Saturday, March 30, 2024

পাঠ প্রতিক্রিয়া- নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি

 



লিখেছেন - জালাল আহমেদ
২৯ মার্চ ২০২৪

সাধারন জ্ঞানের মুখস্ত বিদ্যায় একটি প্রশ্ন ছিল অবশ্যম্ভাবী, নিষিদ্ধ নগরী কোনটি? কখনো নিষিদ্ধ দেশ কোনটি? উত্তর প্রায় সবারই জানা ছিল, লাসা, তিব্বতের রাজধানী আর দেশ ছিল তিব্বত। তিব্বত চীনের অংশ আবার চীনের অংশ নয় এই নিয়ে বিতর্কও দীর্ঘদিনের। তবে স্মরণাতীত কাল থেকেই তিব্বত ছিল স্বতন্ত্র এক দেশ। আর চতুর্দশ শতক থেকে তিব্বত শাসন করতো তাঁদের ধর্মগুরু দালাই লামা। পঞ্চম দালাই লামা, দ্য গ্রেট ফিফথ লবসাং গিয়াতসো সপ্তদশ শতকের শুরুতে এক ভবিষ্যৎবানী করেন যে বিদেশীদের হাতে তিব্বত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মূলতঃ তারপর থেকেই তিব্বত বিদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা হয়ে যায়।

ঔপনিবেশিক যুগের শুরুতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চেষ্টা ছিল ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলার বিভিন্ন জেলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। ১৭৭২ সালে জেলাসমূহে প্রথম দফা কালেক্টর নিয়োগের সময় তাদের দায়িত্ব ছিল তাদের অধীনস্থ এলাকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ও কলকাতায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করা। বাংলার সংগে তিব্বতের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্ম যেমন প্রবর্তন করেছেন পদ্মসম্ভব বা রিনপোচে তেমনই তার সমন্বিত রূপ দিয়েছেন বাংগালী পন্ডিত অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান। তিব্বতীয় সাধুদের গুরু ছিলেন ভারতীয় সিদ্ধাচার্যগন। একইসংগে ছিল গিরিপথ বেয়ে বানিজ্যক সম্পর্ক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চাইলো এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে তাই গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৪ সালে তিব্বতে প্রথম দূত প্রেরন করেন জর্জ বোগলেকে। এরপরেও একাধিক বানিজ্যিক বা তথ্যানুসন্ধানী মিশন তিব্বতে যায়। এমন কি ১৮১৫ সালের দিকে রংপুরে কালেক্টরেটে দেওয়ান পদে কাজ করার সময় রাজা রামমোহন রায়ও একটি মিশনের অংশ হিসেবে তিব্বতে গিয়েছিলেন।

কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে অবস্থা পালটে যায়। মধ্য এশিয়া জুড়ে শুরু হয় গ্রেট বৃটেন-রাশিয়ার মধ্যে দ্য গ্রেট গেম। ফলে তিব্বতের উপর দিয়ে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ বৃটিশ সরকারের অগ্রাধিকারে পরিনত হয়। লাদাখ দিয়ে যেমন একের পর এক অভিযান পরিচালিত হয় তেমনই বাংলা থেকেও তথ্য সংগ্রহ অভিযান চলতে থাকে। দার্জিলিং এর এক দরজি কিন্টুপকে পাঠানো হয় এলাকা জরিপ ও ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ অনুসন্ধানে। একইসংগে আমাদের চট্টগ্রামের সন্তান, দার্জিলিং এর ভুটিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরৎচন্দ্র দাসকেও পাঠানো হয় তিব্বতে। ১৮৭৯ সালে ছয়মাসের জন্য ও ১৮৮১ সালে চৌদ্দমাসের জন্য শরৎচন্দ্র দাসের তিব্বতবাসের মাধ্যমে ইংরেজ সরকার প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে এবং কলকাতার সরকারি প্রেস থেকে ‘গোপনীয়’ লেবেল দিয়ে এই বিবরনীর নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করে। ১৮৭৯ সালের ভ্রমনের বিবরণ পঁচিশ কপি “ন্যারেটিভ অফ এ জার্নি টু তাশিলহুনপো ইন ১৮৭৯” নামে ১৮৮১ সালে ছাপা হয়। ১৮৮১ সালের দ্বিতীয় ভ্রমনের বিবরণ ১৮৮৫ সালে “ন্যারেটিভ অফ এ জার্নি টু লাসা ইন ১৮৮১-৮২” ছাপা হয় ১৮৮৫ সালে ১০০ কপি। তবে আমার ধারনা তাঁর এই দুই অভিযানের বিস্তারিত মূল বিবরন এখনো ভারতীয় জাতীয় আর্কাইভ বা ব্রিটিশ লাইব্রেরীর কোন বাকসে পরে আছে। প্রকাশিত এই দুটি ভ্রমন বিবরনী র অনুবাদ ইতোপূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমি পড়েছিও কিন্তু যখন মূল ইংরেজির সংগে মিলিয়ে পড়তে গিয়েছি তখনই হোঁচট খেয়েছি। মূল থেকে বিচ্যুতি ও সংক্ষেপিত করার কারনে মূল লেখার রস অনুবাদে পাইনি। আমার অন্যতম প্রিয় লেখক Parimal Bhattacharya তাঁর “শাংগ্রিলার খোঁজে” বইতে শরৎচন্দ্র দাসের ভ্রমনের যে সরস বর্ণনা দিয়েছেন তাতেও সাধ মিটছিলো না।

এইক্ষেত্রে চমকে দিলেন "উপনিবেশ চট্টগ্রাম: ৫০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস" এর লেখক, শক্তিশালী অনুবাদক Haroon Rashid । মূল লেখার স্বাদ অক্ষুন্ন রেখে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ অনুবাদ করেছেন শরৎচন্দ্র দাসের এই দুই ভ্রমন বিবরনী। অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এই বিবরণ যেন প্রান পেয়েছে হারুন রশীদ এর দক্ষ অনুবাদে। শরৎচন্দ্র দাস এক বিশাল স্থায়ী অবদান রেখে গিয়েছিলেন টিবেটান-ইংলিশ ডিকশনারীর প্রনেতা হিসেবে। আর অন্যদিকে তাঁর দুই ভ্রমনে প্রাপ্ত তথ্য ইংরেজ সরকার ব্যবহার করেছিলো ১৯০৪ সালে কর্নেল ইয়ংহাজব্যান্ড এর সশস্ত্র তিব্বত অভিযানে। লেখক হারুন রশীদকে ধন্যবাদ এই মূল্যবান বই দুটো দুই মলাটের ভেতর স্বাদু গদ্যে মূলানুগ অনুবাদে আমাদের সামনে হাজির করার জন্য। টি এইচ লিউইন এর “এ ফ্লাই অন দ্য হুইল” এর অনুবাদের পর বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যে এটি আরেকটি মূল্যবান সংযোজন। তিনি যে বিষয়ে আগ্রহী সে বিষয়ে আরও অনেক মূল্যবান রচনা অনুবাদের অপেক্ষায়। আমরাও অপেক্ষায় থাকবো পরবর্তী চমকের জন্য।

***** ****** ******

লিখেছেন - মনিরুল ইসলাম
১০ মার্চ ২০২৪
শরৎচন্দ্র দাস তবে ঠিক কী? পণ্ডিত? রোমাঞ্চকর দুর্গম পথের অভিযাত্রী? না কি ব্রিটিশের বেতনভুক গুপ্তচর? প্রশ্ন গুলো তুলেছেন আনন্দবাজার পত্রিকার পর্জন্য সেন। এগুলো হয়তো গভীর গবেষণার বিষয়।কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে সে আমার কাছে দুর্গম পথের অভিযাত্রী। শরৎ চন্দ্র দাসের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে পরিমল ভট্রাচার্যের ‘শাংগ্রিলার খোঁজে’ বইয়ের মাধ্যমে। বিস্ময়ের শুরু তখন থেকেই !এরপর যখন জানতে পাড়ি এই পণ্ডিত অভিযাত্রী আসলে চট্টগ্রামের আলমপুর গ্রামের লোক। তখন আগ্রহের জোয়ার এসে চিন্তার দুকূল ভাসিয়ে দিলো।শরৎচন্দ্র দাশ দুবার তিব্বত অভিযান করেছিলেন। প্রথমবার ১৮৭৯ সালে ছ'মাসের জন্য এবং দ্বিতীয়বার ১৮৮১ সালে। কেবল অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান অর্জন নয়, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে শরৎচন্দ্রের দুই দফা তিব্বত অভিযান বিশেষ গুরুত্ববাহী। ১৮৭৯ সালের ১৭ জুন উগ্যেন গিয়াৎসুর সঙ্গে শুরু হয় তিব্বতের দুর্গম পথে অভিযান। সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন একজন গাইড ও একজন কুলি। সঙ্গে নিয়েছিলেন জরিপকাজ চালানোর জন্য সেক্সট্যান্ট ক্যামেরা, প্রিজম্যাটিক কম্পাস, হিপসোমিটার, থার্মোমিটার ও ফিল্ড গ্লাস। দিনলিপির আকারে লেখা সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা পড়তে পড়তে মনের অজান্তে নিজেও সেই অভিযাত্রায় সামিল হয়ে যাই।
‘ আ জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্ট্রাল টিবেট’ থেকে অনুবাদ করে দেবাংশু দাশগুপ্ত লিখেন ‘তিব্বতে দু’বার’।যদিও নাম ‘তিব্বতে দু’বার’ হলেও বইটি মূলত ১৮৮১ অভিযাত্রার উপরে রচিত।সে হিসেবে হারুন রশিদ রচিত ‘ শরচ্চন্দ্র দাস-নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি’ দুটি অভিযান নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা বই’।যদিও বইটি শুধু শরৎ চন্দ্র দাসের দুইটি বিবরণই নয়, আলোচনা করা হয়েছে তার জীবনের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিয়েও।শরৎ চন্দ্র ও তার অভিযান এবং তিব্বত ও তার ইতিহাস জানার জন্য এর চেয়ে ভালো বই আর হতে পারে না।

No comments: