আমি জীবনে কোন কিছুই মন দিয়ে করিনি। যখন যা করেছি হয় হুজুগ নয় খামখেয়াল। ফলে আমার কিছুই হওয়া হয়নি। ব্যর্থ মানুষের দলে ভিড়ে গেলাম কখন নিজের অজান্তে।
আমি কখনোই ভালো ছাত্র ছিলাম না। স্কুলে আমার পছন্দ ছিল তৃতীয় বেঞ্চ। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর তৃতীয় বেঞ্চের দিকে ঝোঁক লাগে। শহীদুল্লাহ স্যারের টেবিল দাবড়ানো বেতের শব্দটা কানের মধ্যে অসহ্য লাগতো কিংবা যখন তখন পিঠের উপর এসে পড়বে কেবল সেই ভয়ে নয়, বরং আরো কিছু হীনমন্যতা সেই ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভালো ছাত্রদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতো।
ক্লাসের ফার্স্ট আর সেকেণ্ড বয়ের সাথে আমি কখনোই বন্ধুতা করতাম না। আমার বন্ধুতা শুরু হতো থার্ড বয় থেকে। এখানেও তৃতীয়ের প্রতি আমার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। স্কুল পার করেছি তৃতীয় বেঞ্চে বসেই।
স্কুল শেষ করে যখন কলেজে গেলাম তিনটা সেকশান পেলাম। এস-১, এস-২, এস-৩। কিন্তু ভুল ক্রমে(!) আমাকে ভর্তি করানো হয় ভালো ছাত্রদের সেকশান এস-১ এ। ব্যাটে বলে হয় না সেখানেও। এস-১ এ ক্লাস করলেও আড্ডা মারি, সিনেমা দেখি এস-৩ সেকশানের ছেলেদের সাথে। সবাই মিলে মিশে ফেল করার প্রতিযোগিতায় নামলাম জামাতের সাথে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মিছিলে যেত একটা দল, আমরা ছিলাম সেই দলে। আবার মিছিল ফাঁকি দিয়ে লায়ন সিনেমার ব্যালকনিতে উঠে যেতো বারোটার শোতে আরেকটা দল, আমি ছিলাম সেই দলেও। এখানেও তৃতীয় পছন্দ।
কলেজের রোমাঞ্চকর দিনগুলো শেষ করলাম চুড়ান্ত ফাঁকিবাজি দিয়ে। এরপর এলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। এখানেও দেখি লিষ্টি প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় পছন্দ। এবার সেধে আর তৃতীয় পছন্দে গেলাম না। প্রথম আর দ্বিতীয় পছন্দে পরীক্ষা দেবার জন্য ফরম পুরন করলাম। কিন্তু বিধি বাম। ভর্তি পরীক্ষার হলে বসে প্রশ্নমালায় চোখ বুলিয়ে কেন যেন পছন্দ হয়ে গেল তৃতীয় পছন্দের প্রশ্নগুলো। তখন এক সাথে প্রশ্ন এবং পরীক্ষা হতো সবগুলো ইউনিটের। পরীক্ষার হলে বসেই আমি আমার দিগদর্শন যন্ত্রের মোড় ঘুরিয়ে দিলাম তৃতীয় পছন্দে। কাজটা গর্হিত না হলেও খানিকটা আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু আমার তৃতীয় পছন্দের কপালজোরে পেয়ে গেলাম এতদিন পড়ে আসা বিষয়ের সম্পূর্ন বিপরীত একটা সাবজেক্ট যার বিষয়বস্তু আমার চোদ্দপুরুষের কেউ পড়েনি।
প্রথমদিন ক্লাসে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জার্নাল মানে জাবেদা কেন হলো মাজেদা না হয়ে। আমার উৎকট মূর্খামি দেখে প্রফেসারের চোখ কপালে উঠে যাবার উপক্রম। স্কুল বয়স থেকে জেনে আসছি ভার্সিটিতে ছাত্র শিক্ষক ভাই বন্ধুর মতো। প্রথম ক্লাস শেষে এক ঘন্টার বিরতি, সেই বিরতিতে করিডোরের একপাশে তরুন এক শিক্ষককে বিড়ি ফুঁকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলি, ভাই আগুনটা.......। তিনি বিমূঢ় হয়ে লাইটার হাতে তুলে দিলেন, সিগারেট ধরিয়ে থ্যাংকু বলে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।
পেছনে তাকিয়ে যে দৃশ্যটা দেখতে পেতাম সেটা ভেবে এত বছর বাদে শিউরে উঠছি। পরে জেনেছিলাম এই ঘটনা পুরো ডিপার্টমেন্টে ফিসফাস তুলেছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যত বড় বেয়াদব সে ততবড় শেঠ। তার সাথে কেউ ঝামেলা করে না। আমি তো শেঠ না কিন্তু সত্যি বলতে কি ওটা কোন ইচ্ছাকৃত বেয়াদবীও ছিল না। আসলে আমি বুঝি নাই উনি শিক্ষক। তিনি মাত্র পাশ করা চ্যাংড়া টিচার ছিলেন বলেই
একই ভাবে বুঝি নাই ক্লাসরুমে শিক্ষককে থ্যাংকু বলাটা বেয়াদবী। ওই সপ্তাহেই এক প্রশ্নের জবাব শুনে স্যারকে থ্যাংকু বলাতে স্যার ধমকের সাথে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন স্কুল থেকে এসব বেয়াদবী শিখেছি, ক্লাসরুমে কখনো থ্যাংকু বলতে নেই স্যারদের।
বিমূঢ় হয়ে বসে পড়েছিলাম কানটান উত্তপ্ত করে। শ্রদ্ধার আসন থেকে শিক্ষক সমাজের খসে পড়ার যাত্রা হলো শুরু। পরবর্তীকালে আরো অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে শিক্ষক সমাজের সাথে চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ফলে চুড়ান্ত পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণীটা অবধারিত হলেও আমার বুকে বিমলানন্দ লেগেছিল শেষ পর্যন্ত পছন্দের শ্রেণীতে থেকে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার জন্য।
মাঝে আরো অনেক তৃতীয় শ্রেণীর কীর্তি রয়ে গেছে আট বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দিলাম নাটক করবো বলে। আসলে নাটক না, রিহার্সালে আমার তৃতীয় শ্রেণীর কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল যাদের সাথে আড্ডা মারার লোভেই গ্রুপে যোগদান করি। যোগ দিলেই হয় না রিহার্সাল রুমে কিছু না কিছু করতে হয়। আমাকে দেয়া হলো তৃতীয় শ্রেণীর এক চামচার চরিত্র। চরিত্রটা আমার ভীষণ অপছন্দ হলেও আড্ডাবাজির লোভে গ্রুপ ছাড়তে পারলাম না। একের পর এক মঞ্চে অভিনয় করে যেতে লাগলাম চামচার ভুমিকায়। আমার অভিনয় গুনে নাকি চরিত্রটার নাম চামচা হওয়ায় আমার পিতৃপ্রদত্ত নামটা কিছুদিন বাদে গ্রুপের সবাই ভুলে গেল। মনে রাখলো চামচা। একদিন রিহার্সাল দেখতে আসা এক বালিকা আমাকে চামচা ভাই বলে ডাকার পর অপমান বুকের সকেটে গিয়ে শর্টসার্কিট ঘটিয়ে ফেলে। সেদিন থেকে আমি দল ছেড়ে পালালাম।
স্বাস্থ্য বানাতে ভর্তি হলাম জিমনেশিয়ামে। বুড়ো ওস্তাদ আবুল ফজল বললেন, দেখো বাছা শরীর যতই রবিউল সাইজ হোক, ভেতরে তাগত থাকলে তাগড়া জোয়ান মর্দও পরাজিত হবে। তুমিও পারবা। কলা খাও, ডিম খাও, দুধ খাও, কাঁচা ছোলা, রুটি ছানা মাখন সব খাও, দেখবা শক্তি কাহাকে বলে। ব্যায়াম করিবা আর রুটিনমত খাইবা। আমার মতো মিষ্টার পাকিস্তান হইবা। আমি তখন তীব্র আর্থিক টানাটানিতে দিন পার করি। আবুল ফজলের ডিম কলা দুধকে কাঁচকলা দেখিয়ে জিমনেশিয়াম থেকে এক ছুটে বাসে উঠে ষোলশহর পৌছে ভার্সিটি ট্রেন ধরতাম। সেই ট্রেন যখন গন্তব্যে পৌঁছাতো তখন চাকসু রেষ্টুরেন্টে গিয়ে তিন টাকার পরোটা ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করতাম। এই করে বছর খানেক পর একদিন বলা হলো এবার জিমনাষ্টিক ক্লাস শুরু। সিজেকেপি তখন নতুন জিমনেশিয়াম বানিয়েছে। সেখানে সব আধুনিক যন্ত্রপাতি। ভর্তি হয়ে গেলাম চোখ বন্ধ করে।
প্রথমদিন শুরু হলো ডিগবাজি শিক্ষা। এই জিনিস আমি আগেই পারি মার্শাল আর্ট শেখার কারণে। এখনো ভুলি নাই। বিশ পচিশজন লাইন ধরে ডিগবাজি মারতে মারতে এগোবে একজন একজন করে। রাবার ম্যাট বিছানো আছে নীচে। সাদা দাগ কাটা আছে কয়েক জায়গায়, লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওখানে পৌঁছালে ডিগবাজি দিয়ে পার হতে হবে। একজন একজন পার হচ্ছে সেভাবে। আমি প্রথম ডিগবাজি দিয়ে যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন একটা সোরগোল পড়ে গেল হঠাৎ। কারণ আমার সামনে যে ছেলে ছিল সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে কারণ আমার ডান পা ওর পাছায় আঘাত করেছে। আমার ডান পা ওকে আঘাত করেছে কারণ আমার পূর্বের ডিগবাজি শিক্ষায় ছিল 'পতন থেকে ওঠার সাথে সাথে সম্মুখে পদাঘাত করিতে হইবে'। পূর্ব অভ্যেশ বশতঃ সামনে যাকে পেয়েছে আমার পা তাকেই কিক মেরে বসেছে। ছেলেটার বয়স কম আমার আঘাতে কাতরে উঠেছে। ওস্তাদ আবুল ফজল এসে আমাকে ডাকলো। বললো, 'এটা তোমার কেরাডি শিখার জাগা না। তুমি আজ থেকে জিমনাষ্টিক থেকে বাদ। এটা নরম হাড্ডির বাচ্চাদের কোর্স। তোমার হাড্ডি শক্ত হয়ে গেছে। এই হাড্ডিতে তৃতীয় শ্রেনীর জিমন্যাস্ট তৈরী হয়'। আমি এবার তৃতীয় শ্রেণীর অপবাদ নিয়ে বিদায় নিলাম আমার শরীরচর্চা কোর্স থেকে।
আরো কয়েক বছর পর একটা তৃতীয় শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করলাম। আমি নিশ্চিত রেজাল্টও হবে তৃতীয় শ্রেণীর তাই একটা তৃতীয় শ্রেণীর চাকরী খুঁজে বের করে রেজাল্ট বের হবার আগেই কাজ শুরু করলাম। তারপর তৃতীয় শ্রেণীর ভিন্ন একটা জীবন শুরু হলো আমার। সেই জীবনে সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত দাসত্ব। দাসত্বের সেই সময়ে আমার কোন সমাজ ছিল না, সংসার ছিল না, পরিবারের সাথে দৈনিক আধঘন্টার বেশী ব্যয়ের সুযোগ ছিল না। বিছানার সাথে দেখা হতো ছয়ঘন্টার জন্য।
আমি প্রথমে ভেবেছি আমার এক মাসের জেলজীবন, তারপর ছমাস, এক বছর। এভাবে পার হয়ে গেল দীর্ঘ দাসত্ব সময়। আমি তৃতীয় শ্রেণীর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তৃতীয় শ্রেণীর হযবরল মানুষের প্রেমে পড়ে গেলাম। বুঝে গেলাম আমি ইহাদের লোক। তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের সাথে প্রথম শ্রেণীর মানুষের কোন সম্পর্ক থাকে না। আমারো থাকলো না। একসময় প্রথম শ্রেনীতে উত্তরণের ডাক এলেও আমি উড়তে ভুলে যাওয়া বন্দি পাখিটার মতো ভাবতে লাগলাম, এই তৃতীয় শ্রেণীর খাঁচাটাই আমার ঠিকানা। লাইফ ইজ আ থার্ড ক্লাস ওয়ার্ল্ড!
আমি কখনোই ভালো ছাত্র ছিলাম না। স্কুলে আমার পছন্দ ছিল তৃতীয় বেঞ্চ। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর তৃতীয় বেঞ্চের দিকে ঝোঁক লাগে। শহীদুল্লাহ স্যারের টেবিল দাবড়ানো বেতের শব্দটা কানের মধ্যে অসহ্য লাগতো কিংবা যখন তখন পিঠের উপর এসে পড়বে কেবল সেই ভয়ে নয়, বরং আরো কিছু হীনমন্যতা সেই ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভালো ছাত্রদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতো।
ক্লাসের ফার্স্ট আর সেকেণ্ড বয়ের সাথে আমি কখনোই বন্ধুতা করতাম না। আমার বন্ধুতা শুরু হতো থার্ড বয় থেকে। এখানেও তৃতীয়ের প্রতি আমার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। স্কুল পার করেছি তৃতীয় বেঞ্চে বসেই।
স্কুল শেষ করে যখন কলেজে গেলাম তিনটা সেকশান পেলাম। এস-১, এস-২, এস-৩। কিন্তু ভুল ক্রমে(!) আমাকে ভর্তি করানো হয় ভালো ছাত্রদের সেকশান এস-১ এ। ব্যাটে বলে হয় না সেখানেও। এস-১ এ ক্লাস করলেও আড্ডা মারি, সিনেমা দেখি এস-৩ সেকশানের ছেলেদের সাথে। সবাই মিলে মিশে ফেল করার প্রতিযোগিতায় নামলাম জামাতের সাথে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মিছিলে যেত একটা দল, আমরা ছিলাম সেই দলে। আবার মিছিল ফাঁকি দিয়ে লায়ন সিনেমার ব্যালকনিতে উঠে যেতো বারোটার শোতে আরেকটা দল, আমি ছিলাম সেই দলেও। এখানেও তৃতীয় পছন্দ।
কলেজের রোমাঞ্চকর দিনগুলো শেষ করলাম চুড়ান্ত ফাঁকিবাজি দিয়ে। এরপর এলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। এখানেও দেখি লিষ্টি প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় পছন্দ। এবার সেধে আর তৃতীয় পছন্দে গেলাম না। প্রথম আর দ্বিতীয় পছন্দে পরীক্ষা দেবার জন্য ফরম পুরন করলাম। কিন্তু বিধি বাম। ভর্তি পরীক্ষার হলে বসে প্রশ্নমালায় চোখ বুলিয়ে কেন যেন পছন্দ হয়ে গেল তৃতীয় পছন্দের প্রশ্নগুলো। তখন এক সাথে প্রশ্ন এবং পরীক্ষা হতো সবগুলো ইউনিটের। পরীক্ষার হলে বসেই আমি আমার দিগদর্শন যন্ত্রের মোড় ঘুরিয়ে দিলাম তৃতীয় পছন্দে। কাজটা গর্হিত না হলেও খানিকটা আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু আমার তৃতীয় পছন্দের কপালজোরে পেয়ে গেলাম এতদিন পড়ে আসা বিষয়ের সম্পূর্ন বিপরীত একটা সাবজেক্ট যার বিষয়বস্তু আমার চোদ্দপুরুষের কেউ পড়েনি।
প্রথমদিন ক্লাসে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জার্নাল মানে জাবেদা কেন হলো মাজেদা না হয়ে। আমার উৎকট মূর্খামি দেখে প্রফেসারের চোখ কপালে উঠে যাবার উপক্রম। স্কুল বয়স থেকে জেনে আসছি ভার্সিটিতে ছাত্র শিক্ষক ভাই বন্ধুর মতো। প্রথম ক্লাস শেষে এক ঘন্টার বিরতি, সেই বিরতিতে করিডোরের একপাশে তরুন এক শিক্ষককে বিড়ি ফুঁকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলি, ভাই আগুনটা.......। তিনি বিমূঢ় হয়ে লাইটার হাতে তুলে দিলেন, সিগারেট ধরিয়ে থ্যাংকু বলে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।
পেছনে তাকিয়ে যে দৃশ্যটা দেখতে পেতাম সেটা ভেবে এত বছর বাদে শিউরে উঠছি। পরে জেনেছিলাম এই ঘটনা পুরো ডিপার্টমেন্টে ফিসফাস তুলেছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যত বড় বেয়াদব সে ততবড় শেঠ। তার সাথে কেউ ঝামেলা করে না। আমি তো শেঠ না কিন্তু সত্যি বলতে কি ওটা কোন ইচ্ছাকৃত বেয়াদবীও ছিল না। আসলে আমি বুঝি নাই উনি শিক্ষক। তিনি মাত্র পাশ করা চ্যাংড়া টিচার ছিলেন বলেই
একই ভাবে বুঝি নাই ক্লাসরুমে শিক্ষককে থ্যাংকু বলাটা বেয়াদবী। ওই সপ্তাহেই এক প্রশ্নের জবাব শুনে স্যারকে থ্যাংকু বলাতে স্যার ধমকের সাথে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন স্কুল থেকে এসব বেয়াদবী শিখেছি, ক্লাসরুমে কখনো থ্যাংকু বলতে নেই স্যারদের।
বিমূঢ় হয়ে বসে পড়েছিলাম কানটান উত্তপ্ত করে। শ্রদ্ধার আসন থেকে শিক্ষক সমাজের খসে পড়ার যাত্রা হলো শুরু। পরবর্তীকালে আরো অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে শিক্ষক সমাজের সাথে চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ফলে চুড়ান্ত পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণীটা অবধারিত হলেও আমার বুকে বিমলানন্দ লেগেছিল শেষ পর্যন্ত পছন্দের শ্রেণীতে থেকে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার জন্য।
মাঝে আরো অনেক তৃতীয় শ্রেণীর কীর্তি রয়ে গেছে আট বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দিলাম নাটক করবো বলে। আসলে নাটক না, রিহার্সালে আমার তৃতীয় শ্রেণীর কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল যাদের সাথে আড্ডা মারার লোভেই গ্রুপে যোগদান করি। যোগ দিলেই হয় না রিহার্সাল রুমে কিছু না কিছু করতে হয়। আমাকে দেয়া হলো তৃতীয় শ্রেণীর এক চামচার চরিত্র। চরিত্রটা আমার ভীষণ অপছন্দ হলেও আড্ডাবাজির লোভে গ্রুপ ছাড়তে পারলাম না। একের পর এক মঞ্চে অভিনয় করে যেতে লাগলাম চামচার ভুমিকায়। আমার অভিনয় গুনে নাকি চরিত্রটার নাম চামচা হওয়ায় আমার পিতৃপ্রদত্ত নামটা কিছুদিন বাদে গ্রুপের সবাই ভুলে গেল। মনে রাখলো চামচা। একদিন রিহার্সাল দেখতে আসা এক বালিকা আমাকে চামচা ভাই বলে ডাকার পর অপমান বুকের সকেটে গিয়ে শর্টসার্কিট ঘটিয়ে ফেলে। সেদিন থেকে আমি দল ছেড়ে পালালাম।
স্বাস্থ্য বানাতে ভর্তি হলাম জিমনেশিয়ামে। বুড়ো ওস্তাদ আবুল ফজল বললেন, দেখো বাছা শরীর যতই রবিউল সাইজ হোক, ভেতরে তাগত থাকলে তাগড়া জোয়ান মর্দও পরাজিত হবে। তুমিও পারবা। কলা খাও, ডিম খাও, দুধ খাও, কাঁচা ছোলা, রুটি ছানা মাখন সব খাও, দেখবা শক্তি কাহাকে বলে। ব্যায়াম করিবা আর রুটিনমত খাইবা। আমার মতো মিষ্টার পাকিস্তান হইবা। আমি তখন তীব্র আর্থিক টানাটানিতে দিন পার করি। আবুল ফজলের ডিম কলা দুধকে কাঁচকলা দেখিয়ে জিমনেশিয়াম থেকে এক ছুটে বাসে উঠে ষোলশহর পৌছে ভার্সিটি ট্রেন ধরতাম। সেই ট্রেন যখন গন্তব্যে পৌঁছাতো তখন চাকসু রেষ্টুরেন্টে গিয়ে তিন টাকার পরোটা ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করতাম। এই করে বছর খানেক পর একদিন বলা হলো এবার জিমনাষ্টিক ক্লাস শুরু। সিজেকেপি তখন নতুন জিমনেশিয়াম বানিয়েছে। সেখানে সব আধুনিক যন্ত্রপাতি। ভর্তি হয়ে গেলাম চোখ বন্ধ করে।
প্রথমদিন শুরু হলো ডিগবাজি শিক্ষা। এই জিনিস আমি আগেই পারি মার্শাল আর্ট শেখার কারণে। এখনো ভুলি নাই। বিশ পচিশজন লাইন ধরে ডিগবাজি মারতে মারতে এগোবে একজন একজন করে। রাবার ম্যাট বিছানো আছে নীচে। সাদা দাগ কাটা আছে কয়েক জায়গায়, লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওখানে পৌঁছালে ডিগবাজি দিয়ে পার হতে হবে। একজন একজন পার হচ্ছে সেভাবে। আমি প্রথম ডিগবাজি দিয়ে যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন একটা সোরগোল পড়ে গেল হঠাৎ। কারণ আমার সামনে যে ছেলে ছিল সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে কারণ আমার ডান পা ওর পাছায় আঘাত করেছে। আমার ডান পা ওকে আঘাত করেছে কারণ আমার পূর্বের ডিগবাজি শিক্ষায় ছিল 'পতন থেকে ওঠার সাথে সাথে সম্মুখে পদাঘাত করিতে হইবে'। পূর্ব অভ্যেশ বশতঃ সামনে যাকে পেয়েছে আমার পা তাকেই কিক মেরে বসেছে। ছেলেটার বয়স কম আমার আঘাতে কাতরে উঠেছে। ওস্তাদ আবুল ফজল এসে আমাকে ডাকলো। বললো, 'এটা তোমার কেরাডি শিখার জাগা না। তুমি আজ থেকে জিমনাষ্টিক থেকে বাদ। এটা নরম হাড্ডির বাচ্চাদের কোর্স। তোমার হাড্ডি শক্ত হয়ে গেছে। এই হাড্ডিতে তৃতীয় শ্রেনীর জিমন্যাস্ট তৈরী হয়'। আমি এবার তৃতীয় শ্রেণীর অপবাদ নিয়ে বিদায় নিলাম আমার শরীরচর্চা কোর্স থেকে।
আরো কয়েক বছর পর একটা তৃতীয় শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করলাম। আমি নিশ্চিত রেজাল্টও হবে তৃতীয় শ্রেণীর তাই একটা তৃতীয় শ্রেণীর চাকরী খুঁজে বের করে রেজাল্ট বের হবার আগেই কাজ শুরু করলাম। তারপর তৃতীয় শ্রেণীর ভিন্ন একটা জীবন শুরু হলো আমার। সেই জীবনে সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত দাসত্ব। দাসত্বের সেই সময়ে আমার কোন সমাজ ছিল না, সংসার ছিল না, পরিবারের সাথে দৈনিক আধঘন্টার বেশী ব্যয়ের সুযোগ ছিল না। বিছানার সাথে দেখা হতো ছয়ঘন্টার জন্য।
আমি প্রথমে ভেবেছি আমার এক মাসের জেলজীবন, তারপর ছমাস, এক বছর। এভাবে পার হয়ে গেল দীর্ঘ দাসত্ব সময়। আমি তৃতীয় শ্রেণীর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তৃতীয় শ্রেণীর হযবরল মানুষের প্রেমে পড়ে গেলাম। বুঝে গেলাম আমি ইহাদের লোক। তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের সাথে প্রথম শ্রেণীর মানুষের কোন সম্পর্ক থাকে না। আমারো থাকলো না। একসময় প্রথম শ্রেনীতে উত্তরণের ডাক এলেও আমি উড়তে ভুলে যাওয়া বন্দি পাখিটার মতো ভাবতে লাগলাম, এই তৃতীয় শ্রেণীর খাঁচাটাই আমার ঠিকানা। লাইফ ইজ আ থার্ড ক্লাস ওয়ার্ল্ড!
No comments:
Post a Comment