগ্রেশান অফিসার ভাবতেও কেমন লাগে।

নীচে নেমে দেখি গাড়ীর সামনের সীটে ভুটানী পোষাক পরা একজন বসা। উগেন জানালো এই সেই বন্ধু, সেও আমাদের সাথে দোচুলা চেকপোষ্ট পর্যন্ত যাবে, ওখানেই তার ডিউটি। আমাদের গেট পার করে দেবে নিজ দায়িত্বে। চমৎকার একটা ভ্রমন। রাস্তা শহর ছেড়ে অরণ্যের দিকে চললো। যেদিকে তাকাই সবুজে সবুজ পাইনের অরণ্য। কিছু পর পর আপেল বাগান। আপেলের সিজন শেষ। কেবল গাছগুলো ঝাকড়া পাতা মাথায় নিয়ে দাড়িয়ে। পথে যেতে ইমিগ্রেশান অফিসার কেমবোর সাথে আলাপ জমে গেল। ভালো ইংরেজী পারে কেমবো। ভুটানের সংস্কৃতি, রাজনীতি, জীবনযাত্রা, ভারত নেপালের সাথে সম্পর্ক, বাংলাদেশের সাথে ভুটানের বন্ধুতা, ইত্যাদি নিয়ে নানান আলাপ। নেপালী শরনার্থী সমস্যা কিভাবে সৃষ্টি হলো, এটা নিয়ে কৌতুহল ছিল আমার, পঠিত জ্ঞানের পাশাপাশি প্রত্যক্ষ জ্ঞানও লাভ হলো।

বেশ কিছুদুর যাবার পর যেখানে লোকালয়ের কোন চিহ্ন নেই, কিছু জায়গা দেখে মনে হচ্ছিল কাপ্তাইয়ের মতো। কাপ্তাই শিলছড়ি বাজার ফেলে সামনের দিকে গেলে পাহাড়ের রং কেমন নীলাভ হয়ে যায়। সকালের দৃশ্যটার সাথে খুব মিল। তবে এখানকার পাহাড়গুলো অনেক বেশী উঁচু। আমাদের কর্নফুলী অনেক বেশী গভীর পাশের নদীটা থেকে। চেকপোষ্টে আমাদের পাসপোর্ট জমা নিয়ে ছেড়ে দিল কেমবো। বললো, যাবার পথে পাসপোর্ট ফেরত নিয়ে যেতে।

গাড়ি চলছে মসৃন গতিতে। উগেনের দক্ষতার প্রতি বিশ্বাস রেখে কখন যে ঘুম চলে এসেছে। জেগে দেখি গাড়িটা একটা সমতল চাতালের মতো জায়গায় এসে দাড়িয়েছে। সামনে আরো কটা গাড়ি দাড়ানো। উগেনকে বললাম, ব্যাপার কি, সমতলে নেমে আসছো নাকি। উগেন ইশারা দিয়ে সামনের দিকে তাকাতে বললো। আরে? ওদিকে তো আর কিছু নাই। ধূধূ শূণ্যতা শেষে দিগন্ত দেখা যাচ্ছে মেঘের আভাস। সেই মেঘের উপর দিয়ে তিনকোন একটা বরফের টুকরো উঁকি দিয়ে আছে। গাড়ি থেকে নেমে ক্যামেরার গুল্লি চালানো শুরু করলাম। সুপার ডুপার জুম দিয়ে যতদুর কাছে আনা যায় ওই তিনকোনাকে। অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি এখানে। গত দুদিনের দেখা ভুটানের চেয়ে এই দৃশ্যটার পার্থক্য অনেক। যেখানে দাড়িয়ে আছি ওটা দশহাজার ফুট উচু। সামনের পাহাড়গুলোকে অনেক নীচু মনে হচ্ছে। মেঘ জমে আছে পাহাড়গুলোর উপর। আমরা সেই মেঘেরও উপরে এখন। আর আমাদের অনেক উঁচুতে ওই হিমালয়ের চুড়া।

...............আর এইখানে আসিয়া আমি বাক হারাইলাম।



..................
..................

..................
..................



..................
..................



..................
..................

No comments: