Sunday, March 20, 2016

মানবিক দুষ্টচক্র

প্রতিটি মানুষ একেকটি চক্রে আবদ্ধ। যে যার চক্রে জনমভর ঘুরে মরতে থাকে। একেকটা মানুষের চক্র একেক রকম। প্রতিটি চক্রই যেন একেকটি পূর্বনির্ধারিত নিয়তির সৌরজগত। নিয়তি মানে কী? যা থেকে সে বের হতে পারে না? যেখানে তাকে অনিবার্যভাবেই ঘুরতেই হবে চিরকাল?

কারো কারো এই চক্র ভাঙ্গার ক্ষমতা থাকে, নিজের ভেতরেই সুপ্ত থাকে চক্র ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার শক্তি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ হয়তো সেই শক্তিকে দেখতে পায় না। কেউ ধন সম্পদের চক্রে ঘোরে, কেউ ক্ষমতার চক্রে ঘোরে, কেউ বা নিরাশার।

মানুষ খুব অসহায় একটা প্রাণী। শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান নিয়েও মানুষ কোথাও কোথাও খুবই হীন। নিজের হীনতাকে না দেখার একটা প্রবণতা সব মানুষের থাকে, কিছু মানুষ থাকে একদমই অন্ধ। চোখ আছে ঠিকই, সেই চোখে নিয়মিত তাকানোর কাজটা করেও, কিছু কিছু ব্যাপার দেখে না। তারা চোখ মেলে তৃতীয় অবস্থানে দাঁড়িয়ে চাইলে নিজের ভুলগুলি সনাক্ত করতে পারে। কিন্তু এক দুর্বিনীত অহংবোধ সেই ভুলগুলোকে সনাক্ত করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে বিনয় থাকতে পারতো, সেখানে থাকে বিনয়ী অহংকার। সুস্থ আত্মাকে ধ্বংস করার পথে বিনয়ী অহংকারের জুড়ি নেই। শ্রেষ্ঠ প্রাণীত্বের অস্তিত্ব নিয়ে আত্মশ্লাঘায় ভোগা মানুষ এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মুক্তি পায় না। চক্র ভাঙ্গার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে তখন হাতপায়ে বেড়ি নিয়ে নিজের সৃষ্ট যন্ত্রণার জালে আটকে থাকে। মানুষের এই পরিণতিটা মর্মান্তিক।

অন্যন্য প্রাণীর মতো মানুষের আয়ুও খুব সীমিত। সেই সীমিত আয়ুতেও মানুষের চরিত্রের ক্রমাগত বিবর্তন ঘটতে থাকে। দশক দশক ধরে মানুষ এক রকম থাকে না। বয়স, পরিবেশ, সামাজিক অবস্থান ভেদে মানুষের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কিছু কিছু পরিবর্তন শুভশক্তির  উত্থান ঘটায়, কিছু কিছু পরিবর্তন অশুভ পথে চালিত করে। এই পরিবর্তনগুলোর যে সমস্ত অনুঘটক সক্রিয় তা সবসময় মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আবার কিছু কিছু অনুঘটক মানুষ নিজের কর্মফলেই তৈরী করে। উন্নতি বা অবনতি দুই ক্ষেত্রেই এই অনুঘটকের ভূমিকা থাকতে পারে।

নিয়তি বিতর্কে দুটো উপাদানকে জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। একটি হলো জন্মগত অবস্থান আরেকটি হলো কর্মযোগ। জন্মগত অবস্থানে মানুষের কোন হাত থাকে না, কিন্তু কর্মযোগ সম্পূর্ণই নিজস্ব সৃষ্টি। মানুষ যে পথ দিয়ে অগ্রসর হয় সেটাকে কর্মযোগের ফলাফল বলা যায়।

ভবিষ্যত একটি রাস্তার নাম, যে রাস্তায় কতগুলো বাঁক আছে, কতগুলো খানাখন্দ আছে আমরা জানি না। কিন্তু আমরা এটা জানি যে বাঁকটা বেশী ঘোরালো হলে সেখানে গতি কমাতে হয়, যদি খানাখন্দ দেখি সেটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। এখন আমি সামনে বাঁক দেখেই যদি গতি না কমাই তাহলে আমার দুর্ঘটনায় পড়ার যে সম্ভাবনা তাকে আমি জন্মদোষে দুষ্ট করতে পারি না। খানাখন্দ দেখেও যদি আমরা তাতে পা বাড়াই তাহলে হোঁচট খাবার জন্য নিয়তিকে দোষী করতে পারি না।

তবে ভিন্ন ঘটনাও ঘটতে পারে। আমি কোন বাঁকে পৌঁছে নিয়ন্ত্রিত গতিতে অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও উল্টোদিকের অনিয়ন্ত্রিত গতির বাহন দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। সেটাকে বলা যায় দুর্ভাগ্য অথবা অনির্ধারিত দুর্ঘটনা।

ভুল থেকে কোন মানুষই মুক্ত নয়। কিন্তু পুনরাবৃত্ত ভুলকে কী বলা যায় যদি তা নিউটনের প্রথম সুত্রের মতো ঘটতেই থাকে। পদার্থের ব্যাপারে নিউটনের প্রথম সুত্রটিকে মেনে নেয়া গেলেও মানুষের ক্ষেত্রে সেটা মেনে নেয়া কঠিনই। মানুষের শ্রেষ্ঠতা এখানে কিছুটা কম্প্রোমাইজড হয়ে পড়ে। যেসব ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা ঘটে সেটাকে দুষ্টচক্র হিসেবে অভিহিত করা যায় ঠিক, কিন্তু মানুষই সেই দুষ্টের বীজ।

শেষ করছি ধার করা দুটো লাইন দিয়ে।
মধ্যযুগের সন্ত কবীরের দুটো লাইন পড়লাম জ্যোতির্ময় নন্দীর বাংলা অনুবাদে-

"খারাপ খুঁজতে গিয়ে দেখি, খারাপ মিললো না কেউ,

যেই নিজ মন খুঁজে দেখি, আমার চেয়ে খারাপ না কেউ।"


আমরা বিশাল সংখ্যক মানুষ এরকম খারাপে পরিপূর্ণ। তবু সাহস করে সত্যটা বলতে পারি না, চেপে রাখি সাধু সাজার বাসনায়। যারা চেপে রাখে না, যারা সত্যটা বলতে পারে তারা কর্মযোগে খারাপ হলেও নিশ্চয়ই সকল ভণ্ডামি থেকে মুক্ত। কিন্তু তাদের সংখ্যা মানব সমাজে এতই ক্ষীণ যে আমাদের দৃষ্টিসীমায় তারা সহজে আসে না।


No comments: