Saturday, March 30, 2024

পাঠকের আলাপ- নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি

 



লিখেছেন- আবদুল কায়েম(ফেসবুক পোস্ট)
২৪ আগষ্ট ২০২৫
১৮৪৯ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ধলঘাট ইউনিয়নের আলামপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া এক দুঃসাহসিক বাঙালি শরচ্চন্দ্র দাস নামক ছেলেটি ১৮৭৯ সালে গোপন ব্রিটিশ পরিকল্পনায় এক মিশন নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলো তিব্বতে। যা খুব কম মানুষই জানে এবং কী শরচ্চন্দ্রের জন্মস্থানের মানুষও এই খবরটি জানে না এখনো অনেকে। বেশির ভাগ লোক তার নামও জানে না। তার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে বলতে হবে রাজদূতের বাড়ি যেতে চাই কারণ তার পূর্বপুরুষের সেই ভিটা এখন রাজদূতের বাড়ি নামে পরিচিত, আর শরচ্চন্দ্র দাসই ছিলেন সোয়া শতক আগের ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট রাজদূত।

সময়টা তখন ১৮৭৪ সাল, ছোটো ভাইয়েরই জোড়াজুড়িতে শরচ্চন্দ্র দাস শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন দার্জিলিং শহরের ভুটিয়া বোডিং স্কুলে। এই স্কুলে এসেই তিব্বতি নানান জনের পরিচয় আর তিব্বত সম্পর্কে বই পড়ে তার আগ্রহ জন্মে তিব্বত ভ্রমণে যাওয়ার। কিন্তু তিব্বত ভ্রমণের জন্য ব্রিটিশ সরকারের অনুমতির জন্য গেলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের থাংলিয়ানা নামে খ্যাত ডেপুটি কমিশনার থমাস হার্বার্ট লুইন বেশ তাচ্ছিল্য করেই তাকে অপমান করে।

অবশ্য সেই অপমান তাকে সরাতে পারেনি তিব্বত ভ্রমণ থেকে, ১৮৭৯ সালের ২২শে মে ঠিকই অনুমতি নিয়ে উগেন গিয়াৎসোকে সঙ্গে নিয়ে দূর্গম অঞ্চল পাড়ি দিয়ে তিব্বতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় শরচ্চন্দ্র দাস। যার প্রথম সফরটি হয় তিব্বতের তাশিলুম্পোতে। যার যাত্রা থেকে আবার দার্জিলিং এ ফিরে আসার আগ পর্যন্ত প্রতিটি বর্ণনা শরচ্চন্দ্র লিখেছেন তার ডায়রির পাতায়, প্রতিটি তারিখের ক্রমান্বয়ে প্রতিটি পদক্ষেপের গল্প।

যেখানে দূর্গম পর্বত পাড়ি দেওয়া থেকে শুরু করে খরস্রোতা নদী পার হওয়া, কখনো তুষারে পা হরকে নিচে পতিত হওয়ার গল্প লিখেছেন বইটিতে। আছে যাত্রা পথের প্রতিটা রাতের গল্প, যে রাতগুলোর কোনোটা কেটেছে গুহায় কিংবা শীতে কাঁপতে কাঁপতে তাবুতে, তো কোনো কোনো রাত কেটেছে পাহাড়ের চূড়া কিংবা পাদদেশের গ্রামের গোয়াল ঘর কিংবা আরামদায়ক রুমে। কখনো কখনো সীমান্ত পার হওয়াটাও ছিলো কঠিন থেকে কঠিনতর, তাই সরাসরি সীমানা অতিক্রম না করে ছুটতো হয়েছে নেপাল হয়ে যাওয়ার জন্য।

সফরটি শরচ্চন্দ্রের জন্যও যেমন আনন্দের ছিলো, ব্রিটিশদের জন্যেও ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশরা শরচ্চন্দ্রকে একজন গুপ্তচর হিসেবেই নিয়োগ করেছিলেন সফরটিকে যা সফল ভাবে শেষ করেন তিনি। যার জন্য তাকে রায়বাহাদুর উপাধি ও সিআইএ পদক দেওয়া হয়েছিলো।

এই সফরের বর্ণনায় বইটিতে যেমন প্রাকৃতিক বর্ণনা পাবেন তার পাশাপাশি এই অঞ্চলের নানান গ্রাম শহরের স্থানকাল ভেদে যে খাবার, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি, মিথসহ নানান উৎসব নিয়ে পরিচয় হবে। শরচ্চন্দ্র দাস তার ডায়রিতে সেই সব বর্ণনাও উপস্থাপন করেছেন।

এই সফরেরই শরচ্চন্দ্রের সাথে পরিচয় হয় মন্ত্রী শেংচেন দোরজেচানের, যিনি বন্ধু হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন শরচ্চন্দ্রকে, বৌদ্ধধর্মে শিক্ষা দীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। তাদের বন্ধুত্ব এতটাই গাঢ় ছিলো যে তারা প্রায়ই গণিত, মহাকাশ সহ বিভিন্ন বিষয়ে মেতে থাকতেন। মন্ত্রী শরচ্চন্দ্রকে উপহার হিসেবে অনেক প্রাচীন তিব্বতি পান্ডুলিপি দিয়েছিলেন, সেই সাথে অনুরোধ করেছিলেন পরের বার যখন তিব্বত আসবেন সাথে প্রিন্টিং মেশিন আনার জন্য। মন্ত্রীর সাথে তার এই পরিচয় সফরটিকে আরো সহজ করে দিয়েছিলো শরচ্চন্দ্রের জন্য। সেই সাথে দরজা খুলে দিয়েছিলো আবারও তিব্বতে আসার।

যার প্রেক্ষিতে শরচ্চন্দ্র দ্বিতীয়বার আবারও তিব্বত সফর করেন সফলভাবে, যে সফরে তিব্বতে গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়ায় বেশ অসুবিধায় পড়তে হলে হয় তাকে। সেই সাথে শরচ্চন্দ্র নিজেই জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ বিপাকেই পড়েন সেবার। অবশ্য অসুখ থেকে সুস্থ লাভ করেই সেইবার তিব্বতের লাসায় মহান দালাই লামার সাথে দেখা করার সুযোগ হয় তার, সাথে দর্শন লাভ করার সুযোগ হয় তিব্বতের বিখ্যাত পোতালা প্রাসাদে ভিতরের। এই সফর থেকেও শরচ্চন্দ্র বেশ ভালো ভাবে ফিরে আসেন দার্জিলিং এ।

বইটি মূলত শরচ্চন্দ্রের সেই দুই দুইবার তিব্বত সফরের বিস্তারিত বর্ণনা স্থান পেয়েছে। যা প্রতিবেদন হিসেবে জমা দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারকে। আর ব্রিটিশ সরকার তা বহুবছর টপ সিক্রেট হিসেবে গোপন রেখেছিলো নিজেদের আর্কাইভে। শরচ্চন্দ্র দাস যে সময়ে তিব্বত সফর করেন সেই সময়ে তিব্বতিরা বিদেশিদের সহ্য করতে পারতো না, তার সাথে চীনা আগ্রাসনের কারণে তাদের মনোভাব আরো কঠিন হয়ে উঠে। আর তাই এই সময়ে শরচ্চন্দ্র দাসের বহিরাগতদের জন্য নিষিদ্ধ তিব্বত ভ্রমণ বেশ দুঃসাহসিকই বলতে হয়। যার রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং প্রাকৃতিক নানান বাঁধা তাকে পেরিয়ে এই সফলতা অর্জন করতে হয়েছিলো।

বইটি আপাদমস্তক একটা ভ্রমণ কাহিনি বলতে পারেন, যেখানে শরচ্চন্দ্রের ভ্রমণ বৃত্তান্তে প্রাকৃতিক পরিবেশের পাশাপাশি, তিব্বতি অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, সাংস্কৃতি, রাজনীতিসহ নানান বিষয় লেখক তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। যার বর্ণনাটা করা হয়েছে অনেকটা তারিখ অনুসারে ডায়রি লেখার মতো করে।

নির্ঝঞ্ঝাট ভ্রমণ কাহিনি যারা পড়তে চান তাদের জন্য বইটি আমার মনে হয় বেশ ভালোই লাগবে। তবে এই গল্পে তিব্বত আপনাকে আগ্রহ তৈরি করতে পারবে কি না আমার সন্দেহ আছে। কারণ এখানে শরচ্চন্দ্র তিবতের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বেশ সাদামাটাই বলতে হবে। আর তাই সব বর্ণনা রোমাঞ্চকর মনে হবে না। তবে মিথ থেকে বের হয়ে বাস্তবের উনিশশতকের তিব্বতকে দেখতে চাইলে বইটি চমৎকার চয়েস হবে।

বইটিতে শরচ্চন্দ্রের সফরের রিপোর্টের অনুবাদের পাশাপাশি তাকে ঘিরে এবং তার তিব্বত সফর পরবর্তী সময়ে তিব্বতের রাজনৈতিক পালাবদল নিয়ে ধারণারও উল্লেখ আছে। এই অংশটা আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছে, যা মনে দাগ কাঁটার মতোই।

বইটি শরচ্চন্দ্রের ব্রিটিশের কাছে তাঁর দুইবারের তিব্বত সফরে জমা দেওয়া প্রতিবেদন থেকে যে কয়টা কপি ইংরেজি ছাপানো হয়েছিলো তা থেকে হারুন রশীদ বইটি অনুবাদ করেছেন সাথে শরচ্চন্দ্র দাস সম্পর্কেও বেশ কিছু তথ্য যুক্ত করেছেন বইটিতে। এক্ষেত্রে হারুন রশীদের কাজটি বেশ চমৎকার লেগেছে আমার, সাথে সব্যসাচী হাজরার বইটির প্রচ্ছদ আমার বেশ আকর্ষণীয় লেগেছে যদিও দামটা বেশ বেশিই বলতে হবে। তবে কেন যেনো মনে হয়েছে এই প্রতিবেদনে অনেক কিছুই উল্লেখ নেই যা গুপ্তচরের দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে শরচ্চন্দ্র ব্রিটিশদের জানিয়েছিলেন।

কেউ নিতান্তই সাদামাটা ভ্রমণ কাহিনি পছন্দ করলে তার জন্য বইটি ভালোই লাগবে। কিন্তু তিব্বত নিয়ে আমরা যে মিথলজিক্যাল কল্পনা করি তার কিছুই বইটিতে পাবেন না। তাই তিব্বতের প্রকৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি এসব বিষয় নিয়ে যদি আপনার আগ্রহ থাকে তাহলে বইটি আশাকরি ভালো লাগবে।
লিখেছেন- সায়হাম সিদ্দিক হৃদয়(ফেসবুক পোস্ট)
১৫ জুলাই ২০২৫
নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি’ বইটি মূলত একজন বাঙালি অভিযাত্রী, গুপ্তচর, এবং পণ্ডিত শরৎচন্দ্র দাস-এর জীবন। ১৯ শতকের শেষভাগে যখন তিব্বত ছিল বাইরের দুনিয়ার জন্য নিষিদ্ধ ও রহস্যময়, তখন এক বাঙালি যুবক ব্রিটিশ সরকারের গোপন সহায়তায় সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে তিব্বতে প্রবেশ করেন। তিনিই হলেন শরৎচন্দ্র দাস। এই বই তারই এক অনন্য জীবনের দলিল বলা যায় ।
শরৎচন্দ্র দাস ছিলেন একজন শিক্ষিত পণ্ডিত এবং হিমালয়ান দার্জেলিং এর স্কুলের প্রধান। ইংরেজদের গোপন মিশনের অংশ হিসেবে তিনি ১৮৭৯ ও ১৮৮১ সালে তিব্বতে দুটি ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে তিনি তিব্বতের রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভূগোল ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে গভীরভাবে গবেষণা করেন এবং তা বিশদভাবে ইংরেজদের কাছে রিপোর্ট আকারে জমা দেন। তিব্বতের রাজধানী লাসা, গ্যাংটক, শিগাস্তে প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমণ করে তিনি হাতে-কলমে সংগ্রহ করেন নানা ধরনের মানচিত্র, শিল্পকর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও লোককাহিনী।
তবে এই অভিযানের আরেকটি গোপন দিক ছিল গুপ্তচরবৃত্তি। ব্রিটিশরা তিব্বতে রুশ প্রভাব ঠেকাতে চাইছিল, আর তার জন্যই দরকার ছিল নির্ভরযোগ্য তথ্য। শরৎচন্দ্র দাস সেই গুপ্তচর গবেষকের ভূমিকা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন। এ বই তাঁর সেই অভিযানকে তুলে ধরে শুধু নথিভুক্ত ইতিহাস নয়, বরং এক বাঙালি জাতির সাহসিকতার এক অবিস্মরণীয় কাহিনি।
সেই সময়ের লাসা কেমন ছিল সেই সময় এই অভিযান কতটা জটিল ছিল বা সেই সময় সিকিম এবং সিকিমের দিকদিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার পাসে দিয়ে জেমু গিরিশিরা ক্রস করে তি্ব্বততে প্রবেশ করেছিলেন।
এই যে মুরগির সিরা ক্রস করে তিব্বতে প্রবেশ করার ব্যাপারটা ঠিক কতটা টেকনিক্যাল এবং কতটা কঠিন এখনো সেটা ওই সাইডে যারা ট্র্যাকিং করেছে বা পর্বতারোহন করেছে তারা খুব ভালো জানে।
সেখানে ১৮৭৯বা ৮০ সালের দিকে সে রাস্তাগুলো ক্রস করা এক বিশাল অভিযান ছিলো নিঃসন্দেহে।

লিখেছেন- শতাব্দী ভট্টাচার্য
২৪ জুন ২০২৪
(বইয়ের হাটের সৌজন্যে)

গুপ্তচর কাহিনী ভালোবাসে না এমন পাঠক পাওয়া দুষ্কর। মাসুদ রানার সাথে স্পাই ইউনিভার্সে হারিয়ে গেছেন কত বাংলাদেশী পাঠক। সেইসব আর এই গুপ্তচর কাহিনী একই না হলেও শরচ্চন্দ্র দাসকে মাসুদ রানার গুরু রাহাত খানেরও গুরু বলা যায়!
কারণ বাঙালি গুপ্তচর হিসেবে তিনি নিষিদ্ধ দেশের উদ্দেশ্যে যে দু:সাহসী অভিযান চালিয়েছিলেন তা বাঙালি হিসেবে গর্বে আধহাত বুক ফুলিয়ে দেয় বৈকি!
হারুন রশীদের প্রাণবন্ত অনুবাদে আমি সম্পূর্ণভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম শরচ্চন্দ্র দাশের এই অভিযানের সাথে৷
তাঁর দার্জিলিং থেকে যাত্রা এবং বহু দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে লাসাতে পৌঁছানো পর্যন্ত আমিও সঙ্গী হয়ে দেখে নিচ্ছিলাম প্রাচীন পাহাড়ী জীবনযাত্রা, চমরি গাই, ইয়াকদের।
খাবারদাবারের বৈচিত্র্য আর জনপদের মানুষের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি অভিভূত করছিল। শরচ্চন্দ্র যথেষ্ট ভাগ্যবান ও ছিলেন কারণ নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে এক পর্যায়ে তিনি যেভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাতে বাড়াবাড়ি কিছু হলে এই ভ্রমণকাহিনীটাই অবশ্য লেখা হয়ে উঠত না।
অচেনা জনপদে একটা আবছা পরিচয়ে ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা ছাড়াও তিনি যে সেরে উঠে কাজটা শেষ করতে পেরেছেন তা নিশ্চয়ই একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
পরবর্তীতে তাঁর এই অভিযান তিব্বতে যাঁরা তাঁর পরিচয় সম্পর্কে না জেনে সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের জীবনে দুর্বিষহ যন্ত্রণা বয়ে আনলেও ব্রিটিশ ভারতের উপরমহল কর্তৃক শরচ্চন্দ্র আদৃতই হয়েছিলেন।
সিক্রেট এজেন্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি আসলে কেবল ঐ উদ্দেশ্যেই লাসা যেতে চাননি৷ তাঁর তিব্বতি ভাষা শেখার আগ্রহ, সেই দেশকে জানার আগ্রহ, দেশটির প্রতি ভালোবাসা এসবও গুরুত্ব রেখেছিল।
যাত্রার ফাঁকে ফাঁকে আমরা পরিচিত হয়েছি সেখানকার জীবনযাত্রার সাথে৷ সেখানে নারীদের একাধিক স্বামী গ্রহণের যে সংস্কৃতি তা উচ্চপদস্থ নারী দ্বারা কিন্তু প্রশংসিত হয়েছিল। ভারতীয়দের তুলনায় নিজেদের উন্নতই মনে করতেন তাঁরা।
শরচ্চন্দ্র এর জন্ম চট্টগ্রামে৷ ছোট ভাই নবীনচন্দ্র কবিগুণাকর। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতা প্রেসিডেন্সিতে সিভিল ইঞ্জিয়ারিং পড়ার সময় ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে দার্জিলিং এ ভুটিয়া শিক্ষক হওয়ার সাদামাটা প্রস্তাবটাই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় তাঁর৷
"দার্জিলিং যাবার কয়েক বছরের মধ্যে তিনি জড়িয়ে পড়েন উনিশ শতকে মধ্য এশিয়ায় বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যেকার দ্য গ্রেট গেমের জালে।" ফ্ল্যাপের লাইনটি হুবহু তুলে দিলাম অভিযানটি গুরুত্ব বোঝাতে৷
শরচ্চন্দ্রকে অনেকেই হয়তো চেনে না তাঁর নিজের শহরেও। তবে রাজদূতের বাড়ি বললে কিন্তু এখনো লোকে বাড়িটা চিনিয়ে দেয়।
পরিমল ভট্টাচার্য এর শাংগ্রিলার খোঁজে বইতে শরচ্চন্দ্র সম্পর্কে অনেকটা জেনেছিলাম৷ এই বই পূর্ণাঙ্গ একটা অনুভূতির স্বাদ দিল।

লিখেছেন - অনিমেষ বসুনীয়া,
৩১ আগষ্ট ২০২৪
একরাশ মুগ্ধতা ও রোমাঞ্চ নিয়ে আপনার "শরচ্চন্দ্র দাস নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি" বইটি শেষ করলাম। পাহাড়ের প্রতি একটা আচ্ছন্ন টান আমি সবসময়ই অনুভব করি। আপনার "থাংলিয়ানা" বইটি পড়া শেষ করার সাথে সাথেই এই বইটি অর্ডার করি এবং আগ্রহ ও বিস্ময়ের সাথে পড়া শুরু করি। বইটিতে পাহাড়ের অজানা প্রকৃতি, দুর্গম গিরিপথ, আসামান্য সৌন্দর্যের বর্ণনা সাথে রহস্য, রোমাঞ্চ এককথায় অসাধারণ লেগেছে। অবাক বিস্ময়ে জানলাম কী অসম্ভব রকমের মানসিক শক্তি ও দুঃসাহস নিয়ে একজন বাঙালি হিমালয় পেরিয়ে নিষিদ্ধ অঞ্চলে গিয়েছেন, সম্মানের সাথে বাস করেছেন যেখানে প্রতি পদে পদে জীবনের ঝুঁকি ছিল। তবে শেষ অংশে এসে অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছি মন্ত্রী দোরজেচান এর মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়া জেনে। অত্যন্ত গভীর দুঃখে মন্ত্রীর জন্য দুচোখ ভিজে এসেছে, অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এসেছে। শুধু মনে হয়েছে, বাবু শরচ্চন্দ্র দাসের ব্রিটিশ এজেন্ট পরিচয় পাওয়ার পরে তাঁর (মন্ত্রী) নিজেকে প্রতারিত মনে হয়েছে কিনা.. কঠিন মানসিক আঘাত পেয়েছেন কিনা.. এবং মন্ত্রীর সাজার সংবাদ পেয়ে বাবু শরচ্চন্দ্র দাসের কতটা কষ্ট হয়েছিল.. যাইহোক আপনার 'থাংলিয়ানা' ও এই বই দুটোই মুগ্ধতার সাথে শেষ করেছি। আশা করছি এরকম রোমাঞ্চকর আরো বই আপনার সৌজন্যে পাঠ করতে পারব। আপনার জন্য শুভকামনা রইলো।।


লিখেছেন - জালাল আহমেদ
২৯ মার্চ ২০২৪

সাধারন জ্ঞানের মুখস্ত বিদ্যায় একটি প্রশ্ন ছিল অবশ্যম্ভাবী, নিষিদ্ধ নগরী কোনটি? কখনো নিষিদ্ধ দেশ কোনটি? উত্তর প্রায় সবারই জানা ছিল, লাসা, তিব্বতের রাজধানী আর দেশ ছিল তিব্বত। তিব্বত চীনের অংশ আবার চীনের অংশ নয় এই নিয়ে বিতর্কও দীর্ঘদিনের। তবে স্মরণাতীত কাল থেকেই তিব্বত ছিল স্বতন্ত্র এক দেশ। আর চতুর্দশ শতক থেকে তিব্বত শাসন করতো তাঁদের ধর্মগুরু দালাই লামা। পঞ্চম দালাই লামা, দ্য গ্রেট ফিফথ লবসাং গিয়াতসো সপ্তদশ শতকের শুরুতে এক ভবিষ্যৎবানী করেন যে বিদেশীদের হাতে তিব্বত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মূলতঃ তারপর থেকেই তিব্বত বিদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা হয়ে যায়।

ঔপনিবেশিক যুগের শুরুতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চেষ্টা ছিল ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলার বিভিন্ন জেলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। ১৭৭২ সালে জেলাসমূহে প্রথম দফা কালেক্টর নিয়োগের সময় তাদের দায়িত্ব ছিল তাদের অধীনস্থ এলাকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ও কলকাতায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করা। বাংলার সংগে তিব্বতের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্ম যেমন প্রবর্তন করেছেন পদ্মসম্ভব বা রিনপোচে তেমনই তার সমন্বিত রূপ দিয়েছেন বাংগালী পন্ডিত অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান। তিব্বতীয় সাধুদের গুরু ছিলেন ভারতীয় সিদ্ধাচার্যগন। একইসংগে ছিল গিরিপথ বেয়ে বানিজ্যক সম্পর্ক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চাইলো এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে তাই গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৪ সালে তিব্বতে প্রথম দূত প্রেরন করেন জর্জ বোগলেকে। এরপরেও একাধিক বানিজ্যিক বা তথ্যানুসন্ধানী মিশন তিব্বতে যায়। এমন কি ১৮১৫ সালের দিকে রংপুরে কালেক্টরেটে দেওয়ান পদে কাজ করার সময় রাজা রামমোহন রায়ও একটি মিশনের অংশ হিসেবে তিব্বতে গিয়েছিলেন।

কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে অবস্থা পালটে যায়। মধ্য এশিয়া জুড়ে শুরু হয় গ্রেট বৃটেন-রাশিয়ার মধ্যে দ্য গ্রেট গেম। ফলে তিব্বতের উপর দিয়ে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ বৃটিশ সরকারের অগ্রাধিকারে পরিনত হয়। লাদাখ দিয়ে যেমন একের পর এক অভিযান পরিচালিত হয় তেমনই বাংলা থেকেও তথ্য সংগ্রহ অভিযান চলতে থাকে। দার্জিলিং এর এক দরজি কিন্টুপকে পাঠানো হয় এলাকা জরিপ ও ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ অনুসন্ধানে। একইসংগে আমাদের চট্টগ্রামের সন্তান, দার্জিলিং এর ভুটিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরৎচন্দ্র দাসকেও পাঠানো হয় তিব্বতে। ১৮৭৯ সালে ছয়মাসের জন্য ও ১৮৮১ সালে চৌদ্দমাসের জন্য শরৎচন্দ্র দাসের তিব্বতবাসের মাধ্যমে ইংরেজ সরকার প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে এবং কলকাতার সরকারি প্রেস থেকে ‘গোপনীয়’ লেবেল দিয়ে এই বিবরনীর নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করে। ১৮৭৯ সালের ভ্রমনের বিবরণ পঁচিশ কপি “ন্যারেটিভ অফ এ জার্নি টু তাশিলহুনপো ইন ১৮৭৯” নামে ১৮৮১ সালে ছাপা হয়। ১৮৮১ সালের দ্বিতীয় ভ্রমনের বিবরণ ১৮৮৫ সালে “ন্যারেটিভ অফ এ জার্নি টু লাসা ইন ১৮৮১-৮২” ছাপা হয় ১৮৮৫ সালে ১০০ কপি। তবে আমার ধারনা তাঁর এই দুই অভিযানের বিস্তারিত মূল বিবরন এখনো ভারতীয় জাতীয় আর্কাইভ বা ব্রিটিশ লাইব্রেরীর কোন বাকসে পরে আছে। প্রকাশিত এই দুটি ভ্রমন বিবরনী র অনুবাদ ইতোপূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমি পড়েছিও কিন্তু যখন মূল ইংরেজির সংগে মিলিয়ে পড়তে গিয়েছি তখনই হোঁচট খেয়েছি। মূল থেকে বিচ্যুতি ও সংক্ষেপিত করার কারনে মূল লেখার রস অনুবাদে পাইনি। আমার অন্যতম প্রিয় লেখক Parimal Bhattacharya তাঁর “শাংগ্রিলার খোঁজে” বইতে শরৎচন্দ্র দাসের ভ্রমনের যে সরস বর্ণনা দিয়েছেন তাতেও সাধ মিটছিলো না।

এইক্ষেত্রে চমকে দিলেন "উপনিবেশ চট্টগ্রাম: ৫০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস" এর লেখক, শক্তিশালী অনুবাদক Haroon Rashid । মূল লেখার স্বাদ অক্ষুন্ন রেখে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ অনুবাদ করেছেন শরৎচন্দ্র দাসের এই দুই ভ্রমন বিবরনী। অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এই বিবরণ যেন প্রান পেয়েছে হারুন রশীদ এর দক্ষ অনুবাদে। শরৎচন্দ্র দাস এক বিশাল স্থায়ী অবদান রেখে গিয়েছিলেন টিবেটান-ইংলিশ ডিকশনারীর প্রনেতা হিসেবে। আর অন্যদিকে তাঁর দুই ভ্রমনে প্রাপ্ত তথ্য ইংরেজ সরকার ব্যবহার করেছিলো ১৯০৪ সালে কর্নেল ইয়ংহাজব্যান্ড এর সশস্ত্র তিব্বত অভিযানে। লেখক হারুন রশীদকে ধন্যবাদ এই মূল্যবান বই দুটো দুই মলাটের ভেতর স্বাদু গদ্যে মূলানুগ অনুবাদে আমাদের সামনে হাজির করার জন্য। টি এইচ লিউইন এর “এ ফ্লাই অন দ্য হুইল” এর অনুবাদের পর বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যে এটি আরেকটি মূল্যবান সংযোজন। তিনি যে বিষয়ে আগ্রহী সে বিষয়ে আরও অনেক মূল্যবান রচনা অনুবাদের অপেক্ষায়। আমরাও অপেক্ষায় থাকবো পরবর্তী চমকের জন্য।

***** ****** ******

লিখেছেন - মনিরুল ইসলাম
১০ মার্চ ২০২৪
শরৎচন্দ্র দাস তবে ঠিক কী? পণ্ডিত? রোমাঞ্চকর দুর্গম পথের অভিযাত্রী? না কি ব্রিটিশের বেতনভুক গুপ্তচর? প্রশ্ন গুলো তুলেছেন আনন্দবাজার পত্রিকার পর্জন্য সেন। এগুলো হয়তো গভীর গবেষণার বিষয়।কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে সে আমার কাছে দুর্গম পথের অভিযাত্রী। শরৎ চন্দ্র দাসের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে পরিমল ভট্রাচার্যের ‘শাংগ্রিলার খোঁজে’ বইয়ের মাধ্যমে। বিস্ময়ের শুরু তখন থেকেই !এরপর যখন জানতে পাড়ি এই পণ্ডিত অভিযাত্রী আসলে চট্টগ্রামের আলমপুর গ্রামের লোক। তখন আগ্রহের জোয়ার এসে চিন্তার দুকূল ভাসিয়ে দিলো।শরৎচন্দ্র দাশ দুবার তিব্বত অভিযান করেছিলেন। প্রথমবার ১৮৭৯ সালে ছ'মাসের জন্য এবং দ্বিতীয়বার ১৮৮১ সালে। কেবল অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান অর্জন নয়, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে শরৎচন্দ্রের দুই দফা তিব্বত অভিযান বিশেষ গুরুত্ববাহী। ১৮৭৯ সালের ১৭ জুন উগ্যেন গিয়াৎসুর সঙ্গে শুরু হয় তিব্বতের দুর্গম পথে অভিযান। সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন একজন গাইড ও একজন কুলি। সঙ্গে নিয়েছিলেন জরিপকাজ চালানোর জন্য সেক্সট্যান্ট ক্যামেরা, প্রিজম্যাটিক কম্পাস, হিপসোমিটার, থার্মোমিটার ও ফিল্ড গ্লাস। দিনলিপির আকারে লেখা সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা পড়তে পড়তে মনের অজান্তে নিজেও সেই অভিযাত্রায় সামিল হয়ে যাই।
‘ আ জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্ট্রাল টিবেট’ থেকে অনুবাদ করে দেবাংশু দাশগুপ্ত লিখেন ‘তিব্বতে দু’বার’।যদিও নাম ‘তিব্বতে দু’বার’ হলেও বইটি মূলত ১৮৮১ অভিযাত্রার উপরে রচিত।সে হিসেবে হারুন রশিদ রচিত ‘ শরচ্চন্দ্র দাস-নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি’ দুটি অভিযান নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা বই’।যদিও বইটি শুধু শরৎ চন্দ্র দাসের দুইটি বিবরণই নয়, আলোচনা করা হয়েছে তার জীবনের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিয়েও।শরৎ চন্দ্র ও তার অভিযান এবং তিব্বত ও তার ইতিহাস জানার জন্য এর চেয়ে ভালো বই আর হতে পারে না।

=================================================

শরৎ দাসের কলকাতার বাড়ি
১৯৪৮ সালে তপন রায় চৌধুরীর ছাত্রজীবনে শরৎ চন্দ্র দাসের পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে ভাড়া ছিলেন কিছুকালের জন্য। অনেকের জানা নেই দার্জিলিং এর মতো কলকাতায়ও শরৎ দাস লাসা ভিলা নামের একটি বাড়ির মালিক ছিলেন। ৮০ পার্ক স্ট্রিটের সেই বাড়ির দোতলাটি শরৎ দাসের কন্যার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলেন তপন রায় ও তাঁর বন্ধুবান্ধবেরা। বাঙাল নামায় তারই স্মৃতিচারণের অংশবিশেষ।

[সূত্র: বাঙালনামা- তপন রায় চৌধুরী]


No comments: