Saturday, May 4, 2024

রাজু ও মীনার গল্প বনাম বাংলাদেশের আইসিটি শিক্ষার ভুল প্রয়োগ


এটা একটা বাচ্চা ছেলের কাজ। ইন্টারনেট স্পীড চেক করার একটা টুল। বানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া এক কিশোর। ধরা যাক ছেলেটার নাম রাজু। একটা অ্যামেচার প্রোগ্রামার সাইটে টপ-১০ হতে পেরেছে বলে খুশি হয়ে আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু বাইরের কাউকে জানানো বারণ। আমি তবু ওকে আড়াল করে পোস্ট করছি। কারণটা পরের অংশে আসবে। আমি জানি এগুলো তার স্কুলের পড়াশোনার অংশ নয়। শখের কাজ। নিজের আনন্দের জন্য করা। কিন্তু বড় হয়ে ওসব নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে।
রাজুর এসবে খুব আগ্রহ থাকলেও তার বোন মীনা একদম বিপরীত। সে এসব কাজে মোটেও আগ্রহী না। মীনা পড়ে একাদশ শ্রেণীতে। বাণিজ্য বিভাগে। তার আগ্রহ শিল্প সংস্কৃতি। সে ছবি আঁকে, গান গায়। তবে মুশকিল হলো অন্যান্য বিষয়ের সাথে তাকে আইসিটি নামক একটা বিষয় পড়তে হয়। তার শিক্ষা কিংবা ভবিষ্যত ক্যারিয়ার কোনটার সাথে এই বিষয়ের সম্পর্ক নেই। তবু তাকে ওই ঢেকি গিলতে হচ্ছে দিনের পর দিন। কারণ সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বিষয়টি। ওটার জন্য কোচিং লাগে, টিচার লাগে, অনেক সময়ও লাগে। ছোটাছুটি করে সে মোটামুটি গলদঘর্ম। কিন্তু উপায় নেই। নইলে নইলে পরীক্ষা খারাপ হবে। জিপিএ ফাইভের যুগ এটা।
আমি আইসিটির লোক না হলেও একজন প্রযুক্তিবান্ধব মানুষ। পেশাগত কারণে গত পঁচিশ বছর ধরে আইসিটি সেক্টরের সাথে নানাভাবে কাজ করছি। ফলে আমি মীনাদের আইসিটি সিলেবাসটা দেখে খুব অবাক হয়েছি। আমি ভাল করে জানি এই বিষয়টা সাধারণ ক্যারিয়ারের ছাত্রছাত্রীদের কোন কাজে আসবে না। যারা কম্পিউটার বিজ্ঞান কিংবা ওই সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবে তাদের জন্যই দরকার।
তবু বাংলাদেশে আইসিটি বিষয়ে এমন সব অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে যেগুলো কেবলমাত্র কম্পিউটার বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। এই বিষয়টা এত কড়াকড়িভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কেন? এদেশের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে আইসিটিতে বিশেষজ্ঞ হতে হবে? প্রোগ্রামিং জানতে হবে?
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক বিষয় থাকে পড়ার। একটা দেশে হাজারো পেশার মানুষ থাকে। এত পেশার মধ্যে কয়টা পেশায় ওই বিদ্যা কাজে লাগবে? কম্পিউটার সায়েন্স বাদে আর কোন বিষয়ের ছাত্রছাত্রীর কী এই বিদ্যা কাজে লাগবে?
তবু কেন দেশের কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর অনিচ্ছুক মাথার ভেতরে জোর করে আইসিটির নামে অপ্রয়োজনীয় কিছু সিলেবাস গিলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে? সাধারণ কম্পিউটার চালানোর জন্য বেসিক কিছু প্রোগ্রাম বাদে আর কিছুই দরকার নেই। যারা কম্পিউটার নিয়ে বিশেষ কিছু শিখতে চায় তারা নিজের আগ্রহে শিখবে। যেমন রাজু শিখেছে, আরো হাজার হাজার রাজু আছে বাংলাদেশে। কেউ প্রোগ্রামিং, কেউ গ্রাফিক্সে, কেউ ডেটাবেস, কেউ নেটওয়ার্কিং, যার যেটা পছন্দ সেটা বেছে নিবে। এ জন্য বিজ্ঞানের ছাত্র ছাড়াও বাণিজ্য, মানবিক সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীকে এক যোগে জাভা, এইচটিএমল,সিএসএস, সি প্লাস প্লাস, এলগরিদম, নেটওয়ার্কিং শিখতে হবে? সবগুলার কাজ কী একই? অদ্ভুত এই নীতি। যারা শিক্ষানীতি তৈরি করেন, তাদের মাথায় কী এসব জিনিস আসে না?
আমি গত বছর নতুন কারিকুলাম নিয়ে অনেক সমালোচনা দেখেছি। স্কুলের ক্লাসে ডিমভাজি আর আলুভর্তা শিক্ষা নিয়ে প্রচুর হাসাহাসি হয়েছে। আমার মনে হয় সব মানুষের জীবনে কোন না কোন সময়ে ডিমভাজির শিক্ষাটা কাজে লাগবে। কিন্তু ৯৯% মানুষের জীবনে একবারও এসব প্রোগ্রামিং শিক্ষা কোন কাজে আসবে না। অথচ ডিমভাজি নিয়ে অভিভাবকদের যেরকম সরব হতে দেখেছি আইসিটি নিয়ে কোন কথা বলতে শুনি না। আমার মতে আইসিটি ডিমভাজির চেয়েও অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয়।
আইসিটির মতো বিষয় থাকবে ঐচ্ছিক। ওটা এক্সট্রা কারিকুলামের অংশ। যার ভালো লাগবে সে শিখবে, পড়বে, ক্যারিয়ার গড়বে। কিন্তু আপনারা সারা দেশের সব মানুষকে রাজু বানিয়ে ফেলতে চাইছেন জোর করে। অথচ দেশে রাজু বানাবার মতো কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেটা ভেবেছেন? তাছাড়া দেশে কী শুধু রাজু তৈরি হবে? মীনাদের কোন দরকার নেই? যে ছাত্র/ছাত্রী ওই বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়, তাকে কেন অপ্রয়োজনীয় একটা শিক্ষা জোর করে গিলিয়ে খাওয়াতে হবে?


 

No comments: