Sunday, November 17, 2013

একটি চেনা গল্প: স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট

১.
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |
হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?
সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
বন্ধ ক'রে
সঙ্গে আছে …
এক অসুখে দুজন অন্ধ !এক অসুখে দুজন অন্ধ !এক অসুখে দুজন অন্ধ !এক অসুখে দুজন অন্ধ !

[এটি শক্তি চট্টোপধ্যায় লিখেছেন। কিন্তু কি অদ্ভুত মিল! আমার চেনা দুজন মানুষকে দেখেছি এরকম একই অসুখে ভুগতে।]

২.
মাঝে মাঝে আরো কিছু অদ্ভুত মিল পাই। নীচের গল্পটিতে আমার চেনা মানুষের গল্প খুঁজে পেলাম। গল্পটি পড়তে গিয়ে আবার চোখ ভিজে গিয়েছিল। কিছু কিছু মধ্যবিত্ত জীবন ভয়ংকর সংকট লুকিয়ে প্রত্যেকটা দিন ভাণ করে কাটিয়ে দেয়। মানুষের জীবনের কত শতাংশ ভাণ হতে পারে? এদের কি ভাণ ছাড়া আর কোন গতি আছে? সচলায়তনে প্রকাশিত গল্পটি সংগ্রহ করে রেখে দিলাম তাই।
http://www.sachalayatan.com/aaynamoti/49814



স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট
----------------------------

আমি এ যুগের হরিপদ কেরানী। আমার গ্রামের ঠিকানা আপনারা জানবেন না। কিন্তু আমার শহরের ঠিকানা আপনারা চেনেন। শহরে নিন্মবিত্তদের জন্য তৈরী অগুনতি খুপড়ির একটিতে আমি থাকি। আমি একা থাকি না, আমার সাথে মা থাকে, বউ থাকে, সন্তান থাকে, ছোট দুই ভাই থাকে। বাবা বেঁচে থাকলে তিনিও থাকতেন। সুমনের 'দশফুট বাই দশ ফুট' গানটি শুনেছেন? আমি ছাত্রজীবনে শুনেছিলাম। এখন আমি সেই দশ ফুট বাই দশফুট ঘরে থাকি। সবাইকে নিয়ে। বিশ্বাস হয় না? না হবারই কথা। কারণ আপনারা এরকম জীবন দেখেননি।

আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেছি ইতিহাসে। পাশ করে আমি চাকরী পেয়ে গেছি তিন মাসেই। তার আগে আমি টিউশানি করে সংসার চালাতাম। তখন বেড়ার একটা বস্তি ঘরে থাকতাম। চাকরী পেয়ে আমি উন্নত বাসায় চলে আসি। হ্যাঁ আগের চেয়ে খুব উন্নত এই বাসা। ঝড় বৃষ্টি বাদলায় না ঘুমিয়ে চৌকির উপর বসে থাকতে হবে না আর। একটা পাঁচতলা দালানের তিন তলায় দশ ফুট বাই দশফুট একটা ঘর। সাথে লাগোয়া রান্নাঘর আর বাথরুম। গ্যাসের লাইন আছে। সপ্তাহে তিন দিন পানি আসে লাইনে। আর কি চাই। ভাড়াও নেহায়েত খারাপ না। ৩৫০০ টাকা। আর একশো টাকা দিলে ডিশের লাইনও দেবে। কিন্তু আমার টিভি নেই, ডিশ কি করবো। আমি যখন চাকরীতে ঢুকি তখন ৮০০০ টাকা বেতন। দুবছরে আমার বেতন বেড়ে ১০০০০ ছুঁই ছুঁই করছে।

আমি যখন ভার্সিটিতে ঢুকি তখন স্বপ্নে দশ হাজার টাকার একটা চাকরী ঘাপটি মেরে বসে ছিল। বাস্তবে বছরে ১০% হারে মুদ্রাস্ফীতি যোগ হলেও স্বপ্নে তার কোন ছাপ পড়েনি। আমার স্বপ্ন সফল হতে তাই কোন অসুবিধা হয়নি। আমি যখন স্বপ্ন দেখছিলাম তখন বাবার দোকানটা ছিল, দোকানের আয়ে সংসার চলতো ফুরফুর করে। আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতাম দশ হাজার টাকার একটা স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্নে ছিলাম কেবল আমি আর সুনন্দা। আমাদের দুজনের একটা সংসার, ফুটফুটে একটা বাচ্চা।

কি অবাক কাণ্ড দেখুন, আমার সেই স্বপ্নটা কেমন হুবহু পূরণ হয়ে গেল! শুধু একটা পার্থক্য। তিন বছর আগে হুট করে বাবা মারা গেলে আমার স্বপ্নের সংসারে ঢুকে গেল মা আর দুইভাইও। বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের মধ্যে ছিল ছাপ্পান্নো হাজার টাকার একটা ঋণের বোঝা। সাড়ে তিন বছরের টিউশানীর জমানো টাকা থেকে বোঝাটা হালকা করেছি। ফলে আমি যখন চাকরীতে ঢুকি তখন ঋণমুক্ত।

চাকরীর এক বছরের মাথায় সুনন্দাকে বিয়ে করতে হলো। ভাবছেন সুনন্দাকে কেন বিয়ে করতে হলো এরকম চাপাচাপি সংসারে? উপায় কি বলুন, না করলে তো সে চলে যেতো অন্য ঘরে। "চাকরীটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো...."..বলে কাঁদলে কোন লাভ হতো না তখন।

সে যাই হোক, আমি কেবল চাকরীটা আছে বলেই সন্তুষ্ট। সুনন্দা, ছোট্ট বাবু, মা, দুই ছোট ভাই, এদেরকে নিয়ে একটা ছাদ দেয়া ঘরে বাস করতে পারছি এতেই সুখী। আমি যেখানে কাজ করি সেটা বাসা থেকে দুই মাইল দূরে। রিকশায় গেলে বিশ টাকা, বাসে গেলে পাঁচ টাকা। আমি হেঁটেই যাই। ঝড় বাদলার দিনে একটু অসুবিধে হয়। তবু ভেবে সুখী হই দুই কায়দায়। রিকশায় না গিয়ে বাঁচলো মাসে পাঁচশো টাকা। বাসে না গিয়ে বাঁচলো দেড়শো টাকা। ভাবছেন অভিনব সুখপন্থা? আসলে পাঁচশো টাকায় মায়ের ওষুধের খরচ উঠে যায়, দেড়শো টাকায় মাসে একবার রুই মাছ কিংবা মাংস খেতে পারে পরিবার।

আমরা সাধারণত নিরামিষভোজী। মাছ মাংস তেমন ছুঁই না। শাক, ভাত, ডাল - এই তিনে চলে যায়। শরীরের জন্য তেল ক্ষতিকর, তাই আমরা তেল কিনি না। চিনি খেলে মায়ের সুগার বাড়ে, তাই চিনিও বাদ। আমরা চা নাস্তা করি না। তবে মেহমান আসলে একটু বিপদে পড়ে যাই, তাই আমি কাউকে বাসায় আসতে বলি না। বাবুর জন্মের পর বিপদে পড়েছি খানিক। খরচপাতি বেড়ে গেছে। সুনন্দা ট্যা ট্যা করে বাবুর জন্য দুধ কেনা দরকার, বাইরে খাবার না খেলে শরীর বাড়বে না। আমি চুপ করে থাকি। করার কিসসু নাই। আমার বাজেটে বাড়তি সুযোগ আছে কি? হিসেবটা দেখুন- দৈনিক তিন বেলা খাবার পেছনে দেড়শো টাকা লাগে, পুরো মাসে সাড়ে চার হাজার। খাওয়া ঘর ভাড়া বাদ দিলে বাকী থাকে দুই হাজার। দুই ভাইয়ের স্কুলের খরচ আটশো টাকা। বইখাতা পেন্সিল কলম বাবদ আরো দুশো। মায়ের ওষুধপত্র, বাথরুমের সাবান, টুথপেষ্ট এসবে লাগে আরো চার পাঁচশো টাকা। দশ হাজার টাকার হিসেবটা তো প্রায় খতম, আর বাড়তি কোথায় পাই। বাবুটাকে আমাদের তিন পদে অভ্যস্ত করতে বলি।

তবে হ্যাঁ কেউ যদি অবিবেচকের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন বিপদ। তেমন বিপদ মাত্র একবার ঘটেছিল গত বছর। ধার করে এরকম বিপদ সামাল দেয়া যায়, কিন্তু তেমন ধার শোধ করতে অপেক্ষা করতে হয় বছরের ঈদ বোনাসের সময় পর্যন্ত। হ্যাঁ ঈদের সময়টা খুব আনন্দের। ওই একটা দিন আমরা নিরামিষভোজী থেকে বেরিয়ে আসি। জামা কাপড়ে ব্যয় কমিয়ে একদিন একটু ভালো খাই। অতিথি সেবা করি। ওই্ একদিনের পোলাওয়ের স্বাদ আমাদের নস্টালজিক করে দেয়। বাবার আমলে আমরা মাসে দুয়েকবার এমন খেতে পারতাম।

এই দেখেন কেবল খাওয়াদাওয়া নিয়েই আছি। বাসস্থানের দিকে নজর দেয়া হলো না এখনো। চলুন বাসস্থানের গল্প করি। আগেই বলেছি দশফুট বাই দশফুট। বাবা মারা যাবার পর আমরা যখন বস্তিতে চলে যাই তখন একটা চৌকি বাদে আর সব আসবাব বিক্রি করে দিয়েছিলাম। জায়গা নেই রাখবো কোথায়? বস্তি ছেড়ে এখানে আসার সময় চৌকিটাও বেচে দিয়েছি দুইশো টাকায়। চৌকি থাকলে বরং এখানে শোবার অসুবিধা। এখন মাদুরের উপর কাঁথা বিছিয়ে তার উপর বিছানার চাদর পেতে পাশাপাশি দুটো বিছানা তৈরী করি রাতে শোবার আগে। এক বিছানায় আমি সুনন্দা আর বাবু। অন্য বিছানায় মা আর দুই ভাই। আমরা ম্যানেজ করে নিয়েছি। করতেই হয়। অসুবিধা হয়নি।

এই দালানে মোট ৫৫টি খুপড়ি ঘর। বড়লোকেরা এরকম জিনিসকে বলে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। শখ করে কিনে বিদেশে এমনকি কক্সবাজারের সৈকতে। আমাদের এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে এসি নেই। টিভি, ফ্রীজ নেই। এমনকি খোলা জানালার আকাশও নেই তবে বৈদ্যুতিক আলো আর ফ্যানের বাতাস আছে। তবু এখানে আমি সুখী। কেননা সুনন্দা আমাকে অভিযোগ করে না। মা আমাকে অভিযোগ করে না, ভাইয়েরা অভিযোগ করে না। ওরা জানে আমি সীমাবদ্ধ। প্রবল প্রবল সীমাবদ্ধতা আমার হাত পায়ে সমস্ত শরীরে। ওরা তাই দিনের পর দিন একই রঙের শাক ভাত আর ডাল খেয়ে কাটিয়ে দেয়। বাবুটা মাত্র ছমাস, সে এখনো বোঝে না দুনিয়ার হালচাল। তার চোখে হয়তো গোটা দুনিয়াটাই আলোবাতাসহীন একটা ষ্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট।

আমি যেখানে কলম পিষি, সেখানে দুপুরে খাবার মেলে। এক সাথে কয়েকশো মানুষের খাবার রান্না হয়। ভাত আর ডাল যত খুশী খাও, সবজি মাছ মাংস ডিম যে কোন একটা এক বাটি করে। আমার সামনে যখন মাছ মাংসের বাটি আসে, আমার ইচ্ছে করে ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে মাছ বা মাংসের টুকরোটা কাগজে মুড়ে ঘরে নিয়ে যাই। কিন্তু আমার আশেপাশে যারা বসে তাদের সবাই স্বচ্ছল ঘরের সন্তান। তাদের পাশে বসে এই কাজ করা যায় না। ওরা কেউ জানে না আমি কেমন জীবন কাটাই। আমার মুখোশকেই সত্যি মনে করে ওরা। জানি ওরাও দশ হাজার টাকাই বেতন পায়, কিন্তু ওই টাকার উপর ছ জনের একটা পরিবার নির্ভর করে না।

আমি খুব টানাটানি সংসারী? কথা সত্যি। তবে আমার দশ হাজার টাকাকে কখনো কখনো যখন বেশী টানটান মনে হয় তখন আমি আরেকটু নীচের দিকে তাকাই। নীচের ফ্লোরে রঙিন জামা পরা মেয়েগুলো মাসে চার পাঁচ হাজার টাকার বেশী পায় না। তবু ওদেরকে কোন কোন সময় আমার চেয়েও বেশী হাসতে দেখি। ওই হাসির পেছনেও কি কষ্টের নহর? জানি না। ওদের কষ্টের কথা ভেবে সমবেদনার বদলে আমি বরং সুখী হয়ে উঠি আবার।

সন্ধ্যে ছটার পরে কাজ থাকলে একটা ছোট বিস্কুটের প্যাকেট আর একটা কলা দেয় আমাদের। এই দুটো জিনিস পকেটে করে বাড়ি নিয়ে আসতে কষ্ট হয় না আর। কলাটা মাকে দেই, মা অর্ধেক দেয় সুনন্দাকে, বিস্কুট সবাই একটা করে খাই। তখন আমরা সবাই খুব হাসি এক সাথে হাসি, যেন আমরা আসলেই সুখী নগরীর বাসিন্দা।

এই পাঁচ তলা দালানের ছাদের উপর দিয়ে হু হু বয়ে যাওয়া বাতাসে বিনে পয়সার সুখ। কোন কোন রাতে ছাদে উঠে আমি সেই সুখ স্পর্শ করি। সুখের আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলি অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভুলে। আমি প্রতিদিন একটা পুরোনো ঘ্রাণের নতুন জীবন নিয়ে জেগে উঠি এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে।

[ পাদটীকাঃ না দেখা জীবন নিয়ে গল্প লেখার অভিজ্ঞতা আমার নেই। দেখা জীবন নিয়ে গল্প লিখতেই হিমশিম খাই। তবু এই গল্পটা লিখতেই হলো একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনে। লিখতে হলো সেই সব ধনবান নিয়োগকর্তাদের উদ্দেশ্যে যারা নিয়োগ পত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার চাহিদাটা যেরকম মোটা অক্ষরে লিখেন, পারিশ্রমিকের অংকটা সেই অক্ষরে লিখতে পারেন না। শ্রমিক শোষণ নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য দেশে বিদেশে অনেক মানবাধিকার গোষ্ঠী থাকলেও এসব শিক্ষিত অর্ধাহারী তরুণদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। অথচ প্রায় ভিক্ষুকের জীবনযাপন করে এদের কেউ কেউ। যদি কোথাও অতিরঞ্জন মনে হয় তবে সাভার আশুলিয়া বা রামপুরা রোডের যে কোন গার্মেন্টস কর্মীর আবাস স্থলে ঘুরে আসতে পারেন। ]




No comments: