Sunday, November 24, 2013

মফিজ গার্মেন্টসের ১৩ সেন্ট

কথাটা পেড়েই মফিজউদ্দিনের তোপের মুখে পড়ে গিয়েছিলাম। গালিগালাজের ব্রাশফায়ার কানের শ্রবণসীমা অতিক্রম করার আগেই আমি প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে যাই। বেনিয়া লোকটা হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেলেও মুখের ভাষাটার কোন ব্যবস্থা করতে পারে নি। শালার গাড়ল! ব্যাবসা বন্ধ করে দেবে বলেও হুমকি দিল। দিলে দে, আমার কি? গজগজ করতে করতে অফিস ত্যাগ করলাম।  
নামকরা এক গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক তিনি। না পোষালে তাঁর ব্যবসা তিনি বন্ধ করে দিতেই পারেন। আমার করার কি আছে?
বিতর্কটা গার্মেন্টস শিল্পে ন্যুনতম মজুরী নিয়ে। শ্রমিক পক্ষ থেকে দাবী উঠেছে ন্যুনতম মজুরি ৮০০০ করতে হবে। এই দাবীর সাথে তিনি একমত নন, আমিও না। এক সাথে এত টাকা বাড়ানো সম্ভব না। তবু একটা যৌক্তিক সমাধানের জন্য আমি বললাম, এতটা যখন সম্ভব না, অন্ততঃ মাঝামাঝিতে আসি চলুন। ন্যুনতম বেতন ৬০০০ টাকা করে দিন তাহলে ঝামেলা চুকে যাবে। এটা শুনেই মফিজ সাহেব তেল-বেগুন-মরিচে বিস্ফোরিত হলেন।
"বছরে ১৬ কোটি টাকা বাড়তি লাগবে, ১৬ কোটি টাকা!! এই টাকা কি আমার ইয়ে থেকে বের করবো, নাকি আপনার.......?"
বাকীটা বললাম না প্রকাশের অযোগ্য বলে। মফিজ সাহেবের টাকাপয়সার হিসাব রাখতাম আমি। শ্রমিক -মালিকের মজুরী যুদ্ধের ক্রস ফায়ারে চাকরীটা গেলেও যে হিসেবের কথা মফিজ সাহেব শুনতে চাননি সেটা আপনাদের উদ্দেশ্যে বলতে ইচ্ছে হলো-
মফিজ গ্রুপের শ্রমিক সংখ্যা ৫৫০০ জন, কিন্তু এদের অনেকেরই বেতন ৬০০০ টাকার লেভেল পার হয়ে গেছে। অতএব বেতন তাদেরই বাড়াতে হবে যাদের এখনো ৬০০০ টাকার নীচে। নীচের লেভেলে আছে ১৫০০ জন। এই ১৫০০ জনের সবার বেতন ৩৫০০ নয়, তবু হিসেবের খাতিরে  ধরে নিলাম ১৫০০ জনের মজুরি ৩৫০০টাকার লেভেলে আছে এবং এদের সবাইকে ৬০০০ টাকায় উন্নীত করার জন্য মাথাপিছু ২৫০০ টাকা বাড়তি দরকার হবে প্রতিমাসে।  
১৫০০ শ্রমিকের বেতন ২৫০০ টাকা করে বাড়াতে হলে বছরে কত টাকার দরকার হয়? 
১৫০০ x ২৫০০ x ১২ = ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অবশ্যই অনেকগুলো টাকা, কিন্তু মফিজ সাহেবের হিসেবের ১৬ কোটির অনেক কম!
তবু কথা হচ্ছে এই টাকাটাই বা কোত্থেকে আসবে? ক্রেতার কাছ থেকে নাকি মফিজ সাহেবের লাভের অংশ থেকে।
বছরে মফিজ কোম্পানী ৪৫ লাখ পিস গার্মেন্টস রপ্তানী করে। যদি এই বাড়তি টাকাটা ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করতে হয় তাহলে মফিজ সাহেবকে প্রতি পিসে ১০ টাকা বা ১৩ সেন্ট বেশী পেতে হবে। মফিজ কোম্পানীর জ্যাকেটের বাজার মূল্য প্রতি পিসে ১০০ ডলার ডলার হলেও FOB মূল্য ১০ ডলার। আমেরিকার ক্রেতা বাংলাদেশের কারখানাকে যে মূল্য পরিশোধ করে সেটাকে FOB মূল্য বলে। এই ১০ ডলারের মধ্যে ৭ ডলার কাঁচামাল আমদানীতে যায়। শ্রমিক মজুরীতে যায় ১ ডলার। অন্যন্য খরচ ১ ডলার। বাকী ১ ডলার মফিজউদ্দিনের নেট লাভ।
ওদিকে পশ্চিমা মানবাধিকারের অন্যতম সোল এজেন্ট আমেরিকার ক্রেতা 'গিলমার্ট' মফিজ কোম্পানীর ১০ ডলারের জিনিস ১০০ ডলারে বিক্রি করে তাদের সুপার মার্কেটে। ওরা চাইলে মফিজ কোম্পানীকে এই ১৩ সেন্ট বাড়িয়ে দিতে পারে। এই সামান্য বৃদ্ধি তাদের লাভের এক দানা চিনিও না। তবু মাল্টি বিলিওনিয়ার গিলমার্ট শ্রমিক অধিকার রক্ষার বাণী যত সহজে দেয়, এক দানা বাড়তি দিতে তার দশগুন কষাকষি করে। এই ১৩ সেন্টও হয়তো দেবেও না। 
গিলমার্ট যদি ১৩ সেন্ট না দেয়, মফিজউদ্দিন কি কারখানা বন্ধ করে দেবে?
মফিজ গ্রুপের কারখানা ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত। যার মধ্যে ব্যাংকের ঋন ১২৫ কোটি টাকা। বছরে ৩৫০ কোটি টাকার গার্মেন্টস রপ্তানী করে মফিজ কোং, কাঁচামাল খাতে ব্যয় করে ২০০ কোটি টাকা। মজুরী ও কারখানার বার্ষিক খরচ ৮৫ কোটি টাকা এবং ঋনের সুদ ২০ কোটি টাকা বাদ দিলে তাঁর করমুক্ত নীট লাভ ৪৫ কোটি।
আমি মফিজ হলে কি করতাম? মজুরি বৃদ্ধির বাড়তি খরচটা ক্রেতার কাছ থেকে না পেলে কি ব্যবসা বন্ধ করে দিতাম? নাকি শ্রমিক বেতন বৃদ্ধি করে বার্ষিক লাভ ৪৫ কোটির জায়গায় ৪০ কোটি টাকা মেনে নিয়ে চুপচাপ ব্যবসা করতে থাকতাম?
সুতরাং মফিজউদ্দিন আমার চাকরী খেলেও নিজে ব্যবসাচ্যুত হবেন বলে মনে হচ্ছে না।

No comments: