Monday, October 30, 2017

অনর্থের অর্থ

সামর্থ্য থাকলে বিপদগ্রস্থ বন্ধুবান্ধবকে সাহায্য করা হলো সাধারণ মানবিক একটি চরিত্র। আজকাল এই মানবিকতাটা উঠে যাচ্ছে। বিপদগ্রস্থ বন্ধুবান্ধব দেখলে ভয় পায় স্বচ্ছল বন্ধুরা। যদি ফেরত দিতে না পারে সেই ভয়ে অনেকে বিপদগ্রস্থ বন্ধুর সাক্ষাতে প্রথমেই জানিয়ে দেয় কিরকম অসুবিধার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে সে। এমনকি ঘনিষ্টতম বন্ধুও তাই করে।

আজকেই তেমন একটি ঘটনা দেখলাম। কনক এসে নয়নকে জানালো তার দেড় লাখ টাকা দরকার দুই মাসের জন্য। ব্যবসাটা শুরু করতে পারছে না এই সামান্য টাকার জন্য। কোন উপায় না দেখে নয়নের কাছে ধার চাইতে হচ্ছে। নয়ন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুর একজন। 

নয়নের ব্যাংকে যে টাকা জমা আছে তাতে দেড় লাখ টাকা দেবার পরও আরো লাখ খানেক থাকবে। ওই দেড় লাখ না থাকলে দুই মাসের মধ্যে না খেয়ে মরবে না সে। তবু কনকের ধারের কথা শুনে সতর্ক অবস্থানে চলে গেল। জানালো সে ইতিমধ্যে একটা বিপদে পড়ে গেছে। আরেক বন্ধুকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিল ব্যাংক ঋণ নিয়ে, সে টাকা এখনো ফেরত আসেনি। নইলে কনককে ঠিকই দিত টাকাটা। নয়নের কথাটা আংশিক সত্য। সে এক বন্ধুকে দু লাখ টাকা দিয়েছিল ছমাসের জন্য, সে টাকা হাওয়া হয়ে গেছে, সাথে বন্ধুটিও। সেই থেকে নয়ন কাউকে টাকা ধার দিতে ভয় পায়। টাকা থাকলেও দেয় না।

কিন্তু এ হলো কনক। তার জানের বন্ধু। যে বন্ধু তার যে কোন বিপদে সহায়। যে কোন সমস্যার কথা প্রথমে যাকে খুলে বলে সে হলো কনক। তাছাড়া বর্তমানে নয়নের ব্যাংকে আড়াই লাখের বেশী আছে। অলস পড়ে আছে। নয়ন চাইলে সেখান থেকে অনায়াসে কনককে দেড় লাখ টাকা ধার দিতে পারে। তবু দিল না। বরং নিজেও কঠিন অভাবে আছে জানিয়ে কনকের কাছে অপারগতা প্রকাশ করলো।

কনক ফিরে যাবার পর নয়নের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিল। কাজটা ঠিক হলো না। নয়ন ব্যবসা শুরু করতে না পারলে পরিবার নিয়ে বিপদে পড়ে যেতে পারে। নয়ন আমাকে ফোন করে ঘটনাটা বললো। দুজনেই আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। কে বেশী ঘনিষ্ট ভাবিনি কখনো। তবে দুজনেই কিছু গোপন কথা আমার কাছে জমা রাখে। নয়নের অপারগতা আমাকে ব্যথিত করলেও এই সরল স্বীকারোক্তি আমাকে মুগ্ধ করলো। কনক আমারো বন্ধু। তবু আমার কাছে না এসে নয়নের কাছে চেয়েছে কেননা কনক জানে আমার হাতে অত টাকা থাকে না। আমার সাথে ওর লেনদেন দশ হাজার টাকার ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে।

নয়নের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে আমি ফোনটা হাতে নিলাম কনকের সাথে কথা বলার জন্য। গত মাসে আমার হাতে ষাট হাজার টাকা এসেছে। সেই টাকা বাসায় অলস পড়ে আছে। ভাবছি ওখান থেকে পঞ্চাশ হাজার ওকে দেবো কিনা। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়েই একটা স্বার্থপর চিন্তা মাথায় এসে ধাক্কা দিল। ডিসেম্বরের শুরুতে আমার বড় একটা খরচ আছে, বাচ্চাদের স্কুল ভর্তি। সেই সময়ে যদি কনক টাকাটা ফেরত দিতে না পারে? আমি ফোনটা রেখে দিলাম। মনে মনে শান্ত্বনা দিলাম নিজেকে, কনক আমার কাছে তো চায়নি। আমি আগ বাড়িয়ে দেবো কেন?

ভাবছি, আমি ও নয়ন দুজনের মধ্যে কে বেশী খারাপ বন্ধু? বন্ধুতার সংজ্ঞা নিরূপিত হয় স্বার্থত্যাগের মাত্রার উপর। আমরা কে বেশী মাত্রার স্বার্থপর? নয়ন কনককে বিশ্বাস করতে পারছে না, আর আমি বন্ধুর স্বার্থকে পরিবারের স্বার্থের উপরে বসাতে পারছি না।

অর্থ অনর্থের মূল কিনা জানি না, কিন্তু অর্থ জিনিসটা মানুষের অভাব দূর করার কাজে যতটা লাগে, মানুষের চরিত্র এবং আন্তরিকতা মাপার জন্য তারো চেয়ে বেশী লাগে।

No comments: