Saturday, January 4, 2014

অসভ্য রাজনীতির অপ্রিয় বাস্তবতা সমূহ

আমি রাজনীতি করি না, কিন্তু রাজনীতির বর্জ্য পদার্থসমূহ আমাকে ভোগায়, আমার জীবনযাত্রা ব্যহত করে, পদে পদে আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় তুই এই দেশের নাগরিক, এই দেশের সর্বনাশ হলে তোরও কিছু যায় আসে।


সুতরাং রাজনীতি না করেও রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হয় আমাকে।


সক্রিয় রাজনীতি না করলেও মনে মনে রাজনৈতিক দলগুলোর এজেণ্ডার পক্ষে বিপক্ষে নিজস্ব মত থাকে প্রত্যেক সচেতন মানুষের। সেখান থেকে খানিকটা নির্ঝাস-


বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে?


এই প্রশ্নটা হরদম শুনে থাকি আশেপাশের মানুষদের কাছে। এরা সবাই এক মতের মানুষ না। নানান মতের মানুষ হলেও আশংকা একটাই। দেশের সর্বনাশ। তবে যে যার মতো করে আশংকার ভিত্তি তৈরী করে নিয়েছে। যেটাকে তিন ভাগ ভাগ করা যায়-


১. এই দল মনে করে, দেশটা ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। যেনতেন একটা নির্বাচন দিয়ে তাই ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। যে কোন মূল্যে এই সরকারকে হটিয়ে জামাত বিএনপির সরকার গঠন করা উচিত। প্রয়োজনে আরো একটা ১৫ই আগষ্ট হবে।


২. আরেক দল মনে করে, বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায় জামাত বিএনপি। দেশে জঙ্গী চাষ করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে ওরা। বিএনপি জামাতকে কিছুতেই আর ক্ষমতায় যেতে দেয়া উচিত নয়। যে কোন মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে হবে।


৩. উপরের দুই দলের বাইরে একটা দল মনে করে হাসিনা খালেদা দেশটার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। দেশে একটা তৃতীয় শক্তি আসা দরকার। সেটা ইউনুস হোক বা মিলিটারী হোক আপত্তি নেই।


প্রথম দলের আশংকাটা শুনছি গত ত্রিশ বছর ধরে(যাদের বয়স আরো বেশী তারা আরো আগ থেকেই শুনতে পারেন)। কিন্তু দেশ এখনো ভারতের হাতে যায়নি দেখতে পাচ্ছি। মসজিদে কখনো উলুধ্বনিও শোনা যায়নি। হ্যাঁ, বাণিজ্যিকভাবে আমরা ভারতের কাছে এখনো পরাজিত, কিন্তু সেটার জন্য বাংলাদেশের সবগুলো সরকারকে দোষ দেয়া যায়। দোষ দেয়া যায় যারা বাংলাদেশকে ভারতীয় গাড়ির বাজারে পরিণত করেছে তাদের। দোষ দেয়া যায় ভারতের টিভি চ্যানেল না দেখলে যাদের ভাত হজম হয় না তাদের। কিন্তু আওয়ামী লীগকে দোষ দিতে পারি না। কারণ আওয়ামী লীগ বলেনি ভারতীয় গাড়ি কেনো, ভারতীয় শাড়ি থ্রিপিস পরো, ভারতীয় টিভি চ্যানেলে গড়াগড়ি খাও।

দ্বিতীয় দলের আশংকাটা শুরু হয়েছে ২০০১ সালের পর থেকে। বাংলাদেশকে আফগানিস্থান বানাবার শ্লোগান রাজপথে শোনা যেতে শুরু করেছিল তখন থেকেই। বাংলাভাইদের জন্ম হয়েছিল সেই সময়েই। সভা সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, বোমা হামলা করে রাজনৈতিক নেতা থেকে সাংস্কৃতিক কর্মী হত্যা সব শুরু হয় এই সময়ে। বাংলাদেশ এখনো আফগানিস্তান না হলেও সেই লক্ষ্যে কাদের পদযাত্রা সেটা আমরা ২০১৩ সালের বছরজুড়ে দেখেছি।

তৃতীয় মতের দলটাকে সমসাময়িক ভাষায় বলা হচ্ছে 'সুশীল'। এই দলের লোকদের যাতায়াত টক শোর টেবিল পর্যন্ত হলেও এদের কারো কারো ষড়যন্ত্রের হাত বিলাত আমেরিকা পর্যন্ত লম্বা। অবশ্য অনেক সাধারণ মানুষের মুখেও শোনা যায় এই দুই দলকে বাদ দিয়ে একটা তৃতীয় শক্তি দরকার। কিন্তু সেই তৃতীয় শক্তি হিসেবে কে আসবে সেটা নিশ্চিত নয়। এসব মানুষ হয়তো কোন একজন প্রমিথিউসের অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশকে যে নিরবিচ্ছিন্ন সমৃদ্ধির পথ দেখাবে।


আমিও ভাবি, বাংলাদেশটা কোন পথে যাচ্ছে। আমি কি চাই?


বাংলাদেশে একটা ব্যাপার দেখি। মুক্তিযুদ্ধের ইস্যু নিয়ে কথা বললে ধরে নেয়া হয় লোকটা আওয়ামী লীগ। ডারউইনের কথা বললে ধরে নেয়া হয় লোকটা কমিনিষ্ট। 'আমি নিরপেক্ষ' বললে ধরে নিতে হয় লোকটা ছুপা ছাগু।


আমি কি চাই জিজ্ঞেস করলে প্রথমে বলি আমি চাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ক্ষমতায় থাকুক। (আমি নিশ্চিত আমি এখন আম্লিগ হয়ে গেছি)। তারপর বলি আমি চাই বাংলাদেশে কোন ধর্মান্ধের জায়গা হতে পারে না, ক্ষমতায় তো নয়ই (সাথে সাথে আমি হয়ে যাই কমিনিষ্ট)। তারপর আমি বলি বাংলাদেশে কমপক্ষে দশ বছর সক্রিয় রাজনীতি বন্ধ রাখা উচিত। এই দশ বছরে একটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকবে। এই দশ বছর আমরা নিজেদের ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকবো। তারপর আবারো শুরু হবে রাজনীতি, আবারো গণতন্ত্র।(এটা শুনে অবশ্য বাকশালী গন্ধ পেয়ে যাবে কেউ কেউ)।


বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪২ বছর হলো। গণতান্ত্রিক আমল বলা হয় ৯০ পরবর্তী সময়টাকে। অনেকে বলে আমরা এখনো শিশু গণতন্ত্র। সময়ে ঠিক হয়ে যাবে। আমেরিকার শত বছর লেগেছিল। বৃটেনের হাজার বছর। ভারতের পৌনে এক শতক পূর্ণ হবে শীঘ্রি। সুতরাং বাংলাদেশ নিতান্তই নাবালক। তাদেরকে সময় দিতে হবে।


স্বর্নাক্ষরে লিখে রাখতে পারেন, বিদ্যমান জাতের 'শিশু গণতন্ত্র' চর্চা অব্যাহত থাকলে আগামী এক হাজার বছরেও আমরা বৃটেন আমেরিকা ফ্রান্সের মতো সভ্য গণতন্ত্রের দেখা পাবো না। বেড়া যখন ক্ষেতের ফসল খাওয়াকে তার গণতান্ত্রিক অধিকার মনে করে, সেই গণতন্ত্রের কোন ভবিষ্যত নেই। সুতরাং বাংলাদেশে সুস্থ গণতন্ত্রের কোন সম্ভাবনা আমার জীবদ্দশায় নেই এমনকি আমার পুত্র প্রপৌত্রের জীবদ্দশায়ও থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।


আমি এবং বাংলাদেশ কেউ এদেশে সুস্থ গণতন্ত্র দেখিনি। মাঝে মাঝে কিছু গণতান্ত্রিক হুজুগ দেখেছি মাত্র। অতি দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে গত চার মেয়াদের গণতন্ত্রকে আমি যথাযোগ্য সম্মান দিতে অক্ষম। বড়জোর তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার বলতে পারি। যে গণতন্ত্রে সংসদের কোন ভূমিকা থাকে না, যে গণতন্ত্রে বিরোধী দল সংসদে যায় না, যে গণতন্ত্র শুধু পাঁচ বছরে একবার নির্বাচনী হাতিয়ার, সে গণতন্ত্রকে তথাকথিত না বলে উপায় থাকে না।

এখানে মুখে যারা গণতন্ত্রের কথা বলেন তারা আসলে মনে মনে ক্যান্টনমেন্টকে তোয়াজ করেন, আমেরিকাকে তোয়াজ করেন, সৌদি আরবকে তোয়াজ করেন। নির্বাচন, গণতন্ত্র, সংবিধান ইত্যাদি ক্ষমতা দখলের ভাওতাবাজি মাত্র। এখানে গণতান্ত্রিক রাজনীতির উসিলায় কেউ ধর্ম বিক্রি করে, কেউ মুক্তিযুদ্ধ বিক্রি করে, কেউ বিক্রি করে প্রিয় স্বজনকে।

এই অবস্থায় একটা নির্বাচন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনটা বাংলাদেশের জন্য কিরকম মাইল ফলক হবে জানি না। কিন্তু এটা বাংলাদেশে আরেকটা অদ্ভুত নির্বাচনের নজির হয়ে থাকবে। কিন্তু উপায় কি? সমাধান হতে পারতো? সম্ভবতঃ না।

বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ার অন্যতম কারণ জামাতে ইসলামী। জামাতের নির্বাচনী এজেণ্ডা নেই। নির্বাচন করার অধিকার তাদের নেই। ফলে তারা বরাবরের মতো নৈরাজ্যের পক্ষপাতি। আন্দোলনের নামে তারা দেশব্যপি তাণ্ডব আর নৈরাজ্য চালিয়েছে, গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছে। এই সবকিছুর মূল কারণ জল ঘোলা করা। এই দলটি ঘোলা জলে মাছ শিকারে সিদ্ধহস্ত।

এবারের ঘোলাজলে তারা কি শিকার করতে চায় আমাদের জানা নেই। তবে সেটা আর যাই হোক, গণতন্ত্র নয়। তারা আরেকটি সিরিয়া কিংবা আফগানিস্তানের স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্নটি বাংলাদেশের আজীবন লালিত স্বপ্নের বিপরীত। সেই স্বপ্ন কি বাস্তবায়িত করতে পারবে ওরা?

মনে হয় না। বাংলাদেশের মানুষ তা হতে দেবে না।

No comments: