Thursday, October 15, 2015

মিলিয়ে যাওয়া সুখের বিন্দুগুলো

১.


ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই চোখটা কচকচ করছে পানি দিলাম অনেকখানি তবু কমেনি চোখটা ডলতে ডলতে লাল হয়ে গেছে আরো ঘন্টা দুই ঘুমোতে পারলে পূর্ণ হতো চোখের বিশ্রাম  গতরাতে ঘুম হয়নি তেমন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম অদ্ভুত কিছু কষ্ট আর ভালোলাগা ঘুমকে বিলম্বিত করেছে কালরাতে একটু পড়াশোনা করছিলাম বারোটার দিকে বই বন্ধ করে শোবার জন্য আসলাম দেখলাম ওরা তিনজন ঘুমোচ্ছে শিহান আমার পাশে ঘুমোয় ঘন্টা দেড়েক আগে ওদেরকে শুতে বলে আমি বাতি নিবিয়ে ড্রইং রুমে চলে গিয়েছিলাম শিহান ওর খেলনা ল্যাপটপটা নিয়ে দুষ্টুমি করছিল বলে হালকা বকা দিয়ে বলেছিলাম, 'ঘুমোবার সময় এটা দরকার নাই টেবিলে রাখো ওটা এখন' আমি একটু জোরে কথা বললেও পছন্দ হয় না ওর কিন্তু প্রতিবাদ করে না তাই বোঝা যায় না রাগ করছে কিনা আমার কথা শুনে সে চুপচাপ ল্যাপটপটা টেবিলে রেখে শুয়ে পড়েছিল

 

এখন ফিরে এসে দেখি সবাই ঘুম আজ একটু গরম লাগছে সাধারণত ওশিন শিহানের যে কোন একজন দাদী বা ফুফুর সাথে থাকার জন্য জেদ করে প্রতিদিন তিন জন এক বিছানায়  ঠাসাঠাসি করে শুতে ভাল্লাগে না আমার তাই আমি আস্তে করে শিহানের পাশ থেকে বালিশটা নিয়ে আলগোছে দরোজা বন্ধ করে ড্রইং রুমের ডিভানে গিয়ে শুয়ে পড়লাম বাতি নিবিয়ে এখানে ঘুমোতে ভালোই লাগে আমার মাঝে মাঝে

 

কিন্তু কয়েক মিনিট পর অন্ধকারে একটা ছোট্ট একটা ছায়ামুর্তি দেখা গেল গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে ডিভানের কাছে কে এসেছে বুঝতে পেরে ঘুমের ভাণ করে চুপ করে পড়ে থাকলাম চোখ বুজে সে এসে ডাকলো, "বাবা বাবা, ওঠো, রুমে চলো, তুমি না থাকলে আমার ঘুম আসে না" এটা সত্যি ওকে রেখে কখনোই আমি অন্য ঘরে ঘুমোতে পারিনি আজ ভেবেছিলাম সে ঘুমিয়ে গেছে তাই চুপিসারে চলে এসেছিলাম ওর ডাকাডাকিতেও আমি মটকা মেরে পড়ে থাকলাম দেখি কি করে সে আমার চোখের পাতা খুলে দিল ছোট ছোট আঙুল দিয়ে, মুখে হাত দিয়ে ঠোট দুটো ফাক করলো আমার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা তবু আমি হাসি চেপে পড়ে থাকলাম আমার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে চলে গেল

 

খানিক পর আবারো ফিরে এলো এবার সোজা ডিভানে উঠে আমার পেটের উপর বসলো তারপর দুহাতে আমার গাল ধরে বললো, "আমি কিন্তু এখানে বসে থাকবো চলো তুমি নইলে আমি নামবো না" আমার খুব হাসি পাচ্ছিল ওর কাণ্ড দেখে তবু হাসি চেপে চুপ করে থাকলাম এবারো ব্যর্থ হয়ে চলে গেল

 

পাঁচ মিনিট পর ওর ছোট বালিশটা নিয়ে আবারো এলো বললো, "তুমি যদি না যাও, আমি এখানেই ঘুমাবো" বলেই পাশের সোফায় বালিশ দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো আমার খুব মায়া হচ্ছে বুঝতে পারছি এখানে ঘুমানো অসম্ভব তবু দেখি কতক্ষণ থাকে খানিক পর সে আর কোন কথা না বলে ছোট বালিশটা নিয়ে গুটিগুটি পায়ে চলে যায় বেডরুমের দিকে

 

এবার আমাকে উঠতেই হয় আমি রুমে গিয়ে দেখি শুয়ে পড়েছে আমার দিকে পেছন ফিরে আমি পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম আস্তে করে শুয়ে এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি এসেছি এদিকে ফিরো কিন্তু সে শক্ত হয়ে আছে কিছুতে ফিরবে না অনেক ডাকলাম, কিছুতে কিছু হয় না শরীরটা শক্ত করে রেখেছে বুঝতে পারলাম অভিমান করেছে জোর করে যখন আমার দিকে ফিরিয়ে আদর করলাম তখন আমার মুখটা সরিয়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বললো, "দেখছো না আমার রাগ হয়েছে? অনেক রাগ! তোমার সাথে কথা বলবো না"

 

কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর এত ভালোলাগা আর কষ্ট একসাথে হানা দিয়ে চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ওর এত মায়াকাড়া ভালোবাসা! এটাই প্রথম না, আরো ছোটকাল থেকেই এমন বাবার বুকে মুখটা গুঁজে ঘুমোবে শক্ত করে আকড়ে ধরে রাখবে ওকে নিয়ে আমারো ভীষণ প্রিয় অভ্যেস এটা কিন্তু আজ ভালোলাগার সাথে কেমন একটা কষ্টবোধ মাথার ভেতরে কেমন সব চিন্তা ভর করতে শুরু করলো আমি যদি হুট করে যে কোনদিন হারিয়ে যাই, এই পুচকাটা কী কষ্টই না পাবে সবকিছু হারাতে পারলেও ওকে হারিয়ে আমি কোথাও যেতে চাই না কিন্তু একদিন তো যেতে হবেই যাওয়াটা অনিবার্য তখন সে কী করবে, কার সাথে ঘুমোবে, কাকে খুঁজে আনবে ড্রইং রুম থেকে ওর পাশের বালিশটা চিরকালের জন্য খালি হয়ে যাবে? আমার ইচ্ছে করছিল ওকে জড়িয়ে নেই বুকের সাথে কিন্তু ওরও মাত্র ঘুম এসেছে হয়তো জাগাতে ইচ্ছে হলো না তারপর, তারপর থেকে অনেক রাত অবধি শুধু ওই কষ্টটাই জেগে থাকলো ঘুম পালিয়ে গেল দুচোখ থেকে যখনই একটু ঘুম আসে, আবার কেমন চমকে উঠে ভেঙ্গে যায় ঘুম ভেঙ্গে মনে হয় চলে যাবার ডাক এসেছে আসছে

 

আসবেই তো আয়ু কমতে কমতে একদিন ছোট্ট একটা বিন্দুতে এসে থেমে যাবে আমি যতবারই চোখ বন্ধ করছিলাম, ততবারই সেই বিন্দুটা এসে হাজির হচ্ছিল চোখের উপর চমকে চমকে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল তাই বারবার শেষমেষ কটার দিকে ঘুম এলো টেরই পেলাম না সকালে উঠেও চোখের জ্বালাপোড়া থেকে গেছে বুকের ভেতর দলাপাকানো কষ্ট

 

কোন কোন সুখের সময়ে এরকম বেদনাদায়ক ভাবনা কেন ভর করে?

[২০১৪]


২.

সুখের আয়ু খুব সীমিত আমাদের। যে মানুষগুলোকে ঘিরে আমাদের সুখ, সেই মানুষগুলো একদিন কোন না কোন কারণে দূরে মিলিয়ে যায়। যে সম্পর্কগুলো নিয়ে আমাদের প্রতিদিনের তৃপ্তি, সেই সম্পর্কের আয়ুও একদিন ফুরিয়ে আসে। যে মানুষগুলো আমাদের দেখে একসময় সুখী হতো, একদিন সেই মানুষগুলোই আমাদের দেখে বিরক্ত হয়। যে বন্ধুগুলোর সাথে একসময় প্রতিদিন দেখা হতো এখন তাদেরকে আর কোথাও খুঁজে পাই না। বয়স যখন অর্ধশতকের কাছাকাছি পথে চলে আসে তখন অনেক কিছুই জীবনের কাছ থেকে নির্বাসিত হয়ে যায়। মাত্র কবছর আগেও মনে হতো আমি কখনো বুড়ো হবো না, শরীর বুড়ো হলেও মনে মনে চিরতরুণ থেকে যাবো। আশ্চর্যজনকভাবে চল্লিশ পার হবার পরও কী করে যেন টিকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু পঞ্চাশের দিকে যেতে যেতে সে ধারণা বদলে গেল। আজকাল মানুষের আচরণ দেখেই বুঝে ফেলি, সময় শেষ হয়ে আসছে। সুখের বিন্দুগুলো ঘুরতে ঘুরতে বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিয়ে যাবে সহসা। অনেক মানুষ আমাকে মুছে ফেলবে, আমিও অনেককে মুছে ফেলবো। একসময় এটাকেই স্বাভাবিক মনে হবে। একসময় এটাই জীবনের ধর্ম হয়ে যাবে। আমরা সেই কালের দিকে এগিয়ে চলছি। [২০১৫]

No comments: