তোকে যেন কতযুগ লিখিনি!! কত বছর হলো আজ? ডাক পিয়নের যুগ শেষ হবার পর আমাদের চিঠি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
আজকাল চিঠি পাঠাতে ডাকপিয়নের সাহায্য লাগে না, পোষ্ট অফিসে যেতে হয় না, ষ্ট্যাম্প কিনে লালা ভিজিয়ে টিপে লাগিয়ে দিতে হয় না। কিবোর্ডে আবজাব টাইপ করে ঠিকানা লিখে ক্লিক করলেই হয়ে যায়। আমি তো তোর ইমেইল ঠিকানা জানি না। ডাকপিয়নের যুগ শেষ হবার পর তুইও কোথায় হারিয়ে গেলি। আমি তোকে আর খুঁজি না, তুইও খুঁজিস না।
সময় মানুষকে কত বদলে দেয়! একটা দিন গেছে মনে হতো তোর চিঠি না পেলে আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে, ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে যাবে। আমি আর কাউকে চিঠি লিখতাম না তোকে ছাড়া। আমার এত বন্ধু ছিল, কিন্তু চিঠি বন্ধু ছিলি একমাত্র তুই। আমাদের কতশত চিঠি যে বানের জলে গেছে ভেসে!! বানের জল না এলেও সময়ের বন্যায় হারিয়ে যেত অবশ্যই। কে কাকে মনে রাখে অতযুগ। আমি তবু ভুলি না তোর আবেগ ছোঁয়া চিঠিগুলোর কথা। সুযোগ থাকলে বাঁধিয়ে রাখতাম জীবনের পড়ন্ত বেলায় পড়ার জন্য। আজ হঠাৎ কেন যেন আমি তোর চিঠির জন্য তৃষ্ণার্ত হলাম। তোর কি কোন বিষন্ন বিকেলে মনে পড়ে সেই চিঠিযুগের কথা?
চিঠিটা তুই পাবিনা। তবু কোন একটা দৈবযোগ যদি তোকে হাজির করে ব্লগের ভেতর? হাজার মানুষের মধ্যে তো কেউ একজন তুই হতেও পারিস। সেই সম্ভাবনায় এলোমেলো কথা দিয়ে চিঠি সাজালাম। কি লিখবো সাজাতে পারছি না বলে এলেবেলে করে দিলাম ইচ্ছে মতো। তুই আমার তুচ্ছ চিঠিকে উচ্চ করে পড়তে পারতিস, এখনো কি পারবি? তুই ছিলি আমার জীবন্ত ডায়েরী কিংবা রেকর্ডার। পুরোনো অভ্যেসমতো তাই আমার ডায়েরীর লেখাই তোকে কপি করে দিলাম-
১. তথাকথিত সমসাময়িক কালকে বাদ নিয়ে ভিন্ন একটা কালে অবস্থা করতে পারলে মনের অনেক যন্ত্রনা লাঘব হয়। কখনো সুদুর অতীত, অথবা অনাগত শতাব্দীতে উড়ে গিয়ে চুপ করে সময়, কাল, মানুষের পরিবর্তন দেখা যেত যদি! আমাদের বর্তমান আমাদের অহেতুক ভোগায় নানান যন্ত্রনায়। বর্তমান থেকে পালিয়ে থাকার জন্য কেউ নেশাহত হয় পানীয় কিংবা ইনজেকশানে। বর্তমান থেকে পালানোর কাপুরুষ প্রবনতা সামাজিক অনাচার বৃদ্ধি করে, কথাটা কতটা সত্য কে জানে?
২. রাজনীতি দুষ্টচক্রে আবদ্ধ বলে রাজনীতির দিকে ফিরে তাকাতেও ইচ্ছে করে না। পালিয়ে থাকা কোন সমাধান নয় তবু স্বার্থপরতা ভর করে প্রচন্ডভাবে। সহপাঠি কিংবা সহযোদ্ধার অধঃপতন যতটা কষ্টের প্রতিপক্ষের অধঃপতন ততটাই যেন আনন্দের। প্রতিপক্ষের যন্ত্রনা আরো কতটুকু বৃদ্ধি করা যায় সেই প্রচেষ্টার গোড়ায় জল ঢালতে ঢালতে নিজের ঘরকেও প্লাবিত করে যাই বেখেয়ালে। সুযোগসন্ধানী অপশক্তির হাত তাই শক্তিমান হতেই থাকে। যার দুষ্টচক্রে আটকে থাকে সমাজ, রাজনীতি, মায় অর্থনীতি পর্যন্ত। মুক্তি পাওয়া আদৌ সম্ভব? প্রপিতামহ পায়নি, পিতামহ পায়নি, পিতাও না, আর নিজেও পাবো না নিশ্চিত। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এক জীবন অন্ধকার রেখে যাবো?
৩. উপমহাদেশে ইংরেজের দুশ বছরের শাসন আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়েছে? আমরা ইংরেজ বিতাড়িত করেছি বলে গর্ব করি। আসলেই কি ইংরেজ বিতাড়িত করেছি নাকি দুদুটো বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা বৈশ্বিক রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বলে ইংরেজ হাত গুটিয়ে চলে গেছে। নইলে বিতাড়িত ইংরেজের দমবন্ধ কালো কোট আমাদের হাকিমের ঘাড়ের উপর কি করে চেপে বসে থাকে ষাট বছর পরেও?
৪. সভ্যসমাজে মানুষের ভরসার/শৃংখলার তিনটি স্থান - হাসপাতাল, থানা, বিচারালয়। তিনটি জায়গায়ই মানুষ সংকুচিত/ভীত/অপদস্থ এই দেশে। আমরা কি সভ্য দেশের নাগরিক?
৫. প্রযুক্তি প্রকৃতিকে নিধন করছে। চাল-ডাল-ফল-মূল বৃক্ষলতা থেকে পশুপাখি পর্যন্ত এর শিকার। হাইব্রীড আর জেনেটিক প্রযুক্তির প্রাদুর্ভাব চারদিকে। টমেটোর ঘ্রান থেকে পদ্মার ইলিশের ঘ্রান পর্যন্ত বদলে গেছে। আমার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে ওশিন টিভি রিমোট থেকে ল্যাপটপের বাটন পর্যন্ত শিখে ফেলেছে, কিন্তু তাকে কখনোই দিতে পারবো না দেশীয় টমেটোর মৌ মৌ সেই ঘ্রান যা লুপ্ত হয়ে গেছে প্রযুক্তির হাইব্রীড অত্যাচারে। প্রকৃতির যা হারিয়ে যায় তা কি ফিরে আসে আবার?
৬. সীমিত জ্ঞানে একটা মাত্র গ্রহকে জীবজগতের বাসযোগ্য বলে জানি। সেই নীল আকাশ সমৃদ্ধ সবচেয়ে সুন্দর পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে না পারলে মানুষ কোথায় যাবে? শিল্পের অসুস্থ প্রবৃদ্ধি প্রকৃতিকে করছে ভারসাম্যহীন। প্রকৃতি ভারসাম্য হারালে প্রতিশোধের ছোবলের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতেই হবে। প্রযুক্তি দিয়ে কি এই প্রতিশোধ শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যাবে? নাকি 'যোগ্যতমের জয়' সমীকরনে মানুষ নামের প্রজাতির বিলুপ্ত ঘটবে এক সহস্রাব্দের ব্যবধানে?
কোন প্রশ্নেরই কোন উত্তর হয় না। অনির্দিষ্ট আকাশের দিকে ছুড়ে দেই প্রশ্নমালা!! তোর ডায়েরীতেই থাকলো না হয় আজ!
বন্ধু, তুই কি বুঝিস আজ কেন আমার খুব মন খারাপ? আজ কি সেই বিশেষ দিন? তুই পাশে থাকলে ঠিক বুঝে নিতি কেন আমার মন খারাপ। তাই তোকেই লিখছি। চিঠিটার উত্তর আশা করি না, তবু যদি চোখে পড়ে উত্তর দিস, যদি উত্তর থাকে।
যেখানেই থাকিস নিরন্তর ভালো থাকিস। আমার ছদ্মনাম দেখে আমি কে নাম দেখে না চিনলেও প্রশ্নগুলোই আমাকে চিনিয়ে দেবে তোকে। নাম বলে তাই তোকে, আমাকে বিব্রত করলাম না এই অসময়ে।
No comments:
Post a Comment