Saturday, April 19, 2014

২০ এপ্রিল ২০১৪: এই শনিবারে

১.
ইতিহাস পাঠে একটা ঝামেলা থাকে। যিনি ইতিহাস লিখেন তিনি সচরাচর নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। এর মধ্যেও গ্রহনযোগ্য ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে। পাঠককে একটু সতর্ক থাকতে হবে, মাথাটা সজাগ রাখতে হবে। যিনি ইতিহাস লিখেছেন তাঁর খানিক ইতিবৃত্ত জেনে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। এটা সবসময় সম্ভব হয় না, তাই মগজের যুক্তিবাদী কোষগুলোর সঠিক ব্যবহার দরকার। আশ্চর্য হলেও সত্য যে এদেশের গত কয়েকশো বছরের ইতিহাসের অধিকাংশ বই লেখা হয়েছে ভিনদেশী লেখকের হাতে। অষ্টাদশ শতকের উপনিবেশ যুগের সূচনার ইতিহাস পড়তে গিয়ে টের পেলাম বিদেশী লেখকরা যেভাবে বিস্তারিত তথ্য সহকারে ইতিহাস লিখেছেন, এই দেশের কেউ অত বিস্তারিত ইতিহাস লেখেননি। নাকি আমিই তেমন বই খুঁজে পাইনি, কে জানে। আলীবর্দী খাঁর আমল কিংবা তার আগে আরো একশো বছর আগের ইতিহাস ইংরেজ লেখকের বইতে যতটা বিস্তারিত পেয়েছি আর কোথাও পাইনি। ফলে তিনশো বছর আগের কোন ব্যাপারে বিশদ তথ্যের জন্য আমাকে নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে ভিনদেশী লেখকের উপর। মুশকিল হলো একজন ইংরেজ স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখবে। লর্ড ক্লাইভের জীবনী পড়তে গিয়েও একই কাহিনী। ক্লাইভ স্বভাবতই তাদের কাছে হিরো, সিরাজউদ্দৌলা ভিলেন। জগতশেঠ তাদের কাছে একজন মহৎ ধনকুবের। মীরজাফর, ঘসেটি বেগম আলীবর্দী খাঁর সুবিধাবঞ্চিত বিক্ষুব্ধ আত্মীয় মাত্র। তবু ওই ইংরেজ লেখককের জবানী থেকেই ছেঁকে ছেঁকে কিছু তথ্য বের করা যায়। পলাশীর ঘটনা নিয়ে একাধিক ইউরোপীয়ান লেখকের বই আছে। আছে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইতিহাস নিয়েও। সেখানে খুব সতর্কভাবে চোখ বুলালে আমাদের দেশীয় রাজরাজড়াতের কিছু দুর্বলতা বের হয়ে আসে। রাজরাজড়াদের অনৈক্য, লোভ, ঈর্ষাপরায়নতা এই তিনটা দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজ খুব সহজেই জয়লাভ করেছে বাংলায়। তারপর তারা ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতবর্ষে তাদের থাবা বিস্তার করেছে। ভারতের মতো একটা বিশাল দেশকে করায়ত্ত করা, উপনিবেশে পরিণত করার কথা কোন ইউরোপীয় শক্তি কল্পনাও করেনি তার পঞ্চাশ বছর আগেও। তারা শুধু বাণিজ্য করার জন্যই প্রথমে এদেশে এসেছিল। ভাস্কো দা গামার হাত ধরে প্রথমে পূর্তগীজরা পা রাখলো ভারতে, তারপর অন্যন্য ইউরোপীয়ান জাতি এদিকে ছুটে আসতে থাকে বাণিজ্য লোভে। সর্বশেষ আসে ইংরেজ। কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশী সফলতা অর্জন করে। তারাই সক্ষম হয় সমগ্র ভারতের অধীশ্বর হয়ে যেতে। সামান্য কয়েক হাজার সাদা চামড়ার হাতে বন্দী হয়ে গেল কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষ।

২.
ইতিহাসের মতো মানুষ পাঠেও ঝামেলা আছে। একটা মানুষের সাথে দীর্ঘসময় বাস করেও কেউ নিশ্চিত হতে পারবে না সে মানুষটিকে ঠিকভাবে বুঝে ফেলেছে। প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষই একমাত্র যার ভেতরে বাস করে একাধিক মানুষ। আমরা যাদের সাথে খাইদাই ঘুমাই আড্ডাই তাদের মাত্র একটা চেহারার সাথে আমরা পরিচিত। তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বাকী মানুষগুলোকে আমরা দেখি না। দেখা যায় যে মানুষটা সবার খুব হাসিখুশী আড্ডা দিচ্ছে, তার বুকের গভীরে হয়তো জমে আছে কঠিন কোন বেদনা। যা সে দক্ষতার সাথে লুকিয়ে ফেলছে। একই আড্ডায় অনেক মানুষ থাকলেও সবার সাথে সবকিছু শেয়ার করা যায় না। কেউ কেউ খুব প্রিয় কোন বন্ধুর কাছে শেয়ার করে। আবার এমনো কিছু বিষয় আছে যেটা শুধু নিজের সাথেই বলা যায়। প্রিয়তম বন্ধুটিও জানতে পারে না। তাই কেউ যদি বলে ফেলে, আমি তোমার সবটা জেনে গেছি, বুঝে গেছি, সে নিতান্তই অর্বাচীন। আমাদের সবার মনের ভেতরে অনেক জটিল সমীকরণ খেলা করতে থাকে, এমনকি যখন ঘুমাই তখনো। অবচেতন মন মাঝে মাঝে সচেতন মনকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। আমরা দুঃস্বপ্ন ভেবে জেগে উঠি। এরপর আবার যখন ঘুমিয়ে পড়ি তখন আর কিছুই মনে থাকে না। সকালে উঠে শুধু রাতের এটুকুই মনে থাকে যে কিছু একটা দেখেছিলাম। কী সেটা কিছুতেই মনে আসে না। মানুষ বাদে আর কোন প্রাণীর কি এতটা বহুরূপী চেহার আছে? নাই। মানুষ তাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। একই সাথে মানুষ সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবও। কারণ এই মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে ধ্বংসের অমোঘ সব অস্ত্র। যা তার জিহ্বার পেছনে লুকিয়ে থাকে, সময়ে বের হয়ে আসে বিষদাঁত। তখন চেনা মানুষ হয়ে যায় অচেনা। মানুষের ইতিহাস লেখা সহজ নয়। সম্পূর্ণ ইতিহাস লেখা তো প্রায় অসম্ভবই। আমি তাই মানুষ চেনার কাজ বাদ দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসের ভেতরে ডুব দেই।

৩.
গতকাল বাতাসে একটু মমতার ছোঁয়া থাকলেও আজ সকাল থেকে নির্মম কর্কশ। বৈশাখ জ্যেষ্ঠে এরকম গরম পড়বেই। তবু আমরা অভিযোগ করি অনির্দিষ্ট কারো কাছে। যে যার রুটিনে কাজ করবে, এতে অভিযোগ করার কোন মানে হয় না। পৌষমাসে যদি এরকম গরম পড়তো তাহলে অভিযোগ যুক্তিযুক্ত। এই চিন্তা মাথায় আসার পর আমি গরম অনুভব করি কিন্তু অভিযোগ করি না।

৪.
এই শনিবারটা একটু অন্যরকম হবার কথা ছিল। হলো না। মানুষের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় না। ইতিহাসের খাতায় আরেকটি ব্যর্থ শনিবারের নাম যুক্ত হয়ে গেল। স্পেস স্পেস স্পেস.......


No comments: