বই পড়ার আনন্দ আর সিনেমা দেখার আনন্দ - দুটো আলাদা বিষয়। এর মাঝে কোনটি বেশী আনন্দের সেটা ব্যক্তিভেদে নিশ্চয়ই আলাদা হবে। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত যে একই গল্প বইয়ে পড়া এবং সিনেমায় দেখার মধ্যে তুলনা করতে গেলে বইই জিতবে। শব্দের শিল্পিত উপস্থাপনা চলচ্চিত্রে হুবহু আনা অসম্ভব। সিনেমার যে সীমবদ্ধতা আছে সেটা মেনে নিতেই হবে। কোন উপন্যাসকে যখন চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করা হয় তখন সেই চলচ্চিত্র উপন্যাসকে ছুঁতে পেরেছে তেমন নজির খুব কম। পঠিত কোন উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ নির্মিত হলে সেটা সযত্নে এড়িয়ে থাকি স্বপ্নভঙ্গের আশায়। খুব প্রিয় বই হলে আরো বিপদ। সেই বই পড়তে গিয়ে পাঠকমনে যে চিত্র দাঁড়িয়েছিল, সিনেমার নতুন চিত্র দেখে পুরোনো চিত্রটি আহত তো হয়ই, কখনো কখনো কালিমালিপ্ত হয়ে যায়। সমরেশের 'কালবেলা' অবলম্বনে তৈরি সিনেমার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল।
একটা সময় পঠিত উপন্যাসের চলচ্চিত্র দেখার খুব আগ্রহ ছিল। খুঁজে খুঁজে বের করতাম। কিন্তু কয়েকটা দেখার পর এমন স্বপ্নভঙ্গ হলো এখন আর ওপথ মাড়াই না। এখানে একটা বিষয় স্বীকার করে নিতে হয় যে পৃথিবীর অনেক উপন্যাসনির্ভর বিখ্যাত চলচ্চিত্র দেখা হয়নি আমার, সব বিখ্যাত বই পড়াও হয়নি, সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু যতটা দেখা হয়েছে তার ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে সিনেমা কখনো বইকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।একটা প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এখন। তা হলো বইয়ের সাথে সিনেমার তুলনা আদৌ প্রাসঙ্গিক কিনা। সবসময় নয়। যখন বইটি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয় তখন এই প্রশ্নটি আসতে পারে। আমরা যখন কোন বই পড়ি তখন মাথার ভেতরে, স্মৃতির কোষে কোষে সেই শব্দের একটি রূপকল্প জমা হতে থাকে। একই বই একেক জনের মস্তিষ্কে একেক রকমের রূপকল্প জমা করে। যখন একটা ঘটনার বর্ননা পড়ি তখন সেই ঘটনার একটা চলমান রূপ আমাদের স্মৃতিতে বসে যায়। বইটি যখন আবার পড়ি তখন ওই রূপকল্পটি ভেসে ওঠে। যতবার পড়ি ততবার সেই একই চিত্র। অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে তাই দেখেছি। কিছু কালো কালো অক্ষর আমার ভেতরে যে রঙিন চিত্র ধারণ করে রেখে দিয়েছে, সেটা কখনোই আরেকজনের সাথে মিলবে না। যার যার চিত্র তার ভেতরে জমা আছে। যিনি সিনেমা তৈরী করছেন তাঁর মাথায়ও নিশ্চয়ই সেরকম একটা চিত্র বাঁধানো আছে। সেটাকে ভিত্তি করেই তিনি গল্পটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন। সুতরাং যে মানের সিনেমাই তিনি বানান, আমার সাথে কখনোই মিলবে না। যতটা অমিল, যত বেশী দূরত্ব, তত বেশী হতাশ হই আমরা সিনেমাটি দেখে। সুতরাং প্রিয় কোন উপন্যাস অবলম্বনে তৈরী হওয়া সিনেমা না দেখাই শ্রেয়।
বইয়ের সাথে সিনেমার তুলনা হয় না। অক্ষরের সাথে দৃশ্যের প্রতিযোগিতা হয় না। একটা বই তার প্রতিটি অক্ষরের ছায়ায় যে আনন্দ লুকিয়ে রাখতে পারে সেটা আর কিছুতে সম্ভব নয়। একেকটি বাক্যে যে কটি শব্দ আছে, সেই শব্দে যে কটি অক্ষর আছে, তার সুবিন্যস্ত উপস্থাপনা আমাদের মগজের কোষে কোষে ছড়িয়ে দেয় অপার্থিব কিছু অনুভূতি যা পাঠ-প্রতিক্রিয়া জাতীয় লেখা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সে আনন্দ একেবারে নিজস্ব। সে ভূবনে অন্য কিছুর যাতায়াত নেই। বইয়ের সাথে এই বন্ধুতা যে অনুভব করে না, তার বই পড়া অর্থহীন।
সিনেমার আনন্দ আসলে অন্যত্র। কোন একটা দৃশ্য যা আমাদের স্মৃতিতে জমা থাকে, যা আমার একার সম্পদ, তাকে চোখের সামনে উপস্থাপন করা গেলে আর সবার সাথে বসে উপভোগ করা সম্ভব। যে গল্পটি আমরা বই পড়ে আলাদা আলাদা চিত্রকল্প সংরক্ষণ করতাম মাথার ভেতর, তাকে যদি চলচ্চিত্ররূপে দেখি তাহলে আমাদের সবার স্মৃতিকোষে একই রকম চেহারায় জমা থাকবে। এটা ভালো কিংবা মন্দ সে বিচার প্রত্যেকের কাছে আলাদা।
No comments:
Post a Comment