সময় গেলে মানুষ তার প্রিয় জিনিসকেও অবহেলা করে। এমনকি মানুষও সেই একই অবহেলার স্বীকার। বস্তু বা মানুষ এক্ষেত্রে প্রায় একই কাতারে। তবে নিরাপত্তার খাতিরে মানুষকে বাদ দিয়ে বস্তুকে নিয়েই লিখবো। মানুষ খুব বিপদজনক প্রাণী। বস্তুর সুবিধা হলে তাকে নিয়ে অপ্রিয় সত্যি কথা লিখলেও সে বিগড়ে যায় না চট করে।
একবার খুব প্রিয় একটা জিনিস কেনা হলো। কেনার পর দিনরাত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। জেগে থাকার প্রায় সম্পূর্ন মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকা। কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখা। নিজের জিনিসটা অন্যের চেয়ে কতো বেশী চমৎকার সেটা ভেবে মনে মনে পুলকিত হওয়া। কয়েকদিন যাবার পর জিনিসটার প্রতি অভ্যস্ত হওয়া। ঘনঘন ব্যবহার করার ছুতো খোজা। তৃতীয় পক্ষকে লুকিয়ে একটু বেশী আদর যত্ন করা। যেন হারিয়ে না যায় খুব সতর্ক থাকা। হারিয়ে যেতে পারে এমন জায়গায় নিয়ে না যাওয়া কিংবা তেমন জায়গা পরিহার করা। ঘরের বাইরে গেলে যতটা সম্ভব প্রকাশ্যে না আনা।
অতঃপর প্রাথমিক মুগ্ধতা কাটতে থাকবে আস্তে আস্তে। জিনিসটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে চোখের সামনে। এখন আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে না। আদরের চেয়ে কাজের ব্যাপারেই বেশী দেখা সাক্ষাত হবে। প্রকাশ্যে টেবিলের উপর রেখে দেয়া যাবে। ছিনতাইয়ের ভয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে না। সহজভাবে ব্যবহার করা যাবে। মাঝে মাঝে ব্যবহার না করেও চলে যাবে। থাকলে ভালো, না থাকলেও চলে। অন্যের হাতে থাকা নতুন কোন জিনিসের দিকে নজর যাবে।
অন্যের হাতে থাকা ওই জিনিসের সুবিধা সৌন্দর্য দুটোই বেশী মনে হবে। নিজের জিনিসটার জন্য আক্ষেপ বাড়বে। এটা থেকে মুক্তির সুলভ উপায় খুজতে ইচ্ছে করবে। আগের অর্ধেক দামে বিক্রির উপায় খুজবে। জিনিসটা আগের মতো কাজ করছে না মাঝে মাঝে হ্যাং হয়ে যাচ্ছে বলে বিরক্ত লাগবে। মাঝে মাঝে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া আছাড় দেয়া উচিত হবে না বলে মূলতবী রাখা হবে। বিকল্প আরো উন্নত জিনিসের জন্য পয়সা জমাতে শুরু করবে। বিকল্প পাওয়া মাত্র এটা কাউকে এমনকি বিনামূল্যেও গছিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে। নতুন পাওয়ামাত্র পুরোনো জিনিসের নিন্দায় মূখর হতে হবে। পুরোনো জিনিসটা কতো খারাপ ছিল নতুনটা পাওয়ার আগে বুঝিনি বলে নিজে নিজে লজ্জা পাওয়া হবে। নতুনের জয়গান গেয়ে নতুন দিনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে একদিন এই নতুনের দিনও ফুরোবে, একই ভাগ্য বরণ করবে এই নতুনও। চিরনতুন বলে কিছুই নেই বস্তু ও মানবজীবনে।
আমার জিনিসটার দৈর্ঘ ১০ সেমি, প্রস্থ ৫সেমি, গভীরতা ১ সেমি। ওজন ১১০ গ্রাম। দেখতে কালো তবে চকচকে। কিন্তু চকচক করলেই সোনা হয় না। এমনকি কালো সোনাও না। হলে কি হবে এটি সোনার চেয়েও দামী। সেটা একটু পরেই বুঝবেন। তবে জিনিসটা চ্যাপটা, পুরো শরীরজুড়ে আয়না। আড়াই ইঞ্চি বাই দেড় ইঞ্চি। এটারে আদর করে বলে ডিসপ্লে এরিয়া। এটা পকেটে বহন করা যায়, হাতের তালুতে ধরে রাখা যায়, ঢিল মেরে ছুড়েও ফেলে যায়। কিন্তু পড়ে ভেঙ্গে গেলে কিংবা পানিতে ডুব দিলে তাকে আর জীবিত পাবেন না। তখন আপনি একাই মাথার চুল ছিড়বেন। আদুরে ডিসপ্লে এরিয়াটা পুরোটাই একটা টাচ স্ক্রীন। আদুরে কারণ এটাকে আদর ছাড়া চালানো যায় না। টাচ স্ক্রিনে আঙুলের আদর দিয়ে তাকে পরিচালানা করতে হয়। আদুরে না হয় হলো কিন্তু তা আপনাকে কি কি সুবিধা দিতে সক্ষম তা দেখা যাক।
১. হুকুম করা মাত্র সে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের সাথে টেলিযোগাযোগ ও মেসেজ সার্ভিস স্থাপন করে দেবে
২. তার ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইমেইল ব্রাউজিং দিয়ে জ্ঞান বিনোদন জগতে ডুবে যেতে পারবেন
৩. কারো ঠিকানা জানেন অথচ তাকে খুজে পাচ্ছেন না? গুগল ম্যাপে ঠিকানা টাইপ করে আলতো চাপ দিন। পৃথিবীর আনাচে কানাচের যে কোন ঠিকানায় চলে যেতে পারবেন মুহুর্তেই
৪. পথিক আপনি পথ হারাইয়াছেন? ভয় নেই। জিপিএস লোকেটর দিয়ে গুগল ম্যাপে নিজের অবস্থান বের করে ফেলতে পারবেন কয়েক সেকেণ্ডেই।
৫. জ্ঞানার্জন করবেন? গুগল উইকিপিডিয়া দিয়ে সারা বিশ্বের তথ্যভাণ্ডার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারবেন
৬. মাথা নষ্ট করার ইচ্ছে আছে? এফএম রেডিওর বাংলিশ টক শো কিংবা গান অথবা খবর কিংবা বকর বকর শুনতে পারেন
৭. বিটিভি দেখায় অরুচি? কিন্তু হাতের তালুতে আস্তে একটা টেলিভিশন খারাপ লাগবে না এমনকি বিটিভি হলেও। জিনিসটাকে আলতো ছোয়ায় টেলিভিশন বানিয়ে দেয়া যায় নিমেষেই
৮. বোরিং? দারুণ সব গেম আছে গেমিং জোনে। বসে বসে ঝিমানোর বদলে মজার মজার গেম খেলুন
৯. কতোদিন গান শোনার সময় পাননি? বোতাম টিপলে এটি মিউজিক প্লেয়ার, আঙুলের পরশে গান শুনুন ইচ্ছেমতো সাজিয়ে
১০. ভিডিও, নাটক মুভি দেখবেন? ভিডিও প্লেয়ার চেপে উপভোগ করুন পছন্দের আইটেম।
১১. হুটহাট ছবি তোলার শখ? কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরার দরকার নেই। এটাকেই ডিজিটাল ক্যামেরা বানিয়ে ফেলতে পারেন।
১২. শুধু ছবিতে পোষাচ্ছে না? ভিডিও ক্যামেরায় ক্লিক করুন। ঘন্টা পর ঘন্টা ভিডিও করুন ব্যাটারীর বারোটা না বাজা পর্যন্ত্
১৩. ছবি তুলেই সন্তুষ্ট না? ছবিতে রংচং কার্টুন যোগ করবেন? ছবি এডিট অপশন খুলে নিশ্চিন্তে বসে যান কারো চেহারায় মুখোশ কারো পাছায় লেজ জুড়ে কোলাজের মজা নিন।
১৪. এতে আরো আছে একখানা ক্যালকুলেটার
১৫. আছে কয়েক রকমের এলার্ম
১৬. আছে একখানা রঙিলা ক্যালেণ্ডার
১৭. আছে ডিজিটাল ছবির নান্দনিক অ্যালবাম
১৮. আছে বহুমূখী একখানা কনভার্টার (দৈর্ঘ প্রস্থ, ওজন, এরিয়া ইত্যাদি)
১৯. টুকে রাখতে চান অতি জরুরী কোন মেসেজ বা তথ্য? চট করে নোট খুলে লিখে রাখুন
২০. ব্লু টুথ? হ্যাঁ এতে একখানা নীলদাঁতও আছে। বিশ্বাসী বন্ধুর সাথে বিনিময় করুন ছবি কিংবা ভিডিও কিংবা যে কোন ফাইল।
২১. সুযোগের অভাবে আপনি বাথরুম সিঙ্গার? নির্ভয়ে বাথরুমে গিয়ে রেকর্ড করে নিন পছন্দের গান। এটি একটি ভালো রেকর্ডারও।
২২. দৌড়বিদ? দৌড় শুরুর আগে স্টপওয়াচ চালু করে দিন, আপনার পদক্ষেপের গতিময়তার নিখুত হিসেব দিয়ে দেবে।
২৩. আকাশ মেঘলা অথচ বুঝতে পারছেন না বৃষ্টি হবে কিনা? ক্লিক করুন আকু ওয়েদার বাটনে। আবহাওয়ার প্রতিমুহূর্তের আপডেট, আগামী কয়েকদিনের ফোরকাষ্ট
২৪. আর কি চাই? শতশত গান ছবি ভিডিও মেমোরিতে জমা করে রাখুন। দরকার মতো মুছে ফেলুন আবার যোগ করুন।
২৫. কম্পিউটারে মতো ফোল্ডার তৈরী করে সকল গান কবিতা আর তথ্য জমা রাখুন তথ্য ভাণ্ডারে পরিণত করুন হাতের ইশারায়
২৬. এটি একটি ছোটখাট অফিসও। অফিসের মেইলে এটাচমেন্ট থাকে। এই জিনিসে এমএসওয়ার্ড এক্সেল পিডিএফ টেক্সট ইত্যাদি ফাইল স্বচ্ছন্দে পড়তে পারেন
২৭. রিজার্ভ গান বাদ দিয়ে ইন্টারনেটের গান শুনতে চান? ইউটিউব ভিডিও চালু করে দিন
২৮. এছাড়াও আছে ফ্লিকার, পিকাসা, ফটোবাকেট, সব কিছু এক আঙুলের ইশারায় পাওয়া যায়।
২৯. বিশ্বের টাইমজোন তো এখন আপনার হাতের মুঠোয়। তবে জোরে চাপ দেবেন না, বিশ্বের সময় নড়বড়ে হয়ে যাবে।
৩০. বেকার লোক আপনি? তাই প্রচুর ব্যস্ততা? চিন্তার কিছু নেই। সারা বছরের শিডিউল, ডায়েরী, রিমাইণ্ডার ইত্যাদি জমা রাখা যায় একদম বিনামূল্যে
৩১. ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে অন থাকতে চান? তর্জনীর ইশারায় ঢুকে পড়ুন বন্ধুদের আড্ডাখানায়।
৩২.....৩৩......৩৪.......ইটিসি ইত্যাদি
জিনিসটা কি আর বোধহয় বলে দেবার দরকার নাই। জিনিসটার নাম মোবাইল ফোন। কিছু সুবিধা কম বেশী হলেও এই জিনিস আজকাল সবার হাতে হাতে। এরকম একটা কার্যকরী যন্ত্র হাতে থাকলে নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম অলস প্রাণীতে পরিণত করতে খুব বেশী কি বেগ পেতে হয়? হয় না। আমারও হয়নি। কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন যাতায়াত সত্ত্বেও হয়ে গেছি প্রচ্ছন্ন বেকার। শুয়ে শুয়েও অফিসের মেইল চেক করে ফেলি। নাম বদলে হয়েছি গৃহিনীর আদুরে ভাষায় 'কুঁড়ের বাদশা' ওরফে অলস দ্য কিং।
তবে আমাকে অলস দ্য কিং বানাবার এই যন্ত্রটিকেও আজকাল নীরস মনে হচ্ছে। এটাই হলো মুশকিল। মুগ্ধতার দিন শেষ। সহনীয়তাও শেষের পথে। দিন যতই যাচ্ছে মনে হচ্ছে আমার আরো অলস হওয়া উচিত। অথচ এটা আমাকে আরো বেশী অলস বানাতে পারছে না। এর চেয়ে ভালো কিছু বাজারে এসেছে কিনা খোঁজ নেই প্রতিদিন। মানুষের চাহিদার শেষ নেই। আরো উন্নত প্রযুক্তি কি হতে পারে আমার ধারণা নেই। শুধু জানি সেটা বিজ্ঞানীদের কাজ, ওরা ঠিকই খুঁজে খুঁজে নয়া প্রযুক্তি আবিষ্কার করে আরো অলস বানাবার ফন্দী করে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমরা কেবল পকেটে কাড়ি নিয়ে তৈরী থাকবো নতুনের স্বাদ নেবার জন্য।
কিন্তু আরো উন্নত প্রযুক্তির স্পর্শে ভবিষ্যতে আমার অলসতা কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে ভাবা যায়? চরম আলস্যে যদি আমাদের ভূতলে পতন ঘটে আমরা শুয়ে শুয়ে কি সেই বেদবাক্যটি আউড়ে যাবো - "কতো রবি জ্বলে, কেবা আঁখি মেলে?"
No comments:
Post a Comment