হঠাৎ করে পেয়ে যাওয়া একটা বই। কিছু না জেনেই কেনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ নিয়ে লেখা বই 'অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জল'। কখনো নামও শুনিনি লেখক মমিনুল হক খোকার। কিন্তু ভূমিকাটুকু পড়ে বুঝলাম বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর জীবনী লেখার ক্ষেত্রে বইটির গুরুত্ব কতখানি। বইটির ভূমিকা লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। বঙ্গবন্ধুর ডাক নামে নাম 'খোকা' নামে পরিচিত এই লেখক বঙ্গবন্ধু পরিবারের অতি ঘনিষ্ট এক স্বজন যিনি দীর্ঘ দুই দশক বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে ছিলেন। তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক এমন অনেক ঘটনা এই বইতে বিস্তৃত যা আর কোন বইতে পড়িনি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার কী অবস্থায় ছিল সেটা পড়ে যে কোন সংবেদনশীল পাঠক বেদনার্ত হবেন। লেখক পুরোটা সময় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে ছিলেন বলে নিজের চোখে দেখেছেন সব কিছু। অনেক দুর্লভ ঘটনার বিবরণ এই বই থেকে পেয়ে যাই অনায়াসে। সম্প্রতি বেশ কিছু দুর্লভ ভিডিও ক্লিপ দেখা হয়েছে এপি'র আর্কাইভের সৌজন্যে। যার একাধিক ভিডিওতে তাঁর উপস্থিতি পাই বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে। বইটিতে বাড়তি পাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের একদম ঘরোয়া কিছু ঝকঝকে ছবি।
অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালে। সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হকের মাধ্যমে। অডিও রেকর্ড করা বক্তব্য থেকে টাইপ করে লেখা হয়েছিল পাণ্ডুলিপি। তারপর সৈয়দ সামসুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
প্রচারের আড়ালে থাকা এই মানুষটিকে চিনতেন আবদুল গাফফার চৌধুরীও। ২৩ মে ২০১৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি চমৎকার একটি স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই স্মৃতিচারণে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায় বলে লেখাটির একটি কপি এখানে রেখে দিলাম।
একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ কথা
আবদুল গাফফার চৌধুরী ( দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ মে ২০১৪)
২৩মে শুক্রবার। লন্ডনের অপরাহ্ন। হঠাত্ টেলিফোন বেজে উঠলো। রিসিভার তুলতেই একটি কান্নাভেজা কণ্ঠ শুনলাম। শেখ রেহানার কণ্ঠ। রেহানা বললো, "চাচা, খোকা চাচা মারা গেছেন।" কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, কখন, কোথায়? রেহানা বললো, এই কিছুক্ষণ আগে সিঙ্গাপুরে মারা গেছেন। তার ক্যান্সার হয়েছিল। শেষ সময়ে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। আপা (শেখ হাসিনা) তার লাশ ঢাকায় নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
খোকা মানে মমিনুল হক খোকা। বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই। তিনি রাজনীতি করতেন না। কিন্তু ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ছায়াসঙ্গী। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতিটি দুর্দিনে খোকা চাচাই ছিলেন তাদের পরম নির্ভরতা। তার মৃত্যু শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মনে গভীর শোক সৃষ্টি করেছে তাতে সন্দেহ নেই। আমিও শোকান্বিত হয়েছি। আমার চাইতে বয়সে বেশ বড়। কিন্তু ছিলেন আমার দুর্দিনের বন্ধু। ছিলেন ব্যবসায়ী। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে তার নেপথ্য রাজনৈতিক ভূমিকার কথা কখনো ভুলতে পারবো না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও ঢাকায় অন্তরীণ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচাইতে বড় নির্ভর ও অভিভাবক ছিলেন এই মমিনুল হক খোকা। আমি তাকে ডাকতাম খোকা ভাই।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হলেও খোকা ভাই ছিলেন একেবারেই একজন সাধারণ মানুষ। কেউ হয়তো জিজ্ঞাসা করতে পারেন এই সাধারণ এবং খ্যাতিবিমুখ মানুষটির মৃত্যু নিয়ে আমি কেন আজ লিখতে বসেছি? সেকি তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য ছিলেন বলে? আমার জবাব, মোটেই তা নয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বহু সদস্য এখনো বেঁচে আছেন, তাদের অনেককেই আমি চিনি এবং জানি। কিন্তু আমার আগে তাদের মৃত্যু হলে (এমন কামনা করি না), তাদের সকলকে নিয়ে লিখবো তা মনে হয় না।
খোকা ভাইকে নিয়ে যে লিখতে বসেছি তার কারণ আছে। মানুষটি ছিলেন সাধারণ। খ্যাতি-অখ্যাতির পর্দার আড়ালে। নিকট আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব ছাড়া তার নামটিও অনেকে জানেন, তা মনে হয় না। কিন্তু মানুষটি সাধারণ এবং একজন নেপথ্যচারী হলেও তার জীবনের কাজকর্ম ছিল অসাধারণ। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে কেউ যদি বড় বই লেখেন, তাহলে সে বইয়ে মমিনুল হক খোকার নাম উল্লেখ করা না হলে অন্যায় করা হবে।
খোকা ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার আগেই তার নামের সঙ্গে আমি পরিচিত হয়ে উঠি। বঙ্গবন্ধুর মুখে প্রায়ই খোকা কোথায় ডাকটি শুনতাম এবং প্রায়শই তিনি খোকা ভাইকে কাছে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ঘন ঘন জেলে যেতেন। আর এই সময় খোকা ভাই হয়ে উঠতেন তার পরিবারের সবচাইতে বড় নির্ভরতা। বঙ্গবন্ধু-পত্নীর হাতের লাঠি। এই পরিবারের দেখাশোনা করতে গিয়ে তিনি গোয়েন্দাদের পিছু ধাওয়া, আইয়ুব-মোনেমের আমলের চোখ রাঙানি গ্রাহ্য করেননি। এমনকি সেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। বত্রিশ নম্বর বাড়ির আশেপাশে একটা কাকপক্ষীও ঘেঁষে না। তখনো খোকা ভাই এই পরিবারের সবচাইতে বড় নির্ভর এবং বাইরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী ছিলেন। নিজের সংসারের চাইতেও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের গুরুত্বই ছিল তার কাছে বেশি।
খোকা ভাইয়ের একটি সাদা টয়োটা গাড়ি ছিল। এই গাড়িটি বঙ্গবন্ধু প্রায়ই ব্যবহার করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঢাকায় মার্চ মাসে (১৯৭১) মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকটি হতো ঢাকায় তখনকার প্রেসিডেন্ট ভবনে (স্বাধীনতার পর প্রথম গণভবন)। বঙ্গবন্ধু বত্রিশ ধানমন্ডি থেকে খোকা ভাইয়ের সাদা টয়োটা গাড়িটিতে চেপে প্রেসিডেন্ট হাউসে এই বৈঠকে যাতায়াত করতেন। কখনো কখনো খোকা ভাই গাড়িটি ড্রাইভ করেছেন। এই গাড়িটি তাই একটি ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেছিল। যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গাড়িটির সেই মর্যাদা ক্ষমতা দখলকারী ঘাতকেরা আর রক্ষা করেনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায়, বঙ্গবন্ধুকে যখন (পশ্চিম) পাকিস্তানের এক জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাহারায় অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে ধানমন্ডির অন্য একটি বাড়িতে; তখন ভয়ে এই পরিবারের খোঁজ-খবরও কেউ নিতেন না। তখন খোকা ভাই নিত্য এই বাড়িতে যেতেন। তাদের জন্য বাজার সওদা পর্যন্ত করে দিতেন। হানাদার সৈন্যদের বেয়নেট এবং বডি সার্চের মধ্য দিয়ে খোকা ভাইকে এই বাড়িতে যেতে হতো। হানাদার কর্তৃপক্ষ তাকে এই পারমিশন দিয়েছিল, তবে তার উপর কঠোর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো। সামান্য সন্দেহ হলেই তারও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার অথবা চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। খোকা ভাই সেই ভয়টি জয় করেই ওই বাড়িতে যাতায়াত করতেন।
এই একাত্তর সালেরই এপ্রিল মাসের একদিনের কথা। ঘণ্টা তিনেকের জন্য কারফিউ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আমি তোপখানার প্রেসক্লাব থেকে বেরুচ্ছি, দেখি খোকা ভাই একটা স্কুটারে বসে আছেন। বললাম, কোথায় যাচ্ছেন? বললেন, "বন্দী ভাবী ও তার ছেলে-মেয়ের কাছে। উত্সুক্য ছিল, জিজ্ঞাসা করলাম, তাদের কোথায় রাখা হয়েছে? খোকা ভাই বললেন, বলবো না, আপনিও জানতে চাইবেন না। অনেকেই তাদের খোঁজ চাচ্ছে, এমনকি আওয়ামী লীগেরও কেউ কেউ।
আমি তাদের মতলব কি তা জানি না। তাই বলি না।" বললাম, আপনার গাড়ি কোথায়? বললেন, সৈন্যরা বড় বেশি গাড়ি সার্চ করে, হয়রানি করে। তাই স্কুটারে যাচ্ছি। তার কথা শুনে সেদিন মনে মনে ভেবেছি, বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রতি কতোটা আত্মীয়তার টান থাকলে একজন মানুষ সকল ভয় উপেক্ষা করে রোজ তাদের কাছে এমনভাবে যাতায়াত করতে পারে।
শুধু আত্মীয়দের জন্য নয়, অনাত্মীয়দের জন্যও এই মানুষটির কত বড় হূদয়ের টান ছিল, সে সম্পর্কে আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা আছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭৩ সাল। আমার স্ত্রী হঠাত্ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। চিকিত্সার জন্য বিলাতে নেওয়া প্রয়োজন। বিমান ভাড়া না হয় কষ্টেসৃষ্টে জোগাড় করলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে খরচ চালাবো কি করে? বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন রহমান তখন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। খোকা ভাই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওদিকে কর্পোরেশনের জনসংযোগ অফিসার রকিব আমার বন্ধু। আমি তার অফিসে প্রায়ই আড্ডা মারতে যাই।
একদিন ওই শিপিং কর্পোরেশনের অফিসে রকিবের কক্ষে বসে আমার স্ত্রীর চিকিত্সা সংক্রান্ত সমস্যার কথা আলোচনা করছিলাম। এই সময় খোকা ভাই এসে হাজির। আমার সমস্যার কথা শুনে বললেন, আপনি ভাববেন না। লন্ডনে আমাদের শিপিং কর্পোরেশনের একটা অফিস খোলা হচ্ছে। সেখানে আপনাকে জনসংযোগ অফিসার পদে নিয়োগ দিলে যে টাকা পাবেন, তাতে খরচ চলে যাবে।
খোকাভাইয়ের সঙ্গে তখন আমার পরিচয় তেমন নিবিড় নয়। আমি তার আত্মীয়ও নই। কিন্তু আমাকে সাহায্য করার জন্য তার আগ্রহ দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা জাগলো। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু আমাকে চাকরিটি কে দেবেন? খোকাভাই বললেন, কেন, ক্যাপ্টেন রহমান দেবেন। তিনি আমার বন্ধু। আমি তাকে বলবো। সত্যি সত্যি খোকাভাই আমাকে চাকরি দেওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন রহমানকে বলেছিলেন। ক্যাপ্টেন রহমানও রাজি হয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত চাকরিটি নেওয়া আর হয়নি। সে অন্য প্রসঙ্গ।
১৯৭৫ সালের আগস্ট ও নভেম্বর ট্রাজেডির পর লন্ডনে সামরিক শাসন-বিরোধী একটা আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আমিও তাতে যোগ দেই। আমরা 'বাংলার ডাক' নামে আন্দোলনের একটি মুখপত্র বের করার ব্যবস্থা করি। কিন্তু টাকা কোথায়? এই সময় খোকাভাই এসে আমার ম্যাথুয়েন রোডের বাসায় হাজির। তিনি আমাদের প্রচেষ্টার কথা বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন। শেখ হাসিনাও খোকাভাই যাতে আমাদের সমর্থন দেন তাকে সেই অনুরোধ জানিয়েছেন। তার কাছে হাসিনার লেখা একটা চিঠিও তিনি আমাকে দেখালেন।
খোকাভাই বাংলার ডাকের জন্য অর্থসংগ্রহের নিশ্চয়তা দিলেন। বললেন, আমরা বেশকিছু লোক প্রতি মাসে কিছু টাকা দেব। এই বেশকিছু লোকের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকারের ওয়ার্কস সেক্রেটারি মইনুল ইসলাম সাহেব। তিনি জিয়াউর রহমানের জেল থেকে বেরিয়ে তখন ম্যানেচেস্টারে বাস করতেন। তিনি প্রতি মাসে বাংলার ডাকের জন্য একটা মোটা ডোনেশন খোকাভাইয়ের মাধ্যমে দিতেন।
খোকাভাই রাজনীতি করতেন না। কিন্তু বাংলাদেশের সেই দুর্দিনে আমাদের ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি সভা ও মিছিলে যোগ দিতেন। লন্ডনের বাঙালি পাড়ায় বাংলার ডাক বিক্রির জন্য রাস্তায় ঘুরেছেন। দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে কয়েক বছর থাকার পর শেখ রেহানা লন্ডনে খোকাভাইয়ের বাসাতেই এসে ওঠে। তার নিরাপত্তার জন্য কথাটা কিছুদিন গোপন রাখা হয়েছিল। আমি একদিন খোকাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার বাসায় টেলিফোন করতেই রেহানাই রিসিভার তুললো। বললো, 'চাচা, আমি রেহানা।' আমি তাকে মা ডাকি। মাতা-পুত্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হলো।
মমিনুল হকের মতো একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবন কথা লিখতে গেলে আমি একটা বই লিখতে পারি। কিন্তু তা এখানে সম্ভব নয়। তবু বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যত্ নির্মাণে এই মানুষটির একটি নেপথ্য ভূমিকার কথা লিখে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই। আমরা বঙ্গবন্ধুর বহু অনুসারী তখন ইংল্যান্ডে ফ্যাসিবিরোধী ও সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলনে রত। কিন্তু নেতৃত্ব কোথায়? দেশে আওয়ামী লীগ তখন নিষ্ক্রিয়, নানা কোন্দলে বিভক্ত। বিদেশেই বা নেতৃত্ব কোথায় এবং এতো বাধা-বিপত্তির মধ্যে আন্দোলন করে কতো দূর এগুনো যাবে? নানা প্রশ্ন আন্দোলনকারীদের মনে।
আমাদের তখন ভরসা ড. কামাল হোসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী ছিলেন এবং এখন অক্সফোর্ডে অবস্থান করছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনিই আওয়ামী লীগ দলের এবং দেশের পরবর্তী কাণ্ডারি হবেন। কিন্তু আমরা হতাশ এবং ক্ষুব্ধ তার মধ্যে পলায়নি মনোবৃত্তি দেখে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো, তিনি দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আন্তরিকভাবে কতোটা আছেন? এখন একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দেশে বসে তিনি যতোই আত্মসাফাইয়ের কথা বলেন না কেন, তখন (৭৫ এর পর) ব্রিটেনে অবস্থানের সময় তার কার্যকলাপের ইতিহাস যদি আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরি, তাহলে 'গণতন্ত্রের এই আরেক মানসপুত্রের' আসল চেহারাটি জানা যাবে। এখানে সেই প্রসঙ্গ টানা অবান্তর। সময় ও সুযোগ হলে সেই কাহিনী একদিন লিখবো।
এখন লন্ডনে আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলনের দিনগুলোর কথায় ফিরে যাই। ড. কামাল হোসেনের কার্যকলাপে তখন আমরা ত্যক্তবিরক্ত। এক সন্ধ্যায় প্রয়াত গউস খান সাহেবের (যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তখনকার সভাপতি) রেস্টুরেন্টে আমরা সমবেত হয়েছি। জাতীয় নেতাদের জেলে বন্দী অবস্থায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আহূত লন্ডনের কনওয়ে হলের সভা থেকে ড. কামাল হোসেনের পেছনের দরোজা দিয়ে গোপনে আকস্মিকভাবে প্রস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ কর্মীদের গউস খান নানাভাবে বোঝাচ্ছেন।
আমিও সেখানে ছিলাম, বললাম, অসুস্থ স্ত্রী এবং ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রোসারি শপে সেলসম্যানের চাকরি করে সংসার চালাচ্ছি এবং দেশে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি। এই আন্দোলনের ফলে যদি ড. কামাল হোসেনের মতো লোকেরা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে এতো আর্থিক ও পারিবারিক কষ্টের মধ্যে আর বিদেশে বসে আন্দোলন করতে চাই না।
ওই বৈঠকে খোকা ভাইও ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে ড. কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী হবেন কিভাবে? হবে শেখ হাসিনা। আপনি নিশ্চিত থাকুন গাফফার।
আমি হতবাক। খোকাভাই বলেন কি? শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন এই সম্ভাবনা আমরা কেউ তখনো ভেবে দেখিনি। কল্পনাও করিনি। হাসিনার কি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো বয়স হয়েছে, না অভিজ্ঞতা আছে? খোকাভাই আমার মনের কথা বুঝলেন। বললেন, হাসিনার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে। কলেজে পড়ার সময় সে কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত হয়নি?
তাকে বললাম, একটা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি হওয়া আর একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এক কথা নয়।
খোকাভাই বললেন, বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর সাহস আছে হাসিনার শরীরে। দেখবেন, দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ড. কামাল হোসেনসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে শেখ হাসিনাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা দেখাবেন এবং আওয়ামী লীগ সংগঠনটিকেও ধরে রাখতে পারবেন।
সেদিন খোকা ভাইয়ের কথা নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে তার প্রেডিকশন কতোটা সঠিক। একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু কী অসাধারণ দূরদৃষ্টি! আজ তার মৃত্যু সংবাদ শুনে একজন আত্মীয় বিয়োগের ব্যথা অনুভব করছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনকে আন্তরিক সমবেদনা জানাই। আর তাকে জানাই পরম শ্রদ্ধা।
http://archive.ittefaq.com.bd/ index.php?ref= MjBfMDVfMjVfMTRfMV80XzFfMTMzMD Y0
খোকা মানে মমিনুল হক খোকা। বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই। তিনি রাজনীতি করতেন না। কিন্তু ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ছায়াসঙ্গী। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতিটি দুর্দিনে খোকা চাচাই ছিলেন তাদের পরম নির্ভরতা। তার মৃত্যু শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মনে গভীর শোক সৃষ্টি করেছে তাতে সন্দেহ নেই। আমিও শোকান্বিত হয়েছি। আমার চাইতে বয়সে বেশ বড়। কিন্তু ছিলেন আমার দুর্দিনের বন্ধু। ছিলেন ব্যবসায়ী। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে তার নেপথ্য রাজনৈতিক ভূমিকার কথা কখনো ভুলতে পারবো না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও ঢাকায় অন্তরীণ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচাইতে বড় নির্ভর ও অভিভাবক ছিলেন এই মমিনুল হক খোকা। আমি তাকে ডাকতাম খোকা ভাই।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হলেও খোকা ভাই ছিলেন একেবারেই একজন সাধারণ মানুষ। কেউ হয়তো জিজ্ঞাসা করতে পারেন এই সাধারণ এবং খ্যাতিবিমুখ মানুষটির মৃত্যু নিয়ে আমি কেন আজ লিখতে বসেছি? সেকি তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য ছিলেন বলে? আমার জবাব, মোটেই তা নয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বহু সদস্য এখনো বেঁচে আছেন, তাদের অনেককেই আমি চিনি এবং জানি। কিন্তু আমার আগে তাদের মৃত্যু হলে (এমন কামনা করি না), তাদের সকলকে নিয়ে লিখবো তা মনে হয় না।
খোকা ভাইকে নিয়ে যে লিখতে বসেছি তার কারণ আছে। মানুষটি ছিলেন সাধারণ। খ্যাতি-অখ্যাতির পর্দার আড়ালে। নিকট আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব ছাড়া তার নামটিও অনেকে জানেন, তা মনে হয় না। কিন্তু মানুষটি সাধারণ এবং একজন নেপথ্যচারী হলেও তার জীবনের কাজকর্ম ছিল অসাধারণ। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে কেউ যদি বড় বই লেখেন, তাহলে সে বইয়ে মমিনুল হক খোকার নাম উল্লেখ করা না হলে অন্যায় করা হবে।
খোকা ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার আগেই তার নামের সঙ্গে আমি পরিচিত হয়ে উঠি। বঙ্গবন্ধুর মুখে প্রায়ই খোকা কোথায় ডাকটি শুনতাম এবং প্রায়শই তিনি খোকা ভাইকে কাছে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ঘন ঘন জেলে যেতেন। আর এই সময় খোকা ভাই হয়ে উঠতেন তার পরিবারের সবচাইতে বড় নির্ভরতা। বঙ্গবন্ধু-পত্নীর হাতের লাঠি। এই পরিবারের দেখাশোনা করতে গিয়ে তিনি গোয়েন্দাদের পিছু ধাওয়া, আইয়ুব-মোনেমের আমলের চোখ রাঙানি গ্রাহ্য করেননি। এমনকি সেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। বত্রিশ নম্বর বাড়ির আশেপাশে একটা কাকপক্ষীও ঘেঁষে না। তখনো খোকা ভাই এই পরিবারের সবচাইতে বড় নির্ভর এবং বাইরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী ছিলেন। নিজের সংসারের চাইতেও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের গুরুত্বই ছিল তার কাছে বেশি।
খোকা ভাইয়ের একটি সাদা টয়োটা গাড়ি ছিল। এই গাড়িটি বঙ্গবন্ধু প্রায়ই ব্যবহার করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঢাকায় মার্চ মাসে (১৯৭১) মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকটি হতো ঢাকায় তখনকার প্রেসিডেন্ট ভবনে (স্বাধীনতার পর প্রথম গণভবন)। বঙ্গবন্ধু বত্রিশ ধানমন্ডি থেকে খোকা ভাইয়ের সাদা টয়োটা গাড়িটিতে চেপে প্রেসিডেন্ট হাউসে এই বৈঠকে যাতায়াত করতেন। কখনো কখনো খোকা ভাই গাড়িটি ড্রাইভ করেছেন। এই গাড়িটি তাই একটি ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেছিল। যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গাড়িটির সেই মর্যাদা ক্ষমতা দখলকারী ঘাতকেরা আর রক্ষা করেনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায়, বঙ্গবন্ধুকে যখন (পশ্চিম) পাকিস্তানের এক জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাহারায় অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে ধানমন্ডির অন্য একটি বাড়িতে; তখন ভয়ে এই পরিবারের খোঁজ-খবরও কেউ নিতেন না। তখন খোকা ভাই নিত্য এই বাড়িতে যেতেন। তাদের জন্য বাজার সওদা পর্যন্ত করে দিতেন। হানাদার সৈন্যদের বেয়নেট এবং বডি সার্চের মধ্য দিয়ে খোকা ভাইকে এই বাড়িতে যেতে হতো। হানাদার কর্তৃপক্ষ তাকে এই পারমিশন দিয়েছিল, তবে তার উপর কঠোর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো। সামান্য সন্দেহ হলেই তারও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার অথবা চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। খোকা ভাই সেই ভয়টি জয় করেই ওই বাড়িতে যাতায়াত করতেন।
এই একাত্তর সালেরই এপ্রিল মাসের একদিনের কথা। ঘণ্টা তিনেকের জন্য কারফিউ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আমি তোপখানার প্রেসক্লাব থেকে বেরুচ্ছি, দেখি খোকা ভাই একটা স্কুটারে বসে আছেন। বললাম, কোথায় যাচ্ছেন? বললেন, "বন্দী ভাবী ও তার ছেলে-মেয়ের কাছে। উত্সুক্য ছিল, জিজ্ঞাসা করলাম, তাদের কোথায় রাখা হয়েছে? খোকা ভাই বললেন, বলবো না, আপনিও জানতে চাইবেন না। অনেকেই তাদের খোঁজ চাচ্ছে, এমনকি আওয়ামী লীগেরও কেউ কেউ।
আমি তাদের মতলব কি তা জানি না। তাই বলি না।" বললাম, আপনার গাড়ি কোথায়? বললেন, সৈন্যরা বড় বেশি গাড়ি সার্চ করে, হয়রানি করে। তাই স্কুটারে যাচ্ছি। তার কথা শুনে সেদিন মনে মনে ভেবেছি, বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রতি কতোটা আত্মীয়তার টান থাকলে একজন মানুষ সকল ভয় উপেক্ষা করে রোজ তাদের কাছে এমনভাবে যাতায়াত করতে পারে।
শুধু আত্মীয়দের জন্য নয়, অনাত্মীয়দের জন্যও এই মানুষটির কত বড় হূদয়ের টান ছিল, সে সম্পর্কে আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা আছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭৩ সাল। আমার স্ত্রী হঠাত্ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। চিকিত্সার জন্য বিলাতে নেওয়া প্রয়োজন। বিমান ভাড়া না হয় কষ্টেসৃষ্টে জোগাড় করলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে খরচ চালাবো কি করে? বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন রহমান তখন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। খোকা ভাই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওদিকে কর্পোরেশনের জনসংযোগ অফিসার রকিব আমার বন্ধু। আমি তার অফিসে প্রায়ই আড্ডা মারতে যাই।
একদিন ওই শিপিং কর্পোরেশনের অফিসে রকিবের কক্ষে বসে আমার স্ত্রীর চিকিত্সা সংক্রান্ত সমস্যার কথা আলোচনা করছিলাম। এই সময় খোকা ভাই এসে হাজির। আমার সমস্যার কথা শুনে বললেন, আপনি ভাববেন না। লন্ডনে আমাদের শিপিং কর্পোরেশনের একটা অফিস খোলা হচ্ছে। সেখানে আপনাকে জনসংযোগ অফিসার পদে নিয়োগ দিলে যে টাকা পাবেন, তাতে খরচ চলে যাবে।
খোকাভাইয়ের সঙ্গে তখন আমার পরিচয় তেমন নিবিড় নয়। আমি তার আত্মীয়ও নই। কিন্তু আমাকে সাহায্য করার জন্য তার আগ্রহ দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা জাগলো। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু আমাকে চাকরিটি কে দেবেন? খোকাভাই বললেন, কেন, ক্যাপ্টেন রহমান দেবেন। তিনি আমার বন্ধু। আমি তাকে বলবো। সত্যি সত্যি খোকাভাই আমাকে চাকরি দেওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন রহমানকে বলেছিলেন। ক্যাপ্টেন রহমানও রাজি হয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত চাকরিটি নেওয়া আর হয়নি। সে অন্য প্রসঙ্গ।
১৯৭৫ সালের আগস্ট ও নভেম্বর ট্রাজেডির পর লন্ডনে সামরিক শাসন-বিরোধী একটা আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আমিও তাতে যোগ দেই। আমরা 'বাংলার ডাক' নামে আন্দোলনের একটি মুখপত্র বের করার ব্যবস্থা করি। কিন্তু টাকা কোথায়? এই সময় খোকাভাই এসে আমার ম্যাথুয়েন রোডের বাসায় হাজির। তিনি আমাদের প্রচেষ্টার কথা বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন। শেখ হাসিনাও খোকাভাই যাতে আমাদের সমর্থন দেন তাকে সেই অনুরোধ জানিয়েছেন। তার কাছে হাসিনার লেখা একটা চিঠিও তিনি আমাকে দেখালেন।
খোকাভাই বাংলার ডাকের জন্য অর্থসংগ্রহের নিশ্চয়তা দিলেন। বললেন, আমরা বেশকিছু লোক প্রতি মাসে কিছু টাকা দেব। এই বেশকিছু লোকের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকারের ওয়ার্কস সেক্রেটারি মইনুল ইসলাম সাহেব। তিনি জিয়াউর রহমানের জেল থেকে বেরিয়ে তখন ম্যানেচেস্টারে বাস করতেন। তিনি প্রতি মাসে বাংলার ডাকের জন্য একটা মোটা ডোনেশন খোকাভাইয়ের মাধ্যমে দিতেন।
খোকাভাই রাজনীতি করতেন না। কিন্তু বাংলাদেশের সেই দুর্দিনে আমাদের ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি সভা ও মিছিলে যোগ দিতেন। লন্ডনের বাঙালি পাড়ায় বাংলার ডাক বিক্রির জন্য রাস্তায় ঘুরেছেন। দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে কয়েক বছর থাকার পর শেখ রেহানা লন্ডনে খোকাভাইয়ের বাসাতেই এসে ওঠে। তার নিরাপত্তার জন্য কথাটা কিছুদিন গোপন রাখা হয়েছিল। আমি একদিন খোকাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার বাসায় টেলিফোন করতেই রেহানাই রিসিভার তুললো। বললো, 'চাচা, আমি রেহানা।' আমি তাকে মা ডাকি। মাতা-পুত্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হলো।
মমিনুল হকের মতো একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবন কথা লিখতে গেলে আমি একটা বই লিখতে পারি। কিন্তু তা এখানে সম্ভব নয়। তবু বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যত্ নির্মাণে এই মানুষটির একটি নেপথ্য ভূমিকার কথা লিখে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই। আমরা বঙ্গবন্ধুর বহু অনুসারী তখন ইংল্যান্ডে ফ্যাসিবিরোধী ও সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলনে রত। কিন্তু নেতৃত্ব কোথায়? দেশে আওয়ামী লীগ তখন নিষ্ক্রিয়, নানা কোন্দলে বিভক্ত। বিদেশেই বা নেতৃত্ব কোথায় এবং এতো বাধা-বিপত্তির মধ্যে আন্দোলন করে কতো দূর এগুনো যাবে? নানা প্রশ্ন আন্দোলনকারীদের মনে।
আমাদের তখন ভরসা ড. কামাল হোসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী ছিলেন এবং এখন অক্সফোর্ডে অবস্থান করছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনিই আওয়ামী লীগ দলের এবং দেশের পরবর্তী কাণ্ডারি হবেন। কিন্তু আমরা হতাশ এবং ক্ষুব্ধ তার মধ্যে পলায়নি মনোবৃত্তি দেখে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো, তিনি দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আন্তরিকভাবে কতোটা আছেন? এখন একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দেশে বসে তিনি যতোই আত্মসাফাইয়ের কথা বলেন না কেন, তখন (৭৫ এর পর) ব্রিটেনে অবস্থানের সময় তার কার্যকলাপের ইতিহাস যদি আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরি, তাহলে 'গণতন্ত্রের এই আরেক মানসপুত্রের' আসল চেহারাটি জানা যাবে। এখানে সেই প্রসঙ্গ টানা অবান্তর। সময় ও সুযোগ হলে সেই কাহিনী একদিন লিখবো।
এখন লন্ডনে আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলনের দিনগুলোর কথায় ফিরে যাই। ড. কামাল হোসেনের কার্যকলাপে তখন আমরা ত্যক্তবিরক্ত। এক সন্ধ্যায় প্রয়াত গউস খান সাহেবের (যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তখনকার সভাপতি) রেস্টুরেন্টে আমরা সমবেত হয়েছি। জাতীয় নেতাদের জেলে বন্দী অবস্থায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আহূত লন্ডনের কনওয়ে হলের সভা থেকে ড. কামাল হোসেনের পেছনের দরোজা দিয়ে গোপনে আকস্মিকভাবে প্রস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ কর্মীদের গউস খান নানাভাবে বোঝাচ্ছেন।
আমিও সেখানে ছিলাম, বললাম, অসুস্থ স্ত্রী এবং ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রোসারি শপে সেলসম্যানের চাকরি করে সংসার চালাচ্ছি এবং দেশে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি। এই আন্দোলনের ফলে যদি ড. কামাল হোসেনের মতো লোকেরা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে এতো আর্থিক ও পারিবারিক কষ্টের মধ্যে আর বিদেশে বসে আন্দোলন করতে চাই না।
ওই বৈঠকে খোকা ভাইও ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে ড. কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী হবেন কিভাবে? হবে শেখ হাসিনা। আপনি নিশ্চিত থাকুন গাফফার।
আমি হতবাক। খোকাভাই বলেন কি? শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন এই সম্ভাবনা আমরা কেউ তখনো ভেবে দেখিনি। কল্পনাও করিনি। হাসিনার কি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো বয়স হয়েছে, না অভিজ্ঞতা আছে? খোকাভাই আমার মনের কথা বুঝলেন। বললেন, হাসিনার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে। কলেজে পড়ার সময় সে কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত হয়নি?
তাকে বললাম, একটা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি হওয়া আর একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এক কথা নয়।
খোকাভাই বললেন, বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর সাহস আছে হাসিনার শরীরে। দেখবেন, দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ড. কামাল হোসেনসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে শেখ হাসিনাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা দেখাবেন এবং আওয়ামী লীগ সংগঠনটিকেও ধরে রাখতে পারবেন।
সেদিন খোকা ভাইয়ের কথা নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে তার প্রেডিকশন কতোটা সঠিক। একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু কী অসাধারণ দূরদৃষ্টি! আজ তার মৃত্যু সংবাদ শুনে একজন আত্মীয় বিয়োগের ব্যথা অনুভব করছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনকে আন্তরিক সমবেদনা জানাই। আর তাকে জানাই পরম শ্রদ্ধা।
http://archive.ittefaq.com.bd/
No comments:
Post a Comment