Thursday, July 29, 2010

ছৈয়দ্দা

ছৈয়দ্দাকে প্রথম যখন দেখি তখন সে তীব্র কন্ঠে কারো মায়ের সাথে সম্পর্কস্থাপন সংক্রান্ত গালিবর্ষন করছিল।

একটা মানুষ এক নাগাড়ে কতক্ষন গালির ঝড় তুলতে পারে সেটা ছৈয়দ্দাকে না দেখলে কখনোই জানা হতো না। এবং তার মুখ নিসৃত শব্দগুলোকে নেহায়েত গালি না বলে গালিঝড় কিংবা গালিটর্নেডো বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রথমে শুনতে কানে তালা দিতে হলেও কিছুদিন পর দেখা গেল ছৈয়দ্দার গালি না শুনলে মনে হতো কোথাও কোন ভজঘট লেগেছে, মানে দিনটা ঠিক নেই।

নতুন এলাকায় নতুন বাড়ীতে উঠেছি। বিশাল প্রান্তরের মাঝে একটুকরো জমিতে ছোট্ট একটা বাড়ী। দুর থেকে বাংলো মনে হলেও ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায় একটা সাদামাঠা মধ্যবিত্ত পরিবারের বসতঘর সেটি। শহরের মধ্যে অবস্থিতি হয়েও বাড়ীর চারপাশে এখনো জলজ্যান্ত গ্রাম। পেছনের ধানক্ষেতটি পশ্চিম দিকে যেতে যেতে প্রায় দিগন্ত ছুঁয়ে গেছে। বাড়ীর পাশ দিয়ে পুবদিকে যে মাটির রাস্তা চলে গেছে সেটা বেয়ে কয়েকশো গজ হাঁটলে নিকটস্থ প্রতিবেশী নুরুল আবসার সাহেবের বাড়ীটা পড়বে।

সেই বাড়ীর সামনে একটা পুকুর। মাটির রাস্তাটা পুকুরের পাড় ঘেসে চলে গেছে। মাটির রাস্তার ডান দিকে একটা গোবরগন্ধী গোয়াল দেখা যাবে। গোয়ালের লাগোয়া বেড়ার তৈরী একটা ঝুপড়ি ঘর। ঝুপড়ির চালে লাউয়ে সবুজ লতা ছেয়ে আছে, পাশে কয়েকটা কলা গাছ।

সেই গোয়াল, কলাগাছ আর ঝুপড়ির অস্থায়ী মালিক ছৈয়দ্দা এবং স্থায়ী মালিক সরকার। এটি রাস্তার জন্য অধিগ্রহন করা জায়গা। যদ্দিন রাস্তা হচ্ছে না তদ্দিন ছৈয়দ্দা দখলসুত্রে বসবাস করবে। পেশায় ছৈয়দ্দা একজন চাষা। এলাকায় জমি বর্গা নিয়ে চাষবাস করার জন্য সুদুর বাঁশখালী থেকে এখানে এসে ঢেরা বেঁধেছে।

গালিগালাজ শুনতে যতই খারাপ লাগুক আমাদের স্বীকার করতেই হয় যে গালিবর্ষনে সে কড়া সাম্যবাদী। গালিগালাজে তার কোন শ্রেনীভেদ নাই। প্রতিবেশী নুরুল আবসার সাহেবকে যে ভাষায় গালি দেবে, তার গোয়ালের অলস বলদকেও সে ভাষায়, আবার নিজের ছেলেকেও একই ভাষায় গালি। তার এই সাম্যবাদ নীতি প্রশংসার দাবীদার হতে পারে কিনা জানি না, কিন্তু আমাদের জন্য ছিল আতংকের।

আমাদের কানে সবচেয়ে বেশী পীড়া দিতো যখন গালিটা আবসার সাহেবের উদ্দেশ্যে বর্ষিত হতো। আবসার সাহেব সমাজে আমাদের শ্রেনীর লোক হওয়াতে ভয় ছিল - না জানি আমরাও কোনদিন ছৈয়দ্দার গালির লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়ি। তার গালির প্রতিবাদ করার মতো দুঃসাহস পাড়ার কারো ছিল না। পুলিশে কেস করারও কোন আইন নাই।

যেই প্রতিবাদ করবে ছৈয়দ্দা তার মায়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে মুহূর্তও দ্বিধা করবে না এবং সেই আওয়াজ অন্তত আধমাইল দুরে গিয়ে পৌঁছাবে। এরকম নিরুপদ্রপ গালিবর্ষনের সুযোগ থাকার ফলে ছৈয়দ্দার গালিঝড় সূর্যোদয়ের মতো প্রতিদিনের অপরিহার্য অংশ হয়ে থাকে।



কিছুদিন পর খেয়াল করলাম ভদ্রলোকদের মধ্যে আবসার সাহেবই সবচেয়ে বেশী গালি খায়। আর কেউ ততটা না। ব্যাপার কি? একদিন কৌতুহলী হয়ে ছৈয়দ্দার সাথে খাতিরা আলাপ জমালাম। আকড়া মাকড়া অনেক আলাপ হলো গরু-গাধা-চাষবাস বিষয়ে। এক সময়ে আবসার সাহেবের সম্পর্কে তার মতামত চাইলাম। ছৈয়দ্দা যা বললো তার ভদ্র ভাষার সারমর্ম হলো-

আবসার সাহেব লোক খারাপ না। ভদ্রলোক একটা নামকরা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নিজের গাড়ী বাড়ী সামাজিক অবস্থান সবই আছে। তবে মানুষটা "লোয়া-কিপটা"(লৌহ কঠিন কঞ্জুস)। ছৈয়দ্দার সাম্প্রতিক মেজাজ খারাপ করার কারণ ঘটেছে আবসার সাহেবের ভাড়াটে বাড়ীটা।

আবসার সাহেবের দুটো বাড়ী। একটা বাড়ীতে নিজে থাকেন, আরেকটা বাড়ী ভাড়ায় দিয়েছেন। বাড়ী ভাড়া দেন ঠিকই কিন্তু টু-লেট সাইনবোর্ড লাগাতে রাজী না তিনি। এই সাইনবোর্ড বানাতে কয়টাকা খরচ হয়। কিন্তু আবসার সাহেবের কথা হলো, খামাকা পয়সা নষ্ট করে লাভ কি। তিনি বাড়ীর বাইরের দেয়ালে একটা ভাঙা ইট দিয়ে মোটা মোটা করে টেনে টেনে লিখে দিলেন -TO-LET.

ওটা লেখার পর থেকে ছৈয়দ্দার মেজাজ গরম।

জিজ্ঞেস করলাম টু-লেট সাইনবোর্ড না দেয়াতে তোমার সমস্যা কোথায়? বাড়ী হলো আবসার সাহেবের। তার যেরকম খুশী সেরকম পদ্ধতিতে ভাড়াটিয়া যোগাড় করুক।

ছৈয়দ্দা বলে, "আরে বদ্দা, তুঁই কি বুঝিবা, আঁরা বাশখাইল্যা মানুষ, হইলজা বড় দইজ্জার লান। ইতে কনজুইসর বাইচ্চা আঁরার জাতর বেইজ্জতি গইজ্জি। মাইনসে ইডা মার্কা লেখা দেখি আঁরে হয়দে- অডা বাইনচোত, তোরা বাঁশখাইল্লা হাইচ্ছোত ইডা মারি হোচ্চত।"
(মানে তুমি বুঝবা না, আমরা বাশখালীর মানুষ বড় ইজ্জতের মানুষ, কিন্তু এই ইট দিয়ে লেখা টু-লেট দেখে রাস্তার লোক বাঁশখালীর লোকের কিপটামির বদনাম করে যাচ্ছে, যা আমাকে হরদম শুনতে হচ্ছে প্রতিবেশী হওয়ার কারণে। আবসার সাহেব বাঁশখালীর লোক)।

এইটুকু শোনার পর আলাপ আর এগোয় না। ইজ্জত নিয়েই যখন ফ্যাসাদ, তখন ছৈয়দ্দার সাথে তর্ক করে নিজের ইজ্জতকে রিস্কে ফেলে দেবার চেয়ে তাকে ফ্লোর ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে যাওয়াই উত্তম। তাই করলাম।

No comments: