বাসায় একটা টিভি কেনার জন্য বাবার সাথে কতবার অভিমানে গাল ফুলিয়েছি ঠিক নেই। ১৯৭৯ সালে মাসখানেকের জন্য একটা বারো ইঞ্চির সাদাকালো ন্যাশনাল টিভি বাসায় এসেছিল। কিন্তু মাত্র ১টা চ্যানেলের ৫ ঘন্টার প্রোগ্রামের কারণে পড়াশোনা 'উচ্ছন্নে' যাচ্ছে বলে ওটা বিক্রি করে দেয়া হয় শীঘ্রি।
আরো অনেক পরে কলেজে ওঠার পর ১৯৮৫ সালে আরো একটা ছোট্ট সনি টিভি কেনা হয় বাসায়। এবার রঙিন টিভি! প্রথমদিন টিভি আসার পর সেই দুপুরবেলা থেকে আমরা সব ভাইবোন জড়ো হয়ে টিভির রঙিন ঝিকিমিকি উপভোগ করেছিলাম অনেকক্ষণ। সেদিন দুপুরে খেতে বসে 'তাড়াতাড়ি খা' বলে মাকে তাড়া দিতে হয়নি কাউকে। সবাই নির্বিবাদে খেয়েদেয়ে দুপুরে খানিক ঘুমিয়ে পাঁচটা বাজার আগেই টিভির সামনে হাজির।
বিটিভির প্রোগ্রাম শুরু হতো বিকেল পাঁচটায়। প্রোগ্রাম শুরুর আগে কুউউউউউ শব্দ নিয়ে একটা বেনীআসহকলা বর্ণের পর্দা চলে আসতো। সেটা দেখেই কী খুশী আমরা!! আর বেশী দেরী নেই। কিছুক্ষণ পর পর্দাটা বদলে গিয়ে গোলাকার ডিজাইনের একটা বিচিত্র ডিজিটাল জ্যামিতিক প্যাটার্নের পর্দা আসে। সেখানে লেখা আছে 'বাংলাদেশ টেলিভিশন'। উফফ আর মাত্র কয়েক মিনিট, তারপর সেই কাংখিত মুহূর্ত। হালকা একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজতো এই পর্বে। অল্পক্ষণ পরেই ঘোষকের মুখ দেখা যায়। হাস্যোজ্জ্বল উপস্থাপিকা বলে উঠলো, 'আসলামুআলাইকুম, বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে আমি কুমকুম হাসান...." ইত্যাদি সূচনা বানী। এরপর কোরান পাঠ হয়। তারপর ত্রিপিটক কিংবা গীতা।
ওরা কি পাঠ করছে সেদিকে মন নেই আমাদের। আমরা কেবল রঙিন ছবিগুলির দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছি। মানুষগুলো কী স্পষ্ট! যে যেই রঙের পোষাক পরেছে ঠিক সেরকমই দেখা যায়। আজব দুনিয়া। এত সুন্দর ঝকঝকে ছবি আমাদের ইহজনমে আর দেখিনি। তখন আমাদের চেহারার বিরামহীন হাসি দিয়ে নির্ঘাত কোটি টাকার বিজ্ঞাপন হয়ে যেতো সনি কর্পোরেশনের।
প্রথমদিন বলে সবার পড়াশোনা মাফ ছিল ওইদিন। বাবা মা খুব উদার মনে আমাদের পাশে বসে টিভি দেখলো, বকুনি-বিহীন একটা রাত। টিভি পর্দায় আঠার মতো সেঁটে আছে আটজোড়া চোখ। সীট ছেড়ে কেউ উঠছে না। কেবল রাতে খাওয়ার সময় উঠলাম খানিকক্ষণের জন্য। তবু একটা দল পাহারায় থেকে গেল, যদি কিছু মিস হয়। সেটা ওরা দেখে জানাবে আমাদের। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাত পৌনে বারোটায় জাতীয় পতাকা দোলানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিভির সামনে বসে রইলাম আমরা। কী চরম উত্তেজনা! রাতে বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুম এলো না। পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল নিজেদের। তখন আত্মীয় স্বজনের কারো কারো বাসায় টিভি থাকলেও, রঙিন টিভিতে আমরাই ফার্স্ট হয়েছি, এটা নিয়ে আরেকদফা গর্ব হলো।
২৮ বছর পেরিয়ে গেছে তারপর। এখন বস্তির দরিদ্রতম ঘরেও ৫০-৬০ চ্যানেলের টিভি থাকে। সেদিন গুনে দেখলাম চট্টগ্রামে আমার এলাকায় ৮০টা চ্যানেল দেখায়। সারাদেশেও গড়পড়তা সেরকমই হবে। কিন্তু ৮০টা চ্যানেল থাকার পরও টেলিভিশনের প্রতি লোকজনের আগ্রহের মাত্রা আমাদের ওই সুদূর দিনের ১% ও হবে না। অনেক সুলভ হয়ে গেছে প্রযুক্তি, বিনোদন। অথচ আগ্রহ কমে গেছে সেই বিপরীত অনুপাতে।
তবে সবগুলো চ্যানেলের সারাংশ করতে গিয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য পেয়েছি, সেটা বলতেই এই লেখার সূচনা-
১. ৮০টা চ্যানেলের মধ্যে 'দেশ' ভেদে চ্যানেল সংখ্যা
বাংলাদেশী ২৩,
ভারতীয় ৩৭,
অন্যান্য ২০
২. ৮০টা চ্যানেলের মধ্যে 'ভাষা' ভেদে চ্যানেল সংখ্যা
বাংলা ২৩,
হিন্দি ২৬,
ইংরেজি ১৮
অন্যন্য ১৩
৩. ৮০টা চ্যানেলের মধ্যে কোন দেশের 'বিজ্ঞাপন'এর প্রাধান্য
বাংলাদেশী ২৩,
ভারতীয় ৪৫,
বিজ্ঞাপনবিহীন অন্যন্য ১২
এখানে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলো ৩ নম্বরের হিসেবটা। ঘোষিত ভারতের চ্যানেল ৩৭টা হলেও বিজ্ঞাপনে ভারতের নিয়ন্ত্রণ ৪৫টি চ্যানেলে। ডিসকভারি বা জিওগ্রাফিক চ্যানেলের মতো অভারতীয় চ্যানেলও ভারতীয় বিজ্ঞাপনে চলছে কারণ ওদের আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ অফিস সম্ভবত: ভারত। জ্ঞানের স্বার্থে বিনোদনের স্বার্থে আমরা বিজ্ঞাপন অত্যাচার সয়েও ডিসকভারি স্পোর্টস ট্রাভেল ইত্যাদি চ্যানেলগুলো দেখবো। কিন্তু বিরাট সংখ্যক ভারতীয় চ্যানেল নিরেট অখাদ্য। সেরকম প্রায় ২৫টি অখাদ্য ভারতীয় চ্যানেল আমরা গিলে যাচ্ছি কার স্বার্থে?
ওই অখাদ্য বাদ দিয়ে আমরা কি করতে পারতাম? আমরা আরো চারটি মহাদেশের কমপক্ষে ৫০টি দেশের চ্যানেল দেখতে পারতাম একদম বিনে পয়সায়। এশিয়ার অনেক দেশের চ্যানেল, আফ্রিকার, রাশিয়ার, পূর্ব ইউরোপের, দক্ষিণ আমেরিকার অনেক চ্যানেল আমরা ফ্রীতে দেখতে পারি যদি কেবল সরকার আর অপারেটর দেখাতে চায়। টেলিভিশন একটা বৈশ্বিক জানালা। সারা বিশ্বকে দেখতে পারি আমরা ছোট্ট এই শক্তিশালী মিডিয়ায়।
কিন্তু বিশ্বের এত দেশ থাকতে বাংলাদেশের কেবল নেটওয়ার্ক কেবল ভারতকে ঘিরে মরছে কেন? আমাদের জানালায় অর্ধেকের বেশী সংখ্যক ভারত কেন বসে থাকে? আমরা ওই ৪৫টি চ্যানেলে ভারতীয় বিজ্ঞাপন গিলছি শুধু তাই না, ওইসব চ্যানেলের অখাদ্য সিরিয়ালগুলোতে মেয়েরা যে শাড়ি চুড়ি গহনা পরে, বাংলাদেশের মেয়েরা তাই কেনার জন্য মার্কেটে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে তবু আমাদের ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি ডলারের ভারতীয় শাড়ি জামা কাপড় আমদানি করে এইসব হতভাগা দর্শকদের জন্য। ঈদের সময় বিশাল অংকের টাকা ব্যয় করে মানুষ ভারতীয় জবড়জং পোষাক ক্রয় করতে। উচ্চবিত্তের প্রভাবে মধ্যবিত্তরাও পাল্লা দিয়ে ওসব কিনে নিজেরা ফতুর হয় ঈদের বাজেটে।
আমরা কি ভেবে দেখেছি ওদের টিভি অনুষ্ঠান যতটা গিলছি আমরা, আমাদের বোকা জনগণ তার চেয়ে বহুগুণ বেশী গিলছে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের পণ্য।
No comments:
Post a Comment