Thursday, February 25, 2010

একজন সামান্য মানুষের অসামান্য তৃপ্তি

অর্থে দরিদ্র মানুষদের ভুলে থাকার মতো সাধারন স্বার্থপর মানুষ হয়েও পাশের গ্রামের অষ্টম শ্রেনী পাশ সামান্য একজন আবসার হোসেনকে আমি ভুলতে পারিনা যে কারনে সেটাই বলবো এখন।

আবসার হোসেনকে খুবই সামান্য একটা চাকরী পেতে সাহায্য করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। বেতন ছিল মাত্র ১২০০ টাকার মতো। চাকরীটা পেয়ে শহরের কোথাও মেস নিয়ে বসবাস শুরু করে সে। আর আমি নিশ্চিন্ত হই একটা মানুষের উপকার হলো ভেবে। কিন্তু দুমাস যেতেই আবসার একদিন আমার কাছে এসে হাজির। আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই ঝামেলা পাকিয়েছে কোন, এখন প্রতিকার চাইতে এসেছে। মনে মনে আগেভাগেই বিরক্ত হওয়া শুরু করলাম। ব্যাটাকে চাকরী পাইয়ে দিয়ে ঝামেলার রাস্তা বের করলাম নাকি?

কিন্তু আমার স্বার্থপর চিন্তাটাকে লজ্জায় ফেলে আবসার একগাল সরল হাসি হেসে বললো, "স্যার বেতন পাইছি। গতমাসেও পাইছি। চাকরীটা খুব ভালো, আমি ভালো আছি।" আমার বুক থেকে ভার নেমে যায়। যাক কোন ঝামেলা পাকায়নি।

আরো দুতিন মাস পর আবারো এলো আবসার। ভাবলাম, এবার নির্ঘাত ঝামেলা হবে। কিন্তু এবারও সে আমাকে দুর্ভাবনামুক্ত করে। বোকার মতো হাসি হাসি মুখে বলে, "স্যার চাকরী ভালো চলছে, খুব আরামে আছি।" আমি হাঁপ ছাড়ি।

ছমাস কোন খবর নাই। তারপর একদিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখলাম ওকে। এবার বুঝি রক্ষা নাই, নিশ্চয়ই বিরাট কোন ঘটনা হবে। চেহারায় মলিনতা দেখা যাচ্ছে ওর। কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, "কি রে, কোন সমস্যা হইছে?"

"একটু সমস্যা হইছিল স্যার। বাড়ী গেছিলাম বিষুদবার, শনিবার আসতে পারি নাই, রোববার আসার পর বসের বকা খাইছি, একদিনের বেতন কাটা গেছে" কিছুটা বিমর্ষ সুরে বললো।

এইবার আমি সত্যি চিন্তায় পড়লাম। ব্যাটা কাজে ফাঁকি দিয়ে বাড়ী যাবে, আর আমাকে আমাকে বেতন না কাটার সুপারিশ করতে হবে। নতুন ঝামেলা দেখি! কিভাবে পাশ কাটানো যায় দ্রুততম বেগে ভাবতে লাগলাম।

কিন্তু এইটা আবসার। আবারো আমাকে বিপদমুক্ত করে তার শেষ কথাটি দিয়ে।

'কোন সমস্যা নাই স্যার, বেতন কাটা গেছে আমার দোষে, চাকরী তো কাটা যায় নাই। আমি ভালো আছি। যাই কাজে যাই......'। এবারও সেই দিলখোলা হাসি দিয়ে চলে যায় আবসার।

আমি তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে সুক্ষ্ণ একটা ঈর্ষা আর ভালো লাগায় ভুগি। তার চেয়েও বেশী বিস্ময়। এত অল্পে এতটা তুষ্ট হবার যাদুটা কি? আবসারের টাকা নাই কিন্তু তুষ্ট হবার সেই দুর্লভ ক্ষমতাটা আছে। আমার টাকা আছে কিন্তু অল্প নিয়ে সুখী হবার সেই ক্ষমতাটা নাই। তাহলে মানুষ হিসেবে আবসার বড় নাকি আমি? আমার চিন্তার কোন সমীকরন মেলাতে পারি না। কেবল দুরে হেঁটে যাওয়া ছোটখাটা কিন্তু তৃপ্ত মানুষ আবসারকে আমার চেয়ে অনেক বড় মনে হতে থাকে।

No comments: