Sunday, November 12, 2017

ভাবনার চিরকুট : বিখ্যাত লেখকের অখাদ্য পুস্তক

আমি পাঠক। বই আমার পাঠতৃষ্ণা মেটায়। কিন্তু সব বই নয়। কিছু বই তুমুল আনন্দের সাথে পড়ি। আবার কিছু বই পড়ে মনে হয় সময় নষ্ট করলাম। সেই নষ্ট সময়ের জন্য আমি কিছুটা দায়ী, কিছুটা দায়ী লেখক। আমি দায়, আমি নিজেই বইটা কিনেছি। আর কেন লেখক দায়ী সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।

জীবনের প্রথমভাগে কিছু না জেনে কেবল পাঠতৃষ্ণার জন্য পাইকারী হারে বই কিনতাম। শিল্প রুচির ধার ধারতাম না। তরুণ বয়সে অনেক কিছুই হজম হয়ে যায়। পরিণত বয়সে সব হজম হয় না। তখন বই কিনতে সতর্ক হতে হয়। নষ্ট করার মতো যথেষ্ট সময় তখন হাতে থাকে না।

পরিচিতি বিখ্যাত লেখকদের বই আমরা চোখ বন্ধ করে কিনি। অপরিচিত বা নতুন লেখকের বই কিনি না। সে বই ভালো হলেও। ভালো কিনা জানতে হলে বইটা কিনে পড়তে হয়। আমরা সেটা করি না। করি না বলে নতুন লেখকদের উঠে আসতে খুব কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়। নতুন লেখকের ভালো বইটি যেখানে বাজার পায় না সেখানে বিখ্যাত লেখকের অখাদ্য বইও বহুগুন বেশী বিক্রি হয়।

বিখ্যাত লেখকদের সবাই চেনেন। তাঁরা যা লেখেন তাইই প্রকাশিত হয়। পড়ে সময় নষ্ট হয় তেমন বইও হু হু করে বিক্রি হয়ে যায় বলে জেনে শুনেই অখাদ্য লেখা লিখতে থাকেন। সাইনবোর্ডের কারণেই সব বিক্রি হয়ে যায়। বইয়ের দোকানগুলোর একটা বড় অংশ বিখ্যাত লেখকের অখাদ্য বইতে ভরে থাকে। অথচ সেই বইগুলো না লিখলে জগতের ক্ষতি তো হতোই না বরং অন্য কিছু লেখকের উপকার হতো।

বিখ্যাত লেখকরা অবসর নেন না। লেখার ধার মরে গেছে, সৃষ্টিশীলতার সময় শেষ হয়ে গেছে বলে কোন লেখক লেখা থামিয়ে দিয়েছেন, তেমন লেখক দেখিনি। বইমেলা আসলেই দেখা যায় একই লেখকের ডজন ডজন বই বের হয়ে বাজার সয়লাব। ফলে বইমেলায় রুচি বৈচিত্রের অভাব দেখা যায়। পরিণত পাঠক কাংখিত বই খুঁজে পায় না, নতুন বইয়ের প্রতি আগ্রহ জাগে না। তবু সংখ্যার বিচারে নব্য পাঠকের পাল্লা ভারী থাকে বলে বিখ্যাত লেখকের শিল্পমানহীন নিন্মরুচির বইও শীর্ষ কাতারে ভাসতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে গেছেন। কিন্তু সবাই রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন না। চাইলেই

এই প্রসঙ্গে একজন লেখক আত্মসমালোচনা করে লিখেছিলেন - 'আমরা লেখক। অন্য গ্রহ থেকে এসে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছি। নিত্য প্রসবিনী। নিত্য প্রকাশমান। অশক্ত হওয়া অবধি লিখে যাব.........বাবুর প্রথম গল্প ১৯৪৬ সালে সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৫৬ সালে তিনি যুগের প্রথম মশালচি হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকেই তিনি একটি নাম। এবং এই নাম হবার পর থেকে তিনি অহম্, যা-লিখি-তাই-ই-লেখার মনোভাবে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে যান। তখন তিনি আর শিল্প নন। তিনি পত্রিকার অলংকার।' [মহাকাল মেলের প্যাসেঞ্জার- শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়]

অলংকার শব্দটি এখানে গুরুত্ববাহী। পত্রিকার 'অলংকার' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর থেকেই তাঁর রচনাবলী আক্ষরিক অর্থেই পাঠকের সময় নষ্টের হাতিয়ার হয়ে যায়। অর্থ ছাড়া অন্য কোন তাগিদ না থাকলেও তিনি লিখতেই থাকেন। নেহায়েত অর্থের জন্য উৎপাদিত পুস্তকসমূহ পাঠকের বিপুল সময়ের অপচয় ঘটায়। পাঠক হিসেবে এই বিষয়ে আমি বিরক্ত বোধ করি। বিখ্যাত হলেই বছর বছর অখাদ্য রচনা লিখে বাজার সয়লাব করে ফেলতে হবে? বই তখন পণ্য, কাগজ তখন সের দরে বিক্রিযোগ্য।

প্রিয় লেখক, আপনি ততক্ষণই লিখুন, যতক্ষণ আপনার ভেতর সৃষ্টিশীলতা কার্যকর থাকে। নইলে নীরব অলংকার হয়েই আপনি সৌন্দর্য বিতরণ করুন। পেটের দায় না থাকলে লিখে পাঠকের সময় নষ্ট না করাই ভালো।

[পুনশ্চঃ সেইসব লেখকের নাম উল্লেখ করে বিব্রত করলাম না। আমাদের সবারই পছন্দ অপছন্দের বই আছে নিজেদের বুকশেলফে। সেখানেই তাঁদের নাম মিলবে]

No comments: