কথা বলা দূরে থাক, পানি খেতে, এমনকি ঢোক গিলতেও সাহস পাইনি কদিন। প্রায় দশ পনের দিন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মানুষের গলায় যে এরকম কোন গজব নামতে পারে আগে জানতাম না। কথাবার্তা সব ইশারায় চলেছে। মোবাইল ফোন তো হারামই হয়ে গিয়েছিল। পরিবারের সব মানুষ আর সহযোগী অর্ধাঙ্গিনী না থাকলে কি ভয়ংকর অবস্থা হতো ভাবা যায় না। নাক-গান-গলা বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করে ঘোষণা দিলেন- গলার ভেতর ব্যাকটেরিয়ার কাফেলা আস্তানা গেড়েছে বেশ ভালোভাবেই। ওরা দালানকোটা তুলে মোটামুটি একটা মহানগরী তৈরী করে ফেলেছে ওখানে। ফলে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে গেলেও মরনাঘাত লাগে।
গরম পানি, গরম তরল বাদে আর যে কোন খাবার বন্ধ হয়ে গেল। রাতে ঘুম আসে না, গলাবন্ধ হয়ে নিঃশ্বাস আটকে যায় প্রায়। সমস্ত শরীর জুড়ে অস্বস্তি। মাথা কাজ করে না। গলা জিহবা থেকে কর্নকূহর পর্যন্ত ব্যথায় টনটন। বিছানায় একবার শুই আবার উঠে বসি। শুলে মনে হয় দম আটকে যাবে, বসলে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। ওষুধের কোর্স এগিয়ে যাচ্ছিল, দুবেলা দুটো করে দুই এন্টিবায়োটিক (Merocef 250)+ (Zox 500), দুবেলা দুটো পেইনকিলার (Coxia 120mg), তিন বেলা ভায়োডিন মাউথওয়াশ, আর একটা ঘুমের ওষুধ। কিন্তু ফলাফল শূণ্য থাকে তিনদিন পর্যন্ত। বাড়ছিল হতাশা। বুঝতে পারছিলাম মানুষ কোন সময় আত্মহত্যার কথা ভাবে। শিশু সন্তান দুটোর কথা ভাবি। একজন ছয় আরেকজন তিন। ওদের বাকী জীবন কিভাবে কাটাবে আমিহীন।
নাহ। বাজে চিন্তা বাদ। সুস্থ হয়ে উঠতেই হবে। চারদিনের পর থেকে গলার একটু উন্নতি দেখা যায়। আগে ভোর ছটায় জেগে প্রথম বাক্যটি বের করার জন্য তিন ঘন্টা কসরত করতে হতো। এখন এক ঘন্টায় পারছি। আস্তে আস্তে বেঁচে উঠতে থাকি। তবে রাত হলেই আবার আতংক। ঘুম না আসলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু মৃত্যুদূতের নর্তন কুর্দন সহ্য হচ্ছিল না। একদিন দেখালাম আমাকে একটা গরম পানির ডেকচিতে চুবিয়ে রেখে সেই ডেকচির চারপাশ ঘিরে আট দশজন মৃত্যুদূত কুড়াল হাতে নাচতে শুরু করেছে। চমকে উঠে বসি। মৃত্যুদূতেরা একটু আড়ালে চলে যায়। আমি জানি চোখ বন্ধ করলেই ওরা ফিরে আসবে, তাই ভয়ে চোখ বন্ধ করি না।
এভাবে সাত দিন পার হবার পর আমি উঠে বসি। দশদিনের দিন বারান্দায় গিয়ে বিকেলের রোদ, রাস্তায় চলাচলরত গাড়ি, আর দক্ষিণাকাশে ঝুলে থাকা শাদা মেঘের পুঞ্জগুলি দেখতে থাকি। সেই দিনের আলোতেও একদিন দেখি একফাল অর্ধচন্দ্র এক রঙা ঘুড়ির মতো ভেসে আছে। এখনো আশা আছে বৈকি। জীবনের রূপরস নতুন করে গ্রহন করার জন্য আবারো তৈরী হই।
ওশিন এসে গলা জড়িয়ে ধরে চুপ করে থাকে। পেছন থেকে সোয়া তিনের শিহান এসে হাতের আঙুল ধরে টেনে টেনে বলতে থাকে - 'বাবা তিবি দ্যাকবো, তিবি দাও'!
ওর আবদারে অনেকদিন পর আমার মুখে হাসি ফোটে। আমি ফ্যাসফ্যাস গলায় কোনমতে উচ্চারণ করি - 'আমিও দ্যাকবো!'
এই দুটোর জন্য দীর্ঘসময় বেঁচে থাকার লোভ হয়।
[অসুস্থ সময়ে সবচেয়ে বেশী মনে পড়েছে ব্লগার অনার্য সঙ্গীতের কথা। তার প্রিয় ব্যাকটেরিয়া বাহিনীর কবলে আমি কেমন আছি জানাতে ইচ্ছে করছিল খুব। পোষ্টটা সে উদ্দেশ্যেই লেখা]
No comments:
Post a Comment