Wednesday, November 25, 2009

সুশীল বেয়াদবী

সবাই সুশীল হতে পারে না। একবার না পারিলে শতবার চেষ্টা করেও কেউ কেউ পুরোপুরি সুশীল হয় না। সুশীল হতে হলে জীনের সাহায্য লাগে। মানে জেনেটিক্যালি হয়ে আসতে হয়। ট্রেনিং, শিক্ষাদীক্ষা ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি নিয়ে কেউ সুশীল হতে পারে না। আমি ভদ্রসমাজে সুশীল ভান করে থাকি ঠিকই। কিন্তু রাস্তায় মেজাজ খারাপ হলে মুখ দিয়ে যা বের হয় তার সাথে সুশীলতা মেলানো যায় না। বিপরীত দিকে বখে যাবার জন্যও যোগ্যতা লাগে। আমি বাল্যকালে অতীব বখা ছেলেদের সাথে বেশ কিছুকাল কাটিয়েছি। ভেবেছিলাম বখেই যাবো। কিন্তু সম্ভাবনায় গুড়ে বালি। বখাও হলো না আমার।

ওদিকে সুশীলদের সাথে বসবাস করেও ঠিক খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝেই দড়ি ছেঁড়া হয়ে যেতাম। তারুন্যের শুরুতে আমার কয়েকজন সুশীল বন্ধুবান্ধবকে দেখে সুশীলতার দীক্ষা নিতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুকাল। সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে মেলামেশা হতো নিয়মিত। পাড়ায় কবি বন্ধু ছিল একজন। তার সাথে ঘুরে ঘুরে কবি সমাজে সমঝদারের খাতির পেতে লাগলাম। কবিতার ক-ও বুঝি না, কিন্তু না বুঝেও কা কা করলেও দেখি কবি সমাজ মারহাবা মারহাবা করে খুশী হয়। কোন কোন আড্ডায় কেউ কেউ আনকোড়া কবিতা পড়তে দিয়ে মতামতও চায়। আমি চোখ আধবোঝা করে উচ্চমার্গীয়তার ভান করি। কবি খুশী হয়। ভাগ্যিস 'কি বুঝিয়াছো বৎস' বলেনি, বললে রাম ধরা। আসলে সেই সময়টাতে প্রচুর বই পড়তাম ঠিকই কিন্তু উত্তরাধুনিক বা পরাবাস্তব কবিতা জিনিসটা আমার মাথার উপর দিয়েই যেতো। কিন্তু যাদের সাথে মিশতাম তারা সবাই উত্তরাধুনিক পরাবাস্তব কবিতাই লিখতো। তাই কষ্টের দিন যেতো যেদিন কয়েকজন কবি একসাথে নতুন কবিতা লিখে আনতো।

একদিন আমার এই সুশীল হবার খবর সংবাদ পৌছে গেল পাড়ার এক নবীন দার্শনিক কবির কানে। আমার ধারনাই ছিল না ছোকরা কবিতা লেখে। এক দুপুরে তার মোটা কবিতার খাতাটা আমার হাতে দিয়ে বললো, ভাইয়া আপনি একটু দেখে দেবেন পত্রিকায় পাঠানোর জন্য কোন কোন কবিতা দেয়া যায়। বুঝলাম উৎপাত শুরু হলো মাত্র। কারন ছেলেটা লাসা প্রকৃতির, বাজারে মাছঅলার সাথে কিংবা পথে রিকশাওয়ালার সাথে কি হয়েছে তা নিয়ে আধাঘন্টা বকবক করতে পারে। কী উৎপাতের কথা। এমনিতেই উত্তরাধুনিক কবিদের যন্ত্রনায় সুশীল আড্ডা ছাড়ি ছাড়ি অবস্থা। এদিকে ঘরেই কবিতা দিয়ে যাচ্ছে আরেকজন। সুশীল হবার যন্ত্রনা তো কম না?

তবু আমি কবিতার খাতাটা নিয়ে রেখে দিলাম গম্ভীর হয়ে। কবির নাম তৈয়ব। ভাগিয়ে দেবার কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। কারন তৈয়ব আমার খুব ভক্ত। ভক্তকে নিরাশ করবো তেমন নিষ্ঠুর কি করে হই। তবু উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য কদিনের জন্য তাকে দুরে রাখতে হবে। আমার অন্য কাজে ব্যাঘাত হচ্ছিল। কয়েকজন কট্টর লেখকের দাঁতভাঙা কয়েকটা বই ছিল আমার কাছে। ফরহাদ মজহার, আবুল কাশেম ফজলুল হক ইত্যাদি লেখকের তাত্ত্বিক বই। ওই বইগুলো আমার বদহজম হচ্ছিল তখন। বইগুলো গছানোর একটা উপায় পেয়ে আলোকিত হয়ে উঠলো চেহারা।

একদিন বিকেলে তৈয়ব কবিতার মতামত নিতে আসলে তার হাতে বইগুলো তুলে দিয়ে বললাম- "পড়েছো এ বইগুলো? অসাধারন বই। এগুলো না পড়লে ভালো কবিতা আসবে না। তুমি ওগুলো পড়ে শহীদের কাছে গিয়ে মতামত দিও। আর তোমার কবিতার খাতা ওর কাছে দেয়া আছে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না কবিতা নিয়ে।"

শহীদ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কবি মহলের অন্যতম কবিবর। একদিন কথায় কথায় বলছিল পাড়ায় একটাও শিক্ষিত লোক নেই যে তার কবিতা বোঝে। ভাবলাম নবীন কবি তৈয়বকে আবিষ্কার করে নিশ্চয়ই আনন্দিত হবে সে। পরের সপ্তাহ থেকে কবি তৈয়বের গন্তব্য বদলে গেল শহীদের বাসার দিকে। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম সে যাত্রা।

কয়েকদিন পর শহীদ আমাকে রাস্তায় পাকড়াও করলো। "শালা কী একটা পাগল জুটিয়ে দিয়েছিস, দিনরাত ঘুমাতে পারি না, তার কবিতা নাকি ছাপাতে হবে আমার পত্রিকায়। কিন্তু খাতা খুলে দেখি নামধাম বদলে আস্ত কাজী নজরুল ইসলাম কাট করে মেরে দিয়েছে।"

আমি শিউরে উঠলাম ভেতরে ভেতরে। ভাগ্যিস পড়ি নাই। নইলে বলেই ফেলতাম, কবি আপনি তো মহান। কারন নজরুলের অনেক কবিতা তখনো পড়া হয়নি আমার।

মুখে বললাম, "দোস্ত আমারে মাফ কর। আমি কবিতা পড়া ছেড়ে দিয়েছি, তাই তোর কাছে পাঠিয়েছি। ঝামেলা মনে করলে বিদায় করে দে"

শহীদ ক্ষেপে গিয়ে বলে, "বিদায় করব কি করে, ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিদিন, বেয়াদপের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুকে। আগে আমাকে লুকিয়ে সিগারেট খেতো আর এখন আমাকেই কিনে দিতে চায়। আমি নাকি হারামজাদার কবি বন্ধু এখন। কিসব যন্ত্রনা লেলিয়ে দিয়েছিস তুই!!"

সর্বনাশ! তাই নাকি? আমার তখন মনে পড়লো একদিন নিউমার্কেটের সামনে দেখা হলে তৈয়ব আমাকে বারবার জোর করছিল, ভাইয়া আপনাকে সিগারেট কিনে দেই, একটা খান।

বলেছিলাম, "আমি ভর দুপুরে সিগারেট খাই না।" শুনে খুব বেজার হয়েছিল তৈয়ব।

তাহলে এই মতলব? ভাগ্যিস খাইনি। শালা বেয়াদবীর আর্ট জানে। কোনদিন আমাকে গলায় জড়িয়ে ধরে বলতো, আয় দোস গাঁজা টানি এক সাথে। এ যে সুশীল বেয়াদপ! এর পর থেকে আমি তৈয়বের ছায়াও মাড়াই না। বাসায় বলা আছে তৈয়বকে দেখামাত্র যেন বলা হয় - "বাড়ীতে নেই আমি, চলে গেছি মার্কেটে।"

No comments: