ব্রিটিশ প্রশাসকের চোখে সেকালের পার্বত্য চট্টগ্রাম- সুহান রিজওয়ান
প্রথম আলো- ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
এক দশক আগে, বাংলা অন্তর্জালের বিভিন্ন–বিচিত্র স্বাদের লেখাজোখার পাঠক যখন সীমিত হয়ে আছে কেবল প্রযুক্তি-শিক্ষিতদের মধ্যেই, হারুন রশীদ নামটার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে তখনই। তারপর তাঁর টুকটাক লেখা নিয়মিত বেরোতে শুরু করল পত্রপত্রিকায়। খেয়াল করলাম, ইতিহাস নিয়ে তাঁর কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে ক্রমে তাঁকে পরিচিত করে তুলছে। থাংলিয়ানা পড়া শেষে বলতেই পারি, হারুন রশীদের ইতিহাসবিদ পরিচয়টা এখন রীতিমতো পোক্ত।
থাংলিয়ানা ইতিহাস ঘরানার বই, আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ঐতিহাসিক এক ব্যক্তিত্বের স্মৃতিকথার অনুবাদ এটি। বইয়ের পুরো নাম থাংলিয়ানা, পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার রোমাঞ্চকর অভিযান ১৮৬৫-১৮৭২। মূল বইটির রচয়িতা ব্রিটিশ প্রশাসক থমাস হারবার্ট লুইন, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে যিনি কর্মরত ছিলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বেশ কিছুটা সময়। সেই লুইনের স্মৃতিকথা আ ফ্লাই অন দ্য হুইল–এর নির্বাচিত কিছু অংশের অনুবাদ এই থাংলিয়ানা। মূল বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে।
১৮৬৫ সালে চট্টগ্রাম শহরে পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে আসেন তরুণ ব্রিটিশ অফিসার হারবার্ট লুইন। কিন্তু চট্টগ্রামে দায়িত্বরত অবস্থায়ও লুইনকে আকৃষ্ট করছিল শহরের পূর্ব দিগন্তের ওই পার্বত্য অঞ্চল। লুইনের বাঙালি সহকর্মীরাও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতেন না তখন; তাঁদের কাছে ওই আদিবাসী–অধ্যুষিত রহস্যময় অঞ্চলটি এমন ছিল, যেখানে পা রাখলে আর ফিরে আসা যায় না।
সত্যি বলতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ওই অঞ্চলে ইতিপূর্বে পা পড়েনি কোনো ইউরোপীয়র। এক ফ্রান্সিস বুখানন ১৭৯৮ সালে চট্টগ্রামের দক্ষিণে টেকনাফ পর্যন্ত যাত্রা করেছিলেন, তারপর কর্ণফুলী নদী ধরে গিয়েছিলেন বরকল এলাকা পর্যন্ত। তবে তাঁর সেই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিক, কোম্পানির জন্য মসলা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য। কিন্তু হারবার্ট লুইনের পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিযান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, রোমাঞ্চপ্রিয় এক কিশোরের মতোই তিনি বারবার হারাতে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের পাহাড়ে। ১৮৬৫ সালের নভেম্বরে প্রথমবার পাহাড়ে গিয়ে তিনি মুখোমুখি হন মুরংদের; এরপর বছরের পর বছর ধরে কখনো তিনি অভিযান চালিয়েছেন যুদ্ধবাজ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সেন্দুদের গ্রামে, কখনো ‘জাদুর ক্ষমতা’ দেখিয়ে সমীহ আদায় করেছেন দুর্ধর্ষ লুসাইদের কাছ থেকে।
হারুন রশীদের স্বচ্ছন্দ অনুবাদে লুইনের স্মৃতিকথাটি পড়তে গেলে কেবল মনে পড়ে স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড রচিত অমর চরিত্র অ্যালান কোয়ার্টারমেইনকে। কালো মানুষের আফ্রিকায় একেকটি অভিযানে নেমে অ্যালান কোয়ার্টারমেইন আমাদের যেমন শোনাতেন অরণ্যের আদিবাসীদের উদ্ভট সব প্রথা কি সংস্কৃতি, হারবার্ট লুইনও তেমন সাদা চামড়ার প্রশাসকের চেয়ার থেকে বহিরাগত মানুষের দৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা জাতির বিচিত্র সব প্রথার বর্ণনা করেন। এটাও স্বীকার করতে হয়, অ্যালানের আফ্রিকা-প্রেমের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের সরল মানুষদের প্রতি লুইনের প্রেমও অকৃত্রিম। ঔপনিবেশিক শাসক হলেও বছরের পর বছর নিজের কাজের মাধ্যমে স্থানীয়দের মধ্যে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলেন মানুষটি। সাদা মানুষ অ্যালানকে আফ্রিকার আদিবাসীরা যেমন সম্বোধন করত ‘মাকুমাজান’ নামে, থমাস লুইনও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের কাছে তেমনি হয়ে উঠেছিলেন ‘থাংলিয়ানা’—এমনকি চিরশত্রু লুসাইদের কাছেও!
অ্যালান কোয়ার্টারমেইনের ছকে ফেলা অভিযানের মতোই থাংলিয়ানা লুইনের স্মৃতিকথাও শেষ হয়েছে এক বিশাল যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে। ১৮৭২ সালে লুসাইদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সেই যুদ্ধের রণনীতি অনেকটাই নির্ধারণ করেছিলেন তত দিনে ওই এলাকা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা লুইন। মজার ব্যাপার, সেই যুদ্ধের মূল কারণও—অ্যালানের অভিজ্ঞতাগুলোর মতোই—একজন নারী! ১৮৭১ সালে এক চা-বাগানের ম্যানেজারকে হত্যা করে তাঁর ছয় বছর বয়সী শিশুকন্যা মেরি উইনচেস্টারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় লুসাই বিদ্রোহীরা। তখন চা-বাগানের মালিকেরা এক হয়ে ব্রিটিশ সরকারের ওপর যে চাপ প্রয়োগ করে, তার ফলেই ১৮৭২ সালে লুসাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে ব্রিটিশরা। শেষ পর্যন্ত সরকারি বাহিনী মেয়েটিকে উদ্ধারে সমর্থ হয়। আর লুসাইরাও এক অর্থে চলে আসে ইংরেজ শাসনের অধীনে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী রাজা বা রানিশাসিত অঞ্চলগুলোতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে লুইনের স্মৃতিকথা তাই এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর সব বাদ দিলেও লেখক যে পর্যবেক্ষণগুলো করেছিলেন স্থানীয় আদিবাসীদের নিয়ে, শুধু নৃতাত্ত্বিক কারণেই সেগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন- শাহালুল তানজিম
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
একজনের ধার করা কথা দিয়ে লেখা শুরু করছি। কথাটা হচ্ছে, ‘এটাই বইয়ের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। কোনো পা নাড়ান ছাড়াই বই আপনাকে যেকোনো জায়গা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।’ কথাটা ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক ঝুম্পা লাহিড়ীর। কিন্তু আমি আমার বই পড়ার অভিজ্ঞতায় এ উক্তিটি অনেক অনেক বার রিলেট করতে পেরেছি। আজকে যে বইটা নিয়ে কথা বলব সেটা আমাকে গত কদিন ঘুরিয়ে এনেছে অতীতের রহস্যময় বাংলা থেকে, ঠিক ঝুম্পা লাহিড়ীর কথাটার মত। শুরুতেই ধন্যবাদ দিয়ে নেই অনুজ Rashed Swapnoকে, বইটা কেনার জন্য আর আমাকে পড়তে দেয়ার জন্য।
সময়কাল ১৮৬৫, ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার ‘থমাস হারবার্ট লুইন’ পা রাখলেন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে, ওহ সরি বাংলাদেশ না; পা রাখলেন ব্রিটিশ ভারতের চট্টগ্রামে। ওনার কাজ হবে এই অঞ্চলে আইন শৃঙ্খলার সুষ্ঠু প্রয়োগের দ্বারা শান্তি বজায় রাখা।
তবে চট্টগ্রাম ওনাকে যতটা না টানতে পেরেছে তার চাইতে বেশি পেরেছে, হালকা নীলাভ মেঘের আবরণে ঘেরা রহস্যের আঁধার পার্বত্য চট্টগ্রাম। তার কৌতূহল অমোঘ আকর্ষণে রূপ নিল যখন পাহাড়ের কোলে বাস করা মানুষদের ব্যাপারে একের পর এক রহস্যময় কাহিনী তার কানে আসতে লাগল। অগত্যা, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিস্তৃত পর্বত মাতার কোলে।
লুইন সাহেবের সেই অভিজ্ঞতা ঠাই পেয়েছিল তার লিখিত ‘আ ফ্লাই অন দ্য হুইল’ বইতে। তবে এ বইটিতে অবশ্য শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে তার অভিজ্ঞতাকেই মলাটবদ্ধ করেনি, ভারত উপমহাদেশে থাকাকালীন তার সকল অভিজ্ঞতাই ছিল এই ‘আ ফ্লাই অন দ্য হুইল’ বইতে। কিন্তু অনুবাদক হারুন রশীদ সাহেব করলেন কী? তিনি লুইন সাহেবের বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম অংশটুকুকে অনুবাদ করে ফেললেন আর নাম দিলেন ‘থাংলিয়ানা’। উদ্ভট এ নামটার পেছনে চমৎকার একটা গল্প আছে। কিন্তু এ গল্প আমি বলব না, আপনারা না-হয় বই থেকেই জেনে নেবেন। তবে জানার পর আমায় ধন্যবাদ দেবেন যে, বলে না দিয়ে ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স করতে দিয়ে আমি ভালোই করেছি। যাই হোক, আমি চলে যাই বইটা কী নিয়ে আর আমার কেমন লাগল সে বই।
প্রথম কয়েক প্যারা পড়েই বুঝে ফেলার কথা বইটা অ্যাডভেঞ্চারাস। তবে ‘আমাজনিয়া’, ‘গালিভারস ট্রাভেল’, ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘আরণ্যক’ ইত্যাদির সাথে এ অ্যাডভেঞ্চার উপাখ্যানের পার্থক্য হলো, ওগুলো ফিকশন আর এটা একদম সত্যিকারের অভিজ্ঞতার বুনন! লুইন সাহেব কী আগ্রহ নিয়ে জনমানবশূন্য ভীষণ বন্ধুর পাহাড়ি পথে চরাই-উৎরাই পার হয়েছেন, খেয়ে না খেয়ে ছেড়া বস্ত্রে গহীন জঙ্গলের মাঝে রাস্তা হারিয়ে জীবনের আশা জিইয়ে রেখেছেন, কী ভীষণ সাহস নিয়ে দুর্ধর্ষ পাহাড়ি জাতি সেন্দু, লুসাইদের সাথে সন্ধি করার চেষ্টা করেছেন, জীবন হাতে নিয়ে তাদের গ্রামে কোনোরকম সুরক্ষা ছাড়া প্রবেশ করেছেন; স্রেফ তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য, তা উঠে এসেছে কালো কালিতে। এ অভিজ্ঞতা পাঠক হিসেবে আমাকে ব্যাপক অ্যাড্রেনালিন রাশ দিয়েছে। পড়তে পড়তে কখনও কখনও মনে হয়েছে লোকটা কী দারুণ কৌশলী! কেমন করে আপন করে নিলেন রতন পুইয়া নামের এক পাহাড়ি গোত্রপ্রধানকে! এ বই লুইন সাহেবের চোখ দিয়ে আমাদের দেখিয়েছে, লড়াকু পাহাড়িরা মানুষ হিসেবে কতটা সহজ-সরল, কতটা নির্লোভ। আর এই নির্লোভ মানুষগুলোকে বরাবর ঠকানোর চেষ্টা করেছে সমতলের মানুষেরা। এখানেও লুইন সাহেবকে আমরা দেখি, পাহাড়িদের প্রতি হওয়া আনজাস্টিস রোধ করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হতে। তাদের প্রতি আনজাস্টিসের কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক, বাঙালীদের তিনি অপছন্দ করতেন। আর ভীষণ ভালোবাসতেন পাহাড়িদেরকে। ভালো না বেসে শুধু শাসন করলে, লুইন সাহেব তাদের সাথে এক পাতে বসে খেতে পারতেন না, যা তিনি কোনোদিন খাননি তা ঐ পাহাড়িদের কৃষ্টি কালচারকে সম্মান করে খেতে পারতেন না। লুসাইদের কাছ থেকে মেরি উইনচেস্টার ওরফে জোলুটিসহ কিছু ব্রিটিশ নাগরিকদের উদ্ধারও করতে পারতেন না। পাহাড়িদের পরম বন্ধু হতে পারতেন না, তাদের আচার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণও পেতেন না। শুধু শাসক হলে এরকম অনেক কিছুই পারতেন না এবং মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি থমাস লুইন কখনও ‘থাংলিয়ানা’ হতে পারতেন না।
বইটা আমাকে এককথায় মুগ্ধ করেছে। শুধু অ্যাডভেঞ্চারের জন্য নয়। বইয়ে উঠে এসেছে ‘আরণ্যক’-এর সেই নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা, উঠে এসেছে পাহাড়ীদের বৈচিত্র্যময় জীবন ব্যবস্থার কথা।
আর অনুবাদ? এটা নিয়ে আসলে বলার ভাষা নেই, এতোটাই চমৎকার হয়েছে! হারুন রশীদ চমৎকার ভাষা প্রয়োগে এমনভাবে বইটাকে সাজিয়েছেন যে মনে হচ্ছে থমাস লুইন বর্তমান সময়ের একজন 'বাঙালী' হয়ে আমাদের তার অভিজ্ঞতা শুনিয়ে যাচ্ছেন। কেউ অনুবাদের স্ট্যান্ডার্ড কী জিজ্ঞেস করলে এ বইটি আমি ধরিয়ে দেবো আমি। তাই বলছি, 'আ ফ্লাই অন দ্য হুইল' বইটি থমাস হারবার্ট লুইন এর হতে পারে কিন্তু 'থাংলিয়ানা' আসলে হারুন রশীদের।
ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন- মোশারফ অপূর্ব
২৪ আগষ্ট ২০২৪
প্রায় দেড়শ বছর আগের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা কেমন ছিল, কোন কোন জনজাতি বাস করতো তখন সেখানে, কেমন ছিল তাদের মধ্যকার সম্পর্ক, আর কীভাবেই বা ব্রিটিশ রাজের দখলে এলো সেইসব জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকাগুলো?
যে কোনো অজানা জনজাতির কথা জানতে ভালো লাগে আমার, ভালো লাগে পাহাড়ে-সমুদ্রে- জঙ্গলে- মেরুতে যে কোনো অভিযাত্রার কাহিনি পড়তে। আবার ইতিহাসের দিকেও আছে ঝোঁক। হারুন রশীদ ভাইয়ের অনুদিত "থাংলিয়ানা" বইটা সম্পর্কে যেটুকু জেনেছিলাম, মনে হয়েছিল এতে তার সবকিছুই আছে। কাজেই সংগ্রহ করে ধীরে ধীরে পড়ে
ফেললাম। এইসব কৌতূহলের বেশ খানিকটা জবাব পেলাম থাংলিয়ানা বইটায়, সেই সাথে আরো বেশি কৌতূহল জাগিয়ে তোলে, আরো বিস্তারিত জানার।
ব্রিটিশ অফিসার থমাস হারবার্ট লুইন, যেসব দুর্গম এলাকায় তখনো কোনো ইউরোপীয় মানুষের পা পড়েনি সেখানে অভিযান চালিয়েছেন। যেসব পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সাথে বন্ধুসুলভ মোলাকাত কখনো হয়নি ব্রিটিশদের, লুইন গিয়েছেন তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে। যদিও প্রয়োজনে সেই হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছে, চালাতে হয়েছে সশস্ত্র অভিযান দুর্ধর্ষ লুসাই কিংবা সেন্দুদের বিরুদ্ধে, তবু লুইনের লেখনীতে মনে হয় তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায় এলাকাগুলোকে ব্রিটিশ রাজত্বের আওতায় নিয়ে আসা। তিনি আগ্রহী ছিলেন পাহাড়ের মানুষদের সাথে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
ইংরেজ অফিসার লুইনের অভিযানের বিবরণ পড়তে পড়তে মনে হয়, এইজন্যেই ছোট এই দ্বীপরাষ্ট্র অর্ধেক পৃথিবী দখল করে ফেলেছিল। কী সাহস! আর কী পরিশ্রমী তারা! যদিও তাদের এই দখলদারি সাম্রাজ্যবাদী পরিচয় মোটেও পছন্দ করার মতো ব্যাপার না, তারপরেও তাদের সাহসিকতার প্রশংসা করতেই হয়।
দু:খ পেলাম লুইনের লেখায় বারবার বাঙালিদের নিন্দা করা হয়েছে দেখে। কথা হয়ত অসত্য নয়, মহাশ্বেতা দেবীর কলমে যখন আদিবাসীদের জীবনকথা পড়ি, তখনও দেখি বাঙালিরা কীভাবে তাদের ঠকায়, তাদের সরলতার সুযোগ নেয়। কিন্তু এক ইংরেজের বয়ানে এইসব নিন্দাবাক্য গায়ে বিঁধলো, নিজেরা তো এসেছে পরের দেশে ডাকাতি করতে, আবার আমাদের নিন্দা করে! ভালোমানুষ বাঙালিদের সাথে লুইনের দেখা হয়নি, এটাই বুঝলাম।
বইটিতে বেশ কিছু চিত্র দেওয়া আছে, ঘটনাপ্রবাহের সাথে প্রাসঙ্গিক। আমরা তো একটা ঘটনা পড়ার সময় সেটা কল্পনার চোখে দেখারও চেষ্টা করি, এক্ষেত্রে ছবিগুলো খুবই সহায়ক। তবে বই পড়তে পড়তে ভালো মানচিত্রের অভাব বোধ করলাম খুব। বইতে মানচিত্র দেওয়া আছে, কিন্তু জায়গার সব নাম স্পষ্ট নয়। কালো কালো রেখার ভেতর থেকে অনেক নাম উদ্ধার করতে পারলাম না। অনুবাদক বইটিতে অনেক পরিশ্রম করেছেন, মনে হলো আর একটু কষ্ট করে আরো কিছু মানচিত্র যদি দিতে পারতেন দারুণ হতো! পুরো পার্বত্য এলাকার একটাই ম্যাপ নয়, ছোট ছোট অঞ্চলভিত্তিক কিছু ম্যাপ থাকলে লুইনের অভিযানের গতিপ্রকৃতি ভালো বোঝা যেত। আমি গুগলের সাহায্য নিয়ে ভালোমতো বোঝার চেষ্টা করলাম। খুব একটা সফল অবশ্য হইনি।
অনুবাদক হারুন রশীদ ভাইকে ধন্যবাদ জানাই। এরকম একটা বই সহজ বাংলায় গুছিয়ে লেখা খুব সহজ কাজ নয় বলেই মনে হয়। আর সত্যি বলতে কি যাঁরা ভালো ভালো বই অনুবাদ করেন তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি। ভাবি যে, অনুবাদ না করলে জীবনে কখনো বইটা পড়াই হতো না।
হারুন রশীদ ভাই এরকম আরো ভালো ভালো বই উপহার দেবেন, মৌলিক অথবা অনুবাদ- এই প্রত্যাশা রইলো।
ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন- মো: আবদুল কাইয়ুম
৭ আগষ্ট ২০২৪
পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব নানান অভিজ্ঞতার ফুলঝুরিতে ভরপুর এই 'থাংলিয়ানা' বইটি। বইটিকে আপাদমস্তক একটা ভ্রমণবৃত্তান্ত মনে হলেও প্রতিটা ভ্রমণের কাহিনি পড়ে মনে হয়েছে এক একটা রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প পড়ছি। থমাস হারবার্ট লুইনের পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিদের সাথে যে আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তার বর্ণনা পড়েও হয়েছি মুগ্ধ। ভদ্রলোকের এই বইটি পড়ে স্বীকার করতেই হবে তিনি একই সাথে যেমন দুর্ধর্ষ সাহসী এবং কৌশলী ছিলেন আবার একই সাথে পাহাড়ী এই অঞ্চলে থাকা সহজ-সরল মানুষগুলোর প্রতি ছিলেন আন্তরিক। একই ভাবে তার এই পাহাড়ি মানুষদের জন্য কিছু করার প্রচেষ্টা সেই মানুষগুলোর নিখাত ভালোবাসা জয় করে নিয়েছিলো।
তাই যেকোনো উৎসবেই পাহাড়ী গোত্রপ্রধান বন্ধুর মতো নিমন্ত্রণ করতো লুইনকে, তার সাহসিকতার প্রতি যেমন সম্মান করতো, আবার তার কাছে সহযোগিতাও করতো। তবে সবগল্পই যে সুখকর তেমন কিন্তু না। সব গোত্রপ্রধানই যে তাঁকে পছন্দ করতো এমন কিন্তু না, সেই কাহিনিও বইটিতে স্থান পেয়েছে। আছে এসব গোত্রদের নানান বিশ্বাস, মিথ আর অদ্ভুত আচার, খাদ্য অভ্যাসের বর্ণনা।
বইটি থমাস হারবার্ট লুইনের A Fly On The Wheel এর অনুবাদ বলা যায় না, মূল বই থেকে সম্পাদনা করে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্তগুলোই স্থান নিয়েছে এই বইটিতে। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখা বলেই আমারও বইটি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। বইটির নামটাও বেশ চমৎকার, এই নামের পিছনেরও আছে একটা গল্প। অবশ্য সেটা আমি এখানে উল্লেখ করছি না, কেউ বইটি পড়লে তাঁকে বিষয়টা দারুণ আমোদিত করবে বলে মনে করি।
শেষদিকে এসে লুসাইসহ কয়েকটা গোত্রের কার্যক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে ব্রিটিশদের চালানো এক অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ আছে বইটিতে যেখানে থমাস হারবার্ট লুইনও ছিলেন, তার কুটনৈতিক দক্ষতা আর পাহাড়ি সহজসরল মানুষগুলোর তার প্রতি বিশ্বাসের ভিত্তিতে অভিযান সফল হয়েছিল, উদ্ধার করা হয়েছিলো কিছু অপহরণ করা ব্রিটিশ মানুষদের। মূলত এই অভিযানটা করা হয়েছিলো এক ছয় বছর বয়সি মেরি ওয়ইনচেস্টার বা জেলুটির জন্য, তার সেই অপহরণ হওয়া নিয়েও বিস্তারিত আছে বইটিতে।
সেই অভিযানের পরে লুসাই জাতির সাথে এক ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো লুইন বা থাংলিয়ানার সাথে। যাকে পাহাড়িরা নিজের গোত্রপ্রধানের মতোই বিশ্বাস করতো। এবং কী পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়া, নানান সব আইন পদ্ধতির সংস্কারসহ পাহাড়ি মানুষগুলোর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই বইটিতে। সত্যি বলতে বইটি পড়ে লুইনের পাহাড়িদের প্রতি যে ভালোবাসা, আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে তা খুবই বিরল এখনকার সময়েও।
থাংলিয়ানা আমার পড়া চমৎকার একটা বই, যা হৃদয়ে দাগ কেটে গেছে। বইটি ভ্রমণ কাহিনি হলেও এক একটা অধ্যায় যেনো গল্পের বই থেকে তুলে আনা টানটান উত্তেজনাকর কোনো গল্প মনে হয়েছে আমার। ফ্রান্সিস বুকাননের বইটি পড়ে যতটা না বিরক্ত হয়েছি, থাংলিয়ানা পড়ে ঠিক তার চেয়েও বেশি হয়েছি মুগ্ধ। কেননা ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণ ছিলো বাণিজ্যিক, যার ফলে তার বর্ণনায় রসকষহীন ভৌগোলিক অবস্থাই স্থান পেয়েছে বেশি। কিন্তু থাংলিয়ানার পার্বত্য অভিযান স্বপ্রণোদিত হওয়ায় ছিলো স্বতস্ফূর্ত বর্ণনা। যেখানে পাহাড়ি মিথ, আচার, খ্যাদাভাস, উৎসব, তাদের জীবনধারাসহ নানান দিকও উঠে এসেছে গল্পের ছলে।
বইটি বের হয়েছে কথাপ্রকাশ থেকে, তাদের প্রোডাকশন কোয়ালিটি নিয়ে আসলে বলার কিছু নেই। অনুবাদ একেবারে ঝরঝরে, বানানভুলও চোখে পড়েনি একদম। সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদও আমার কাছে দারুণ মনে হয়েছে, তবে মূদ্রিত মূল্যটা বেশি মনে হয়েছে ২০০ পৃষ্ঠা একটা বইয়ের। যদিও বইটি পড়ে যাকে বলে পয়সা উসুল করা বই মনে হয়েছে আমার।
ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন- মারজানা সাবিহা শুচি
২৭ জুন ২০২৪
প্রায় দেড়শ বছর আগের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা কেমন ছিল, কোন কোন জনজাতি বাস করতো তখন সেখানে, কেমন ছিল তাদের মধ্যকার সম্পর্ক, আর কীভাবেই বা ব্রিটিশ রাজের দখলে এলো সেইসব জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকাগুলো?
যে কোনো অজানা জনজাতির কথা জানতে ভালো লাগে আমার, ভালো লাগে পাহাড়ে-সমুদ্রে- জঙ্গলে- মেরুতে যে কোনো অভিযাত্রার কাহিনি পড়তে। আবার ইতিহাসের দিকেও আছে ঝোঁক। হারুন রশীদ ভাইয়ের অনুদিত "থাংলিয়ানা" বইটা সম্পর্কে যেটুকু জেনেছিলাম, মনে হয়েছিল এতে তার সবকিছুই আছে। কাজেই সংগ্রহ করে ধীরে ধীরে পড়ে ফেললাম। এইসব কৌতূহলের বেশ খানিকটা জবাব পেলাম থাংলিয়ানা বইটায়, সেই সাথে আরো বেশি কৌতূহল জাগিয়ে তোলে, আরো বিস্তারিত জানার।
ব্রিটিশ অফিসার থমাস হারবার্ট লুইন, যেসব দুর্গম এলাকায় তখনো কোনো ইউরোপীয় মানুষের পা পড়েনি সেখানে অভিযান চালিয়েছেন। যেসব পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সাথে বন্ধুসুলভ মোলাকাত কখনো হয়নি ব্রিটিশদের, লুইন গিয়েছেন তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে। যদিও প্রয়োজনে সেই হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছে, চালাতে হয়েছে সশস্ত্র অভিযান দুর্ধর্ষ লুসাই কিংবা সেন্দুদের বিরুদ্ধে, তবু লুইনের লেখনীতে মনে হয় তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায় এলাকাগুলোকে ব্রিটিশ রাজত্বের আওতায় নিয়ে আসা। তিনি আগ্রহী ছিলেন পাহাড়ের মানুষদের সাথে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
ইংরেজ অফিসার লুইনের অভিযানের বিবরণ পড়তে পড়তে মনে হয়, এইজন্যেই ছোট এই দ্বীপরাষ্ট্র অর্ধেক পৃথিবী দখল করে ফেলেছিল। কী সাহস! আর কী পরিশ্রমী তারা! যদিও তাদের এই দখলদারি সাম্রাজ্যবাদী পরিচয় মোটেও পছন্দ করার মতো ব্যাপার না, তারপরেও তাদের সাহসিকতার প্রশংসা করতেই হয়।
দু:খ পেলাম লুইনের লেখায় বারবার বাঙালিদের নিন্দা করা হয়েছে দেখে। কথা হয়ত অসত্য নয়, মহাশ্বেতা দেবীর কলমে যখন আদিবাসীদের জীবনকথা পড়ি, তখনও দেখি বাঙালিরা কীভাবে তাদের ঠকায়, তাদের সরলতার সুযোগ নেয়। কিন্তু এক ইংরেজের বয়ানে এইসব নিন্দাবাক্য গায়ে বিঁধলো, নিজেরা তো এসেছে পরের দেশে ডাকাতি করতে, আবার আমাদের নিন্দা করে! ভালোমানুষ বাঙালিদের সাথে লুইনের দেখা হয়নি, এটাই বুঝলাম।
বইটিতে বেশ কিছু চিত্র দেওয়া আছে, ঘটনাপ্রবাহের সাথে প্রাসঙ্গিক। আমরা তো একটা ঘটনা পড়ার সময় সেটা কল্পনার চোখে দেখারও চেষ্টা করি, এক্ষেত্রে ছবিগুলো খুবই সহায়ক। তবে বই পড়তে পড়তে ভালো মানচিত্রের অভাব বোধ করলাম খুব। বইতে মানচিত্র দেওয়া আছে, কিন্তু জায়গার সব নাম স্পষ্ট নয়। কালো কালো রেখার ভেতর থেকে অনেক নাম উদ্ধার করতে পারলাম না। অনুবাদক বইটিতে অনেক পরিশ্রম করেছেন, মনে হলো আর একটু কষ্ট করে আরো কিছু মানচিত্র যদি দিতে পারতেন দারুণ হতো! পুরো পার্বত্য এলাকার একটাই ম্যাপ নয়, ছোট ছোট অঞ্চলভিত্তিক কিছু ম্যাপ থাকলে লুইনের অভিযানের গতিপ্রকৃতি ভালো বোঝা যেত। আমি গুগলের সাহায্য নিয়ে ভালোমতো বোঝার চেষ্টা করলাম। খুব একটা সফল অবশ্য হইনি।
অনুবাদক হারুন রশীদ ভাইকে ধন্যবাদ জানাই। এরকম একটা বই সহজ বাংলায় গুছিয়ে লেখা খুব সহজ কাজ নয় বলেই মনে হয়। আর সত্যি বলতে কি যাঁরা ভালো ভালো বই অনুবাদ করেন তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি। ভাবি যে, অনুবাদ না করলে জীবনে কখনো বইটা পড়াই হতো না।
হারুন রশীদ ভাই এরকম আরো ভালো ভালো বই উপহার দেবেন, মৌলিক অথবা অনুবাদ- এই প্রত্যাশা রইলো।
'থাংলিয়ানা' পাঠে মগ্নতা - লিখেছেন মুশফিক হোসাইন
দৈনিক পূর্বদেশ ১১ জুন ২০২৪
++++++++++++
দুই হাজার চব্বিশের একুশের বইমেলায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘থাংলিয়ানা' গ্রন্থটির প্রশস্তি ও গুণকীর্তন প্রায়শ চোখে পড়েছিল সামাজিক মাধ্যমে। নামের বৈচিত্রতা নাকি আকর্ষনীয় বিষয়বস্তু পাঠকদের উস্কে দিচ্ছিল বোঝা যাচ্ছিলো না। যাই হোক ‘উপনিবেশ চট্টগ্রাম' গ্রন্থের যশস্বী লেখক হারুন রশীদ বর্ণিত গ্রন্থের লেখক জানতে পেরে গ্রন্থটি পাঠ করার জন্য বেশি আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ি। ‘উপনিবেশ চট্টগ্রাম' গ্রন্থটি সবিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। সুপ্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত চট্টগ্রামের ৫০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস তিনি সুবিন্যাস্তভাবে পাঠকদের উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। যার দৃষ্টান্ত ইতিপূর্বে বিরল।
গ্রন্থটি নিয়ে ব্যাপক আলাপ আলোচনা শুনে পড়ার জন্য বেশ লোভ জাগে। লেখকের সাথে বাতচিতও হলো। এরি মাঝে ঘটনা চক্রে গ্রন্থাকারের স্বহস্তে লিখিত শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা বাক্য সমেত কুরিয়ারে পেয়ে পুলকিত হয়ে পড়ি। সমস্যা হল ঘরে হারুনের ভক্ত ও গুণমুগ্ধ পাঠক আমরা দুজন। লেখালেখি ছাড়াও আমার আছে প্রকৃতি ও প্রবীণদের নিয়ে নানাবিধ কাজকর্ম। তারপর হারুনের ইতিহাস চর্চায় আমি মুগ্ধ। অতএব ভাগাভাগি পাঠ শুরু। একজন ইংরেজ রাজ কর্মচারীর প্রত্যক্ষ দর্শনীতে আমার প্রিয় শহর চট্টগ্রামের স্মৃতিচারণ পাঠের গভীর আগ্রহ এবং লোভ সামলানো সত্যিই কঠিন। ‘থাংলিয়ানা' হল পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত এক ব্রিটিশ কর্মচারীর রোমাঞ্চকর অভিযানের স্মৃতিকথা। লেফটেন্যান্ট থমাস হারবার্ট লুইন ১৮৬৫ সালে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রধান হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৮৬৬-১৮৭২ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ১৮৭৯ সালে দার্জিলিং থেকে ডেপুটি কমিশনার এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদায় অবসর গ্রহণ করেন । অবসরের পর নিজ দেশ লন্ডনে ফিরে গিয়ে রোমাঞ্চকর অভিযান ও স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘এ ফ্লাই অব দ্য হুইল (A Fly on the wheel) প্রকাশ করেন। গ্রন্থটি ১৮৮৫ সালে লন্ডন থেকে প্রাকশিত হয়। তাঁর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, প্রকৃতি ও আদিবাসীদের নিয়ে তাঁর মুগ্ধতা গ্রন্থের প্রতিটি পাতায় পাতায় ।
থমাস লুইন ১৮৬৫ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। চট্টগ্রামের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই এতদঞ্চলের প্রকৃতি এবং কর্ণফুলীর উজানের পাহাড়, নীলাকাশ, মেঘমালা তাঁকে এতো মুগ্ধ করেছিল যে, তিনি যে কোন ছুতোয় পাহাড়ে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব থাকতেন। এই ঘটনাপ্রবাহ আজ থেকে ১৫০ বছর আগের। ঘটনার প্রেক্ষাপট কয়েক হাজার বর্গমাইলের গভীর জঙ্গলাকৃত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় টিলা বনজঙ্গল, গিরিখাদ বন্যপ্রাণীসহ সহজ সরল পাহাড়ি আদিবাসীগণ। বিশেষ করে লুসাই সম্প্রদায়। তিনি যখন ১৮৬৫ সালে চট্টগ্রামে পোস্টিং পেলেন এবং পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকাকালীন সময়ের তথাকার প্রকৃতি ছিলদুর্গম। যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল প্রায় অগম্যু। বেশকিছু আদিবাসী বা পাহাড়ি জনগোষ্ঠি সেখানে বাস করতো স্বাধীনভাবে। তেমনি গভীর জঙ্গলে ‘তাউংখ্যা, নামে পরিচিত এক আদিম ও দুর্ধর্ষ জনজাতির বাস ছিল। হাজার বছর ধরে সমভূমি অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘তাউংখ্যারা' অসভ্য, হিংস্র, বর্বর বলে পরিচিত ছিল। জনশ্রুতি ছিল তাউংখ্যাদের ভূখণ্ডে সমতলের মানুষদের প্রবশে নিষিদ্ধ। তাঁদের নিয়ে সমতলের মানুষের লোকমুখে ছিল অসংখ্য উদ্ভট গুজব। তাঁরা মানুষ খেকো এই ভয়ে সমতলের মানুষ সেখানে প্রবেশ করতে ভয় পেত। আবার এই জনজাতি নদী বা জলের স্পর্শ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতো। পৃথিবীর অন্য মানুষ বা জগত সম্পর্কে তাঁদের কোন ধারণা ছিল না। কোন খোঁজ খবর রাখার চেষ্টাও করতে না। তাঁরা যেন অন্যগ্রহের মানুষ ।
এই মানুষগুলো সম্পর্কে নানান গুজব উদ্ভট কথা শুনে ব্রিটিশ অফিসার হারবার্ট লুইয়ের মনে কৌতুহল ও জেদ চেপে যায়। নিজের প্রাণবাজী রেখে এই নিষিদ্ধ দুর্গম এলাকায় প্রবেশ করেন লুইন। তার এই দুঃসাহসিক অভিযানে উন্মোচিত হতে থাকে একের পর এক বিষ্ময়। লুইন তাঁদের সাহচর্যে আসেন, আলাপ করেন। ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজের চোখে দেখেন তাঁদের খাদ্য রুচি, সংস্কৃতি ও সমাজ জীবন। গোত্রপ্রধানের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। তাঁদের সহায়তায় ব্রিটিশ রাজের লোকজন লুসাইদের অপহৃত একটি শিশু উদ্ধারে যুদ্ধে নামেন। থমাস লুইনের পার্বত্য চট্টগ্রাম অবস্থানকালীন সময়েই লুসাই জাতির কর্তৃক ইংরেজ কর্মচারী ও শিশু মেরি উইনচেষ্টার জোলুটি অপহৃত হয়। তাঁদের উদ্ধারে ইংরেজ সেনাবাহিনী যুদ্ধাভিযান শুরু করে। লুইন ছিলেন সে যুদ্ধের রাজনৈতিক অফিসার। বলা যেতে পারে তথাকথিত সভ্য মানুষ হানা দিয়ে পাহাড়ের নির্জনতা তছনছ করে। ব্রিটিশ বাহিনীর অগ্রাভিযান প্রতিহত করার কৌশল হিসাবে লুসাইরা নিজেদের বসতবাড়ী, গ্রাম, খাদ্যগুদাম প্রভৃতি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পাহাড় অভ্যন্তরে পালিয়ে যেতে থাকে। সেই প্রথম অচিন অঞ্চলের মানুষ তথা বাইরের দুনিয়ার সাথে তাঁদের প্রথম পরিচয়ের পালা শুরু ।
থমাস হারবার্ট লুইন ১৮৩৯ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৫৭ সালে তরুণ লেফটেন্যান্ট হিসাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান। ১৮৬৫-১৮৭২ পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশের পাহাড়ঘেরা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। তাঁর স্মৃতিচারণে তিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠি সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। অথচ বাঙালি হিন্দু মুসলমানদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। অথচ তাঁর কর্মজীবনের প্রতিমুহূর্তে তাঁদের সহায়তায় পথ চলেছেন। তাঁর মতে বাঙালিরা দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত এক জাতি। যাঁরা পরিশ্রম ও সততা বিমুখ। আমার ধারণা তিনি কর্মক্ষেত্রে এবং পেশাগত সূত্রে যাঁদের সাথে মেলামেশা করেছেন, তারা সবাই ছিল টাউট, বাটপার এবং মোকতার শ্রেণির লোকজন। তবে লুইন সৎ, পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান কর্মচারী ছিলেন । লুসাই জনগোষ্ঠিরা ভালোবেসে তাঁর নাম দেন ‘থাংলিয়ানা'। থমাস হারবার্ট লুইয়ের স্মৃতি চারণগ্রন্থ ‘এ ফ্লাই অন দ্যা হুইল' অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদক হারুন রশীদও নামটি রেখেছেন।
বিষ্ময়করভাবে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার পরও বোঝা যায়নি এটি একটি অনুবাদগ্রন্থ। মনে হচ্ছিল একটি মৌলিক রোমাঞ্চকর বই পাঠ করছি। গ্রন্থটি পাঠশুরু করলে তাতে মজে না যাওয়াটাই আশ্চর্য্যের বিষয়। হারুণ মুন্সিয়ানার সাথে তার অনুবাদ করে বাঙালি পাঠকের অন্তর জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু এতো আকর্ষণীয় ও রোমাঞ্চকর যে কোন পাঠক বই ছেড়ে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় না। তিনি অপ্রতিরোধ্য ভাবে এবং মাধুর্য্য মিশিয়ে অনুবাদ করেছেন। বলা যায় অদৃশ্য এক চম্বুকীর শক্তির টানে গ্রন্থটি পাঠে। সবশেষে বলা চলে থাংলিয়ানা একটি সমৃদ্ধ, মুখপাঠ্য এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ।
ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন প্রাবন্ধিক অনুবাদক আলম খোরশেদ
২২ মে ২০২৪
বিগত বইমেলার সময় থেকেই ফেসবুক খুললেই দেখতাম 'থাংলিয়ানা'র মতো বিচিত্র নামধারী একটি গ্রন্থের ব্যাপক প্রশস্তি ও গুণকীর্তনের কথা। ঘটনাক্রমে এর লেখক হারুন রশীদ আমার সুপরিচিত, যাকে দিয়ে আমি বছর পাঁচেক আগে আমাদের তদানিন্তন প্রতিষ্ঠান 'বিস্তার' এ চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন ইতিহাস বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান করিয়েছিলাম এবং যার প্রথম ও প্রভূত জনপ্রিয় গ্রন্থ, 'উপনিবেশ চট্টগ্রাম' এর ভূমিকাটিও লিখে দিতে হয়েছিল এই অধমকেই।
তো, ফেসবুকে তার এই নতুন বইটি নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার কথা পড়ি আর মনে মনে লোভ হয় বইটি পাঠের জন্য। হারুন আমার মনের কথা পড়তে পেরেছিল কি-না জানি না, দুদিন আগে দেখি কুরিয়ারে সেই বইটিই এসে হাজির, খোদ গ্রন্থকারের স্বহস্তে উৎকীর্ণ অপরূপ এক উপহারবাক্য সমেত। হাতে তখন প্রচুর কাজ; বহু উপহৃত বই পড়া বাকি, বহু অসমাপ্ত, অনুরুদ্ধ লেখা সমাপন ও সম্পাদনার ক্রমবর্ধমান তালিকার তাগাদা। তবু বইটির বিষয় যেহেতু বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও তার প্রাচীন ইতিহাস এবং সেটিও একজন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ রাজকর্মচারীর বয়ানে, তখন সেটি পড়ার লোভ সামলানো আমার পক্ষে কঠিন বইকি।
বইটি মূলত লেফটেন্যান্ট কর্নেল থমাস হার্বার্ট লুইন নামে এক ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তার দেড়শো বছর আগের (১৮৬৫-১৮৭২) স্মৃতিচারণা, বিশেষত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে তাঁর রোমাঞ্চকর অভিযানের রোমহর্ষক বর্ণনা, যেটি ১৮৮৫ সালে বিলেতে প্রথম প্রকাশিত হয় A Fly on the Wheel শিরোনামে, হারুন রশীদ যার অনুবাদ করেছেন, লুইনকে পাহাড়ি আদিবাসীদের ভালোবেসে দেওয়া ডাকনাম, থাংলিয়ানা শিরোনামে। তো, কাল রাতে বইটি পড়া শুরু করে তাতে এমনই মজে যাই যে, এরই মধ্যে এর এক তৃতীয়াংশ পাঠ শেষ! এমনই আকর্ষণীয় এর বিষয়বস্তু এবং অপ্রতিরোধ্য হারুনের অনুবাদের শক্তি ও সৌন্দর্যের টান।
বইটার বাকি অংশটুকু আমাকে এখন চুম্বকের মতোই টানছে, তবু তার পাঠে সামান্য বিরতি নিলাম, হারুনকে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটুকু জানাতে এবং বিশেষকরে পত্রপাঠ অভিনন্দিত করতে, এমন একটি সমৃদ্ধ, সুখপাঠ্য ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বই আমাদেরকে উপহার দেবার জন্য।
আজ তাহলে এটুকুই। এবার যাই, বইটি আবার পড়তে শুরু করি। আপনারাও চাইলে এর প্রকাশক 'কথাপ্রকাশ' এর ওয়েবসাইট থেকে এটি সংগ্রহ করে, আমার সঙ্গে পড়তে বসে যেতে পারেন। শুভ পাঠ।
কৌশিক মজুমদারের পোস্ট থেকে
মে ২০২৪
জুলাই ১৪
লিখেছেন- হারুন আহমেদ
৪ এপ্রিল ২০২৪
ব্রিটিশ কর্মকর্তা থমাস হারবার্ট লুইন ১৮৬৫ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। বইয়ের বিজ্ঞাপনে যদিও লুইনের অভিযানকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, বাস্তবে তার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও কম জরুরি নয়। লুইন পাহাড়িদের সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করলেও বাঙালিদের একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। এর কারণ তিনি মোক্তার বা মোড়ল জাতীয় বাঙালিদের সাথে পেশাগত সূত্রে মিশেছেন এবং
দেখেছেন এদের সীমাহীন দুর্নীতি।
মনে রাখতে হবে, "থাংলিয়ানা " একজন ব্রিটিশের লেখা। তিনি সরাসরি সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নিয়েছেন এবং দায়িত্বরত অবস্থায় পাহাড়ের তথাকথিত অসভ্য বর্বর নৃ-গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধ করেছেন। এদিকে প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, চা বাগানের জন্য পাহাড় দখলের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পাহাড়ের বাসিন্দারা ক্রমশ গৃহহারা হয়ে যায় এবং এর ফলস্বরূপ ঘনঘন বাঙালি বা ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ করে। তারপরও নিজের কাজে লুইনের সততা স্পষ্ট বোঝা যায়। নতুন ও ভালো যে কোনো কিছু তিনি উদারচিত্তে গ্রহণ করতেন। একটা ঘটনা আছে এমন-
"রতন পুইয়ার গ্রামের একটা ঘটনার কথা মনে আছে। একবার আমি তাদের গ্রামে রতন পুইয়ার সাথে কথা বলছিলাম, তখন কোথা থেকে এক হদ্দ মাতাল এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। কিন্তু রতন পুইয়া তাকে তিরস্কার করা দূরে থাকুক, একটা কথাও বলল না। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে পাগড়িটা মাটি থেকে কুড়িয়ে ধুলো ঝেড়ে মাথায় বসিয়ে দিল।
আমি বললাম, 'এটা কেমন ব্যাপার হলো? তুমি তোমার অনুসারীদের বেয়াদবির জন্য শাস্তি দাও না?'
সে রীতিমতো আঁতকে উঠে বলল, 'বেয়াদবি? কী বলছেন সাহেব? সে একটা বদ্ধ মাতাল। তার কোনো হুঁশ নাই। সে কী করেছে নিজেই জানে না। ওটার কথা বাদ দিলে গ্রামে আমরা সবাই সমান। কিন্তু যখন যুদ্ধে যাই তখন সে যদি আমার কথা অমান্য করে সেটার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আছে। এখানে সে নিজের বাড়িতে আছে। ওসবের কোনো বালাই নাই। যে কোনো লোক চিফের বাড়িতে ঢুকে যে কোনো জিনিস নিয়ে আসতে পারে। তাদের কথা হলো-তিনি হলেন আমাদের চিফ। তিনি আরো অনেক উপহার পাবেন। আমাদের কাছে যা আছে সেগুলোও তাঁরই। অতএব তাঁর যা আছে সেগুলোও আমাদের। চিফ যদি আমাদের না দেয় তা হলে আর কে দেবে?' অকাট্য যুক্তি-কোনো সন্দেহ নেই।"
তিনি নিসর্গ পছন্দ করতেন এবং প্রায়ই দুঃসাহসিক বিভিন্ন অভিযানে জড়িয়ে পড়তেন। মাসের পর মাস ঘুরেফিরে একই পোশাক পরে, চড়াই উৎরাই পার হয়ে, খাদ্য স্বল্পতায় ভুগে, দৃঢ় মনোবল নিয়ে লুইন লুসাইসহ বিভিন্ন উপজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কিন্তু একবার সন্ধি স্থাপিত হওয়ার পর তাদের সাথে লুইনের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারাই তার নাম রাখে "থাংলিয়ানা।" লুইন বিভিন্ন বিরূপ পরিস্থিতি তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দ্বারা সমাধান করতেন। বৃটিশদের মধ্যেও কতো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও পেশাগত ঈর্ষা কাজ করতো তার বর্ণনা পড়ে অবাক হতে হয়।
সব মিলিয়ে, "থাংলিয়ানা " দারুণ একটি কাজ। হারুন রশীদের অনুবাদ ও ভূমিকা দুটোই প্রথম শ্রেণির।
লিখেছেন - মুহিবুল ইসলাম
২ এপ্রিল ২০২৪
প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। ভয় আর রহস্যে ভরা গভীর অরণ্যের পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান চালাতে চান বৃটিশ পুলিশের চৌকস কর্মকর্তা থমাস লুইন। সেজন্য তার দরকার ছিল এখানকার আদিবাসীদের সহায়তা। বান্দরবান এলাকার অরণ্যবাসী মুরং সম্প্রদায়ের এক দুর্দর্শ মোড়লকে বাগে এনে কাজে লাাগাতে চান। যার নাম ছিল তোয়েকাম তংলুইন। তাকে কাছে এনে পরিচয়পর্বে মোড়লের নাম শুনেই নিজের নামটা বিকৃত করে পাহাড়িদের মতো উচ্চারণ করে থমাস লুইন বলে ওঠলেন, “আপনি তো আমার পূর্বপুরুষের দিক থেকে আত্মীয় হন। আমার
নাম আরবাট তংলুইন।” এই কৌশলে দারুণ কাজ হয়েছিল। এবং এর জের ধরেই বহু ঘটনা প্রবাহের পর শেষপর্যন্ত তংলুইন নামটা পাহাড়ি সংস্কৃতিতে কিছুটা বিকৃত হয়ে তংলুইন্যা এবং সবশেষে থাংলিয়ানা‘য় রূপান্তর হয়। এভাবেই থমাস হার্বার্ট লুইন হয়ে যান পাহাড়িদের থাংলিয়ানা।
...
১৭৬১ সালে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন জারি হলেও দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। সময়টা ছিল অবিশ্বাস্য অতিলৌকিক গুজবে ঠাসা। জনশ্রুতি ছিল ভারত বার্মার সীমান্তঘেরা বিস্তীর্ণ পার্বত্যভূমিতে বসবাসরত নানান উপজাতির বাসিন্দারা অসভ্য ও হিংস্র এবং ওরা সাপ ব্যাঙ শেয়াল কুকুর আর পতঙ্গই শুধু নয় মানুষকে পেলেও খেয়ে সাবাড় করতে কসুর করে না! ভয়-আতংকে সমতলের কেউ ভুলেও ওই অঞ্চলে পা রাখার দুঃসাহস দেখাতো না। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করেছিলেন এক ব্রিটিশ তরুণ। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬৫ সালে হারবার্ট লুইন নামের এক তরুণ বৃটিশ অফিসার চট্টগ্রামের পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। নিলাভ সবুজের হাতছানি আর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তার কারণে অনেক ঝুকি আর ঝঞ্জার ভেতরে স্বেচ্ছায় প্রবিষ্ট হয়েছিলেন এই তরুণ আফিসার। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ, অভিযান ইত্যাদি কোন কিছুই বাদ যায়নি তার কর্মজীবনে। সেই সুবাদে গুজব এবং ভয়ের এ রাজ্যের সত্যচিত্র সভ্যদুনিয়ার সামনে উন্মোচিত হয়। দিনশেষে শত্রুর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ইংরেজি নাম থমাস হার্টবার্ট লুইন রূপান্তরিত হয় পাহাড়ি নাম থাংলিয়ানায়!
…
বইটিতে রহস্যঘেরা বিশৃংখল অরণ্যবাসী মানুষের জীবন পরিক্রমার নানান স্তরের বা নানান বাকেঁর কথা উপকথাসহ নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রসুত বর্ণনা স্থান পেয়েছে, অরণ্য ও অরণ্যবাসীকে বুঝতে যার সুগভীর তাৎপর্য অনস্বীকার্য। লেখক ব্রিটিশ উপনিবেশ স্বার্থের রক্ষক হলেও তার বর্ণনায় অরণ্যবাসীদের হিংস্রতার তেমন কোন লোমহর্ষক বর্ণনা বইটিতে মূল ফোকাস বা উপজীব্য হয়ে ওঠেনি। দস্যুতা এবং অসভ্যতাই পাহাড়ীদের শুধুমাত্র বৈশিষ্ট্য এমনটা লেখক বলতে চাননি। তার অনেক কথায় পাহাড়িদের সততা এবং সরলতার কথাও উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন ‘ওরা ওদের নিজস্ব আলয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করে। তারা এ চেনা সভ্য জগতের বাইরে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের মানুষ হলেও নিজেদের জীবন নিয়ে তারা সন্তুষ্ট।’
...
চাকরিকালীন (১৮৬৫-১৮৭২) সময়ে নিজের ঝুলিতে সঞ্চিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরল সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিজের কুশলী কলমে লিপিবদ্ধ করেছিলেন থমাস হার্বার্ট লুইন। লন্ডন থেকে ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার স্মৃতিকথা ’A fly on the wheel' নামক বইটি। সেই বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত অধ্যায়গুলোর বাংলা অনুবাদ নিয়েই থাংলিয়ানা। অনুবাদক জনাব হারুন রশিদ অনুবাদের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকতা এড়িয়ে দারুণ মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সাবলীল অনুবাদের কারণে আমার কাছে বইটি সুখপাঠ্য মনে হয়েছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত দুশো পৃষ্ঠার বইটির প্রচ্ছদ, ছাপা সবই সুন্দর। প্রচ্ছদ একেছেন সব্যসাচী হাজরা, বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার কথাপ্রকাশ।
লিখেছেন - রাশেদ স্বপ্ন
২৯ মার্চ ২০২৪
একটু খাঁড়ান, ফর্মালিটি কইরা লই:
আঠারোশ পঁচাশি সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল A Fly On The Wheel নামের একটি স্মৃতিকথা। লেখকের নাম লেফটেন্যান্ট কর্নেল থমাস হারবার্ট লুইন। এডভেঞ্চারপ্রিয় এই ব্রিটিশ ভদ্রলোক তার স্মৃতিকথাটি প্রকাশের কুড়ি বছর আগে চট্টগ্রাম শহরের পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। আজ থেকে দেড়শো বছরেরও কিছু অধিক সময় আগেকার সেই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল বেশ কিছু দারুণ এডভেঞ্চারের। সেই সকল রোমাঞ্চকর অভিযানের এক লিখিত উপাখ্যান এই ‘থাংলিয়ানা’। ‘এ ফ্লাই অন দি হুইল’ মূলত একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে লুইন সাহেবের সমস্ত কর্মজীবনের স্মৃতিকথা। ‘থাংলিয়ানা’ সেই বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে উল্লিখিত অংশগুলোর বাংলা অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন হারুন রশীদ।
ফর্মালিটি শ্যাষ। এখন আসেন বইয়ের আলাপ করি।
থাংলিয়ানা কী:
‘থাংলিয়ানা’ মূলত লুইন সাহেবের পাহাড়ি ডাকনাম। এই নামকরণের পেছনে একটি চমৎকার ইতিহাস আছে। সেটি লিখে ফেলে বইয়ের আনন্দ নষ্ট না করাই ভালো। তবে থাংলিয়ানার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই যেহেতু এই বই, অতএব নামকরণ অতি অবশ্যই নজরকাড়া এবং প্রাসঙ্গিক।
বই কেমন:
এগারো বছর বয়সে আমি জীবনে প্রথমবারের মতো রবিনসন ক্রুশোকে চিনেছিলাম। ড্যানিয়েল ডিফো আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন এক উপকূল থেকে অন্য উপকূল, এক অন্তরীপ থেকে অন্য অন্তরীপ। তারপর গৃহত্যাগী রবিনসন ক্রুশোর সাথে বন্দী করে ফেলেছিলেন জনমানবহীন এক দ্বীপে। অবশ্য রবিনসন ক্রুশোকে নিয়ে আলোচনা এই অব্দিই হতে দেখেছি আমি। কোন এক অদ্ভুত কারণে সেই জনমানবহীন দ্বীপ ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপের মানুষখেকোদের থেকে মুক্তি লাভের পর ক্রুশোর জীবনে ঘটে যাওয়া বাকি এডভেঞ্চারগুলো নিয়ে কেন জানি খুব বেশি একটা কথা হয় না। সে কথা না হলে না হোক। মূল কথা ড্যানিয়েল ডিফো সদ্য কৈশরে পা দেওয়া আমিকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন তাঁর চমৎকার বর্ণনারমূলক লেখা দিয়ে।
আরেকটু বড়ো হলে এলেন বিভূতিভূষণ। আমাকে ধরিয়ে দিলেন ‘আরণ্যক’। তারপর আবারো সেই অদ্ভুত লেখা। সত্যচরণের সাথে নাঢ়া-লবটুলিয়ার সেই ঘন জঙ্গলের মায়ায় আমি বুঁদ হয়ে রইলাম পুরোটা সময়। সেই ঘোর আজও কেটেছে কি না সন্দেহ।
এবার পেলাম ‘থাংলিয়ানা’। সাহিত্যিক মান বিচারে থাংলিয়ানা আরণ্যক কিংবা রবিনসন ক্রুশোর ধারেকাছে যেতে পারে কি না, সেটা বিতর্কের বিষয়। তবে হারবার্ট লুইনের লেখা হোক বা হারুন রশীদের অনুবাদের মুন্সিয়ানা, থাংলিয়ানা আমাকে সেই রবিনসন ক্রুশো আর সত্যচরণের মতো করেই ঘুরিয়ে দেখালো দেড়শ বছর আগেকার পার্বত্য চট্টগ্রাম। যখন রাঙামাটি-বান্দরবানও বিবেচিত হতো অত্যন্ত দুর্গম এলাকা হিসেবে। জ্ঞানবুদ্ধি হবার পর থেকেই এদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের প্রতি একটা প্রবল টান অনুভব করেছি সবসময়। কিন্তু সময়-সুযোগ-অর্থ ও ইচ্ছাশক্তির অভাবের সম্মিলিত আক্রমণে ঘুরে দেখা হয়েছে খুব কম। তবুও যতটুকু দেখেছি, যতটুকু জেনেছি, তা আমার অন্তরে তৃপ্তি আনেনি। আমার বারবার মনে হয়েছে, নিরুদ্দেশ হয়ে মাসখানিক বান্দরবানের গহীনে গিয়ে থেকে আসতে পারলে ভালো হতো। এই দু-পাঁচদিনের অবসরে ওই মায়াবী ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের কতটা কাছে যাওয়া যায়?
সাধ আছে, সাধ্যি নেই, সাধ্যি আছে, সাধ নেই–এর চক্করে পড়ে জীবনে কোনোদিন পাহাড়ের অতটা কাছে যাওয়া হবে কি না, আমি তা জানি না। এমনিতেও অস্থিতিশীল পাহাড়কে তো আমরা স্থিতিশীল রাখতে পারিনি। তাই পাহাড়ে গিয়ে কোনোদিন নিজের দেশে ঘুরতে এলাম বলে মনেও হয়নি। ওখানে বাঙালি আগ্রাসন দেখে নিজেই নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত হয়েছি বারবার।
থাংলিয়ানা আমাকে এই পাহাড়ের গল্প শোনার একটা ছোট্ট সুযোগ করে দিল বলেই তার প্রতি মুগ্ধতার রেশ কাটছে না। লুইন সাহেবের সাথে আমিও ঘুরে বেড়িয়েছি চট্টগ্রামের পার্বত্য পথের উত্তর হতে দক্ষিণে, পথ হেঁটেছি পূর্বে। পাহাড়ি ঘন জঙ্গল পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছি কালাদান নদীর তীরে। আক্রমণাত্মক সেন্দু উপজাতির তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি সেই পার্বত্য বনে গভীর থেকে গভীরে। দেখেছি পাহাড় আর সমতলের কূটনৈতিক সমঝোতা রক্ষার জন্য লুইন সাহেবের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। দেখেছি লুসাই গ্রামে ব্রিটিশ আক্রমণ, শান্তি স্থাপন, লুসাইদের হাতে অপহৃত এক ব্রিটিশ বালিকা উদ্ধার হতে। সমগ্র বইটি পড়ার অভিজ্ঞতাটিই ভীষণ চমৎকার। বিশেষত দূরবর্তী নীলচে পাহাড়গুলোতে ছুটে যাওয়ার ইচ্ছা যখনই লুইনের কলমে প্রকাশ পেয়েছে, ততবার আমার চোখে সেই নীল পাহাড়সারি আর তাদের ওপরে ভেসে থাকা সাদা মেঘের দৃশ্য ভেসে বেড়িয়েছে। একবিংশ শতকের দেখার চোখ আর ঊনবিংশ শতকের দেখার চোখ এক হবে না জানি। তবুও চেনা দৃশ্যেই পুরোনোকে ধরতে চেষ্টা করে গিয়েছি যতক্ষণ বইটি পড়েছি তার পুরোটা সময়।
‘ন’ তে নগদে নেগেটিভ কিছু:
এত সব ভালোর মাঝেও নেহাত বাঙালি বলেই কিছু খারাপ লাগা কাজ করেছে। যতই লুইন সাহেব পাহাড়ে জনপ্রিয় হন না কেন, তার লেখাতে প্রায়শ ঔপনিবেশিক শাসকের মনোভাব অজান্তেই প্রকাশ পেয়েছে। আমার মনে হয়েছে লুইন সাহেব এডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ বলেই তিনি পাহাড়ে গিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করতে পেরেছিলেন। তার বর্ণনায় প্রায়ই একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার প্রবলেম সল্ভিং প্রসেসের কিছু না কিছু বিষয় উঠে এসেছে। তার প্রজাবাৎসল্যতার প্রকাশ তখনই দেখেছি। তবুও কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে এমন স্পষ্টবাদী, জনদরদি একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা কখনই ঔপনিবেশিক শাসন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। বোধ করি এই-ই জাতীয়তাবাদের স্বরূপ। সবকিছুর আগে নিজের দেশ।
বাঙালিদের নিয়ে পর্যাপ্ত বিষোদগার করে গিয়েছেন জনাব লুইন। তা অবশ্য কিছুটা তিক্ত সত্যই বচন করেছেন তিনি। তবে প্রশংসায় ভিজিয়েছেন পাহাড়িদের। সংঘাতের পরেও তাদের প্রতি লুইনের কলমে ঝরেছে শ্রদ্ধা ও সম্মান। একই শাসকের চোখে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে জাতি হিসেবে আমরা কতখানি মেকি আত্মগরিমায় ভুগি।
অনুবাদ নিয়ে দুটি কথা:
অনুবাদের মান নির্ণয়ের ধৃষ্টতা আমার নেই। সাধারণ পাঠক হিসেবে পড়তে গিয়েছি। পড়েছি। আনন্দ পেয়েছি। কল্পনার চোখে ঘুরে বেরিয়েছি বিস্তীর্ণ পর্বতাঞ্চল। আমার কাছে অনুবাদের সার্থকতা এই-ই। হারুন রশীদের প্রতি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা এবং শুভকামনা।
****** **** ****
লিখেছেন - সুচ চাকমা
২৮ মার্চ ২০২৪
থমাস হারবার্ট লুইন ছিলেন ভারতে ইংরেজ সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন লুইন নামে বিশেষভাবে পরিচিত। আমার বাল্যকালেই আমি আমার দাদুর মুখে শুনেছিলাম ক্যাপ্টেন লুইনের নাম। অবশ্য আমাদের গ্রামাঞ্চলে চাকমা উচ্চারণে বলা হতো "লুইন সাপ্যা"। সাধারণত সাদা চামড়ার বিদেশী লোকদেরকে চাকমারা বলে "ফারাঙি সাহ্ব"। আমার ধারণা ইউরোপিয়ানদের অনেকটা শ্বেতকুষ্ঠরোগীর মতো দেখায় বিধায় তাদেরকে ফারাঙি সাহ্ব বলা হয়ে থাকে। কারণ চাকমা ভাষায় কুষ্ঠ রোগকে বলা হয় ফারাঙি। যাহোক, চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, চাকমা সার্কেলের তৎকালীন শাসক কালিন্দী রানির সাথে নাকি বিভিন্ন বিষয়ে ক্যাপ্টেন লুইনের ঝামেলা হয়েছিল। তাই রানি কালিন্দী ক্যাপ্টেন লুইনকে পছন্দ করতেন না। একবার ক্যাপ্টেন লুইন কালিন্দী রানির সাথে দেখা করতে চাইলে রানি নাকি বলেছিলেন—আমি বানরের মুখ দেখতে চাই না। এই কারণে ক্যাপ্টেন লুইন নাকি কালিন্দী রানির ওপর খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। এগুলি লোকমুখে প্রচলিত শোনা কথা।
ক্যাপ্টেন লুইন ১৮৫৭ সালে একজন সামরিক বাহিনীর শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা হিসেবে ভারতে যোগ দেন। এরপর ১৮৬৫ সালে তিনি বদলী হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। এবং ১৮৬৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান। সেই সময় লুসাই, কুকি ও সেন্দু উপজাতীরা প্রায়ই পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ব্রিটিশ শাসিত বিভিন্ন অঞ্চলে এসে লুটতরাজ করত। তারা সাধারন লোকজনদের হত্যা করত এবং শিশু ও নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যেত। ১৮৭১ সালে লুসাইরা কাছাড়ের চা-বাগানের ম্যানেজার জেমস উইনস্টোনকে হত্যা করে তাঁর ১২ বছর বয়সী শিশুকন্যা মেরি উইনস্টোনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরফলে ১৮৭২ সালে চট্টগ্রাম থেকে জেনারেল ব্রাউনলো এবং কাছাড় থেকে জেনারেল বাউচারের নেতৃত্বে একটা দ্বিমুখী অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই অভিযানে ক্যাপ্টেন লুইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন লুইন লে.কর্ণেল পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন।
"A Fly on the Wheel" নামে ক্যাপ্টেন লুইনের একটি বই প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক নির্বাচিত অংশগুলি নিয়ে বাংলায় 'থাংলিয়ানা" নামে অনুবাদ করেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক হারুন রশিদ। বইটি প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালে। অবশ্য একই বিষয়ে রাঙ্গামাটির বিশিষ্ট আইনজীবি অ্যাডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমাও "পার্বত্য চট্টগ্রাম ও লুসাই পাহাড়" নামে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে।
বই দুটিই পাঠকদের ভালো লাগবে আশা করি।
******** ******* ********
লিখেছেন - জালাল আহমেদ
২১ মার্চ ২০২৪
১৯৮৩ সালে যখন খাগড়াছড়ি মহকুমায় আমার পদায়ন হয় তখন অন্তত দু'জন ডেপুটি কমিশনার এর নাম জেনেই যোগদান করতে যাই। তাদের একজন টমাস হারবার্ট লিউইন। টি এইচ লিউইন কে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবদন্তি জেলা প্রশাসক হিসাবেই জানি যিনি ১৮৬৬ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মিজোরামে লুসাই পাহাড় এলাকায় কাজ করে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন।
কিন্তু তিনি এর আগে নোয়াখালী জেলায় পুলিশ সুপার হিসাবে কাজ করেছেন তা’ আমরা অনেকেই জানি না। তা'রো আগে তিনি পুলিশ সুপার ছিলেন বিহারের হাজারিবাগ জেলায়। লিউইন এর পিতা ১৮২৩ সালে প্রথম ব্রহ্ম যুদ্ধে অংশ নেন আর লিউইনও অত্যন্ত কম বয়সে প্রথমে সেনাবাহিনীতে এবং পরে একাধিক জেলায় পুলিশ সুপার পদে কাজ করেছেন। ১৮৬৪ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি বিহার এর হাজারীবাগ থেকে কলকাতা-চট্টগ্রাম হয়ে নোয়াখালী আসেন। নোয়াখালীতে কিছুদিন পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনের পর তার পদায়ন হয় পুলিশ সুপার চট্টগ্রাম পদে। তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা হয়েছে(১৮৬০) কিন্তু ডেপুটি কমিশনার পদের উপযুক্ত কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। কথিত মতে এ জন্য আগ্রহী কর্মকর্তা খোজা হলে লিউইন এ জন্য আগ্রহ দেখান ও ক্যাপ্টেন লিউইন কে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডেপুটি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
লিউইন এই আগ্রহ মন থেকেই দেখিয়েছিলেন কারন এতদঞ্চলের উপর তার জানাশোনা ছিলো যে কারো চেয়ে বেশী। পাহাড়ি জনগনকে তিনি মন থেকেই ভালোবেসেছিলেন এবং তারাও তাকে। এর অন্যতম প্রমান আইজল এর সেই লিউইন স্মৃতি স্তম্ভ। “At Tlabung village right next to the Bangladesh border, 98 km to the west of Lunglei, there is a memorial stone erected to the memory of Captain T.H. Lewin, a courageous and adventurous British pioneer whom the Mizos fondly called Thangliana, or “Man of Great Fame”. Lewin was the Deputy Commissioner of Chittagong Hill Tracts when he entered Mizoram from Tlabung in 1865. He signed a peace treaty with one powerful Mizo chief of that time, Rothangpuia of Thangluah clan, following which he shifted his headquarters from Rangamati to Tlabung. He had many interactions with the Mizo chiefs and is remembered as the first white friend of the Mizos. He even wrote some books about the Mizo people. While he was in Tlabung he married a Mizo girl named Darpuii and they had a son who unfortunately died only a year later. Darpuii refused to go to England with Lewin when he retired from service. Lewin died at the age of 77 in 1916 as Honorary Lieutenant Colonel without any decoration for his great pioneering services. The memorial stone was erected in 1920 by arrangement with his English wife, Margaret Lewin.”
লিউইন চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা ও লুসাই এলাকা মিজোরাম নিয়ে অনেকগুলো বই লিখেছিলেন। আমি বহুদিন অনুসন্ধান করে তাঁর আত্মজীবনী "এ ফ্লাই অন দ্য হুইল অর হাও আই হেল্প গভর্ন ইন্ডিয়া" খুঁজে পাই। সেই বই এ লিউইন এর এতদঞ্চলে অবস্থানের সময়কালের অংশটুকু অনুবাদ করেছেন গবেষক-অনুবাদক Haroon Rashid। তাঁর অনুবাদ অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। এখনকার গুগল ট্রান্সলেটর এর যুগে এই সুলিখিত অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ একটি মহৎ কাজ। এ জন্য লেখক হারুন রশীদ কে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। বইটি ইতোমধ্যে পাঠক আনুকূল্য পেয়েছে। সময়ের সংগে সংগে এই আনুকূল্য বৃদ্ধি পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
******* ****** *********
লিখেছেন- অঞ্জন কুমার দাশ
১৪ মার্চ ২০২৪
চট্টগ্রামের দক্ষিণ পূর্বদিকের দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, পাহাড়ের মানুষ আর ইতিহাস নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে তাঁরা এই বইটি পড়ে দেখতে পারেন। বইটির লেখক পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন।
থমাস হারবার্ট লুইন ভারতবর্ষে আসেন ১৮৫৭ সালে ১৮ বছর বয়সে। নানা ঘাট ঘুরে ১৮৬৫ সালে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। চট্টগ্রাম এসেই পূর্বদিকে দিগন্ত বিস্তৃত নীল পাহাড়ের প্রেমে পড়ে যান। পাহাড়ের ডাক তাঁকে অস্থির করে তুলে।সমতলের বাঙালিদের কাছে খোঁজখবর করতে থাকেন দুর পাহাড়ে কারা থাকে? তারা কেমন মানুষ?
কিন্তু স্থানীয় লোকজন তাঁকে নিরুৎসাহিত করেন। তাঁদের ধারণা ওসব এলাকা সভ্য মানুষের জন্য নয়। ওখানে যাঁরা থাকেন তাঁরা হিংস্র, বর্বর, অসভ্য। মানব জাতির কলঙ্ক। সাপ- ব্যাঙ-কীটপতঙ্গ হতে শুরু করে শেয়াল-কুকুর-হাতি-অজগর হেন কিছু নাই যা ওরা খায় না। কেউ কেউ জ্যান্ত মানুষও কাঁচা খেয়ে ফেলে। তাঁদের কারো কারো এমনকি লেজও নাকি আছে। আবার কারো কারো বাসা বাড়ি বলতে কিছুই নাই বানরের মতো গাছের উপর বসবাস করেন।
নিঃসন্দেহে ভয়াবহ বর্ণনা। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ যেন অন্য ধাতুতে গড়া। লুইন সে রকমই একজন। এতকিছুর পরও তাঁর মনে হয়—❝আমি চাই একটা অজানা পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া, তারপর যা হয় হবে।❞
একদিন ঠিক ঠিক পাহাড়ে ঢুকে পড়লেন ৭ জন পুলিশ, দুজন ভৃত্য ও দুটি হাতি নিয়ে। খাবার দাবার তেমন কিছু নেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন—
❝জীবন কিংবা ভ্রমণে সুখী হওয়ার গোপন রহস্য হলো কোনোটাতেই অনর্থক বোঝা না বাড়ানো।❞
অতএব পথে যা পাবেন তাই খাবেন। কিছু উপহার অবশ্য নিলেন পার্বত্যবাসীদের জন্য।
পরবর্তী কাহিনি রীতিমতো শ্বাসরুদ্ধকর। আপনারা গল্পের রবিনসন ক্রুসোর কথা জানেন। লুইন যেন পাহাড়ের রবিনসন ক্রুসো। পার্থক্য হলো ক্রুসো নিয়তির ফেরে অজানা ভূখন্ড আর অচেনা মানুষের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। লুইনের জড়িয়ে পড়েছিলেন নিয়তির ফেরে নয় বরং বলা যায় তাঁর ক্ষেত্রে এই জড়িয়ে পড়া ছিলো— বাই চয়েজ।
বলাবাহুল্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যে গল্প তিনি শুনেছিলেন এবং এই বর্ণনা যে ভাবমূর্তি তৈরি করে তার সাথে বাস্তবের ফারাক অনেক। অবশ্য খাবারের ব্যাপারে বৈচিত্র্য ছিলো ব্যাপক। কিয়োদের গ্রামে গয়ালের কলিজা কাঁচা খেতে হয়েছে। হুক্কার তলায় জমা হওয়া পানি মুখে নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। ব্যাঙ, গিরগিটি, সুয়োঁ পোকা ভাজি হাসি মুখে গিলতে হয়েছে। এসবই লুইন করেছেন এই জনপদের মানুষের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করতে। শুধু কুকুরের পেটের ভাত আর কুকুরের মাংসটা খািয়া এড়িয়ে গেছেন। তাঁর মনে হয়েছে সবকিছুরই একটি সীমা থাকে যা অতিক্রম করা যায় না। এই খাবারটি তাঁর সেরকম একটি সীমা।
লুইন পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে পারলেও কোথাও কোথাও প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। সেন্দুদের হাতে তো প্রায় মরতে বসেছিলেন। কিভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি আগ্রহীরা বই হতে পড়ে নিবেন। ক্ষুদ্র পরিসরে সে বর্ণনা তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব।
আবার একজন ইউরোপীয়ান চা বাগান ম্যানেজারকে হত্যা করে তার ৬ বছরের কন্যাকে যখন লুসাইরা অপহরণ করে তখন আরেকটি সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। মেয়েটিকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা যায় দারুণ উত্তেজনাপূর্ন একটি অভিযানের ভিতর দিয়ে। সে বর্ণনাও দারুণ উপভোগ্য। এই অভিযানের একটি চরম উত্তেজনাপূর্ন মুহুর্তে দুঃসাহসি লুইন একা গিয়ে যখন লুসাই নেতাদের সাথে আলোচনায় বসে যখন তাঁদের মন জয় করে নেন তখন তারা তাঁর নামটি নিজেদের মতো করে উচ্চারণ করে শ্লোগানের মতো বলে ওঠেনঃ— থাংলিয়ানা....থাংলিয়ানা!!
এখানে উল্লেখ করা যায় রাঙামাটি শহরটি এই লুইনের হাত দিয়ে গড়ে ওঠে। শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক সদর দপ্তর ছিলো চন্দ্রঘোনা।
নিঃসন্দেহে লুইন শাসক উপনিবেশিক শ্রেণির একজন প্রতিনিধি। তাঁর কাজ কর্মের পেছনে অবশ্যই উপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থ থাকবে। কিন্তু তার বাইরে গিয়ে বইটিতে এ এলাকার মানুষদের প্রতি তাঁর যে মায়া মমতা ফুটে উঠেছে সেটাও অসাধারণ। প্রায় ১৫০ বছর আগে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা এই বইটি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখা প্রথম দিকের একটি মৌলিক বই।
মূল বইটির নাম A fly on the wheel, ❝থাংলিয়ানা❞ নামের এই অনুবাদটি মূল বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট অংশগুলোর অনুবাদ। অনুবাদক হারুণ রশিদের অনুবাদ হয়েছে অসাধারণ। এরকম অনুবাদ সচরাচর পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রামের পূর্ব অংশে কিভাবে রাষ্ট্র প্রবেশ করল এই ইতিহাস যাঁরা জানতেন চান তাঁদের জন্য এই বই অবশ্য পাঠ্য।
No comments:
Post a Comment