মাহতাবউদ্দিনেরা কখনো পত্রিকার শিরোনাম হতে পারে না। গলি ঘুপচির আড়ালে নিঃশব্দে থেমে যায় তাদের অনুল্লেখ্য জীবন। তাদের নিয়ে লেখা এবং পড়া দুটোই সময়ের নিদারুণ অপচয়।
*** **** ***** *** *** **** ***** ***
অবসর গ্রহনের পর জীবনটা আগের মতো থাকবে না জানতেন মাহতাবউদ্দিন। বেসরকারী চাকরী থেকে অবসর নিলে পেনশন থাকে না। সঞ্চয় আর প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের টাকাটাই একমাত্র সম্বল। কিন্তু এ দিয়ে বাকী আয়ুষ্কাল পাড়ি দেয়া অসম্ভব। অবসরের আগে মনে মনে ঠিক করেছিলেন পৈত্রিক সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে সেই টাকা ব্যাংকে রেখে নিজের পেনশনের ব্যবস্থা করবেন, দুই কন্যার বিয়ের খরচ মেটাবেন।
মাহতাবউদ্দিন সার্বিক অর্থেই নিরীহ মানুষ। তিনি জগতের অনেক হিসেবই মেলাতে পারেন না। চাকরিকালীন সময়ে তিনি ভেবে পেতেন না একই বেতনে চাকরী করে তাঁর কয়েকজন সহকর্মী কিভাবে প্লট/ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে। চল্লিশ হাজারে সংসার খরচ সামলাতেই হিমশিম। পৈত্রিক বাড়িটা না থাকলে কী যে হতো। তিনি যেটুকু সঞ্চয় করেছেন সেটুকু মাসিক ডিপিএস থেকেই এসেছে। নিজের টুকটাক খরচ বাঁচিয়ে মাসে দুহাজার টাকার একটা ডিপিএস চালাতেন। অবসর গ্রহনের পর ওটা থেকে ৫ লাখ টাকার মতো পেয়েছেন। সাথে প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের ৯ লাখ। সব মিলিয়ে চৌদ্দ লাখ টাকার মোটা একটা অংক। কিন্তু সংসার খরচ এখান থেকে দিতে হলে এই অংকটার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩৫ মাস। মাসে ৪০ হাজার খরচ করলে এই টাকায় তিনি তিন বছর চলতে পারবেন। ৬৩ বছর বয়সে গিয়ে কী করবেন? এখন কী নতুন করে চাকরী করার সুযোগ আছে? শরীরে নানান অসুখ বাসা বেঁধেছে ইতিমধ্যে। স্ত্রীও খুব বেশী সুস্থ নয়। দুই মেয়ের পড়া শেষ হতে আরো দু বছর বাকী। তাদের বিয়ের খরচ কোথা থেকে আসবে। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসতো না অবসরের কয়েক মাস আগ থেকে। তখনই পৈত্রিক সম্পত্তির কথা মনে হয়েছিল। তিনি নিজের আয়ে এক টুকরো জমিও কোথাও কিনতে পারেননি। কপালগুনে পৈত্রিক সম্পদটা পেয়েছিলেন বলে এখনো শহরে বাস করতে পারছেন। বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট জমিটি বিক্রি করে পেলেন ২৬ লাখ টাকা।
কিন্তু মাসের কিস্তি তুলতে গিয়ে দেখা গেল ৩৩ হাজার থেকে আরো ৫ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে আয়কর বাবদ। তাঁর মতো আয়হীন মানুষকেও মাসে মাসে ৫০০০ টাকা আয়কর দিতে হবে? এই দিকটা তো আগে ভাবা হয়নি।
বাসায় ফিরে স্ত্রীর হাতে মাসিক কিস্তির ২৮০০০ টাকা তুলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি। মাথা ঘুরাচ্ছে তাঁর। ভাবতে থাকলেন এই মাস থেকে কোন কোন খাতের খরচ কমাতে হবে। কিভাবে কমাবেন? দেশে সব খাতের খরচ বেড়েছে। বুকের ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা। কাউকে বোঝানো অসম্ভব।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়িটা ভাড়া দিয়ে সস্তা কোন একটা বাসায় চলে যাবেন। ২০ হাজার টাকায় বাড়িটা ভাড়া দিয়ে তিনি ১০ হাজার টাকার ছোট বাসায় গিয়ে উঠলেন। মাসে দশ হাজার টাকা বাড়তি আয় হওয়াতে তিনি ৩৮ হাজারে সংসারটা আগের মতো চালাতে পারবেন।
কয়েকদিন পর সপরিবারে ঢাকায় যাবার দরকার একটা বিয়েতে। মেয়েকে বললেন অনলাইনে টিকেট কাটতে। তাঁর চাকরীকালীন সময়ের একটা ডেবিট কার্ড আছে ওটায় এখনো কিছু টাকা অবশিষ্ট আছে। চারজনের টিকেট কেটে প্রিন্ট নিয়ে আসার পর দেখলেন ট্রেনের ভাড়া ১৮৯০ + ভ্যাট ২৮৫ টাকা + অনলাইন সেবা ৪০ টাকা = ২২১৫ টাকা। তিনি ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন পথের চা-নাস্তার খরচটা সরকার নিয়ে নিল?হিসেবের কাগজটা হাতে নিয়ে মাহতাবউদ্দিনের মাথা চক্কর দিল। এত টাকা বেড়ে গেল এক লাফে? তিনি ব্যাপারটা নিয়ে একটু যুক্তি তর্ক দিতে চাইলে ধমক খেলেন ক্লার্কের কাছে- বেশী কথা বলবেন না, এটা সরকারের আইন। বাড়ি থেকে টাকাপয়সা নিয়ে আসেন।
মিউনিসিপ্যাল অফিস থেকে বের হয়ে মাহতাব সাহেব একটু হেঁটে নিরিবিলি একটা ফুটপাতের চায়ের দোকানে বসে পড়লেন। তারপর হিসেব করতে লাগলেন কিভাবে তাঁর সীমিত আয় একের পর এক আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হতে শুরু হতে শুরু করেছে।
তিনি কারো সাহায্য নিয়ে জীবন চালান না। না সরকার, না মানুষ। তিনি বরাবর নিজের আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখনো তাই আছেন। তাঁর সীমিত আয়ের উপর এই আঘাত কেন? ৪০ লাখ টাকার সম্পদ থেকেও তিনি তা দিয়ে সংসার চালাতে পারছেন না কেন? মনে হচ্ছে চাকরী থেকে অবসর নেবার পর তাঁর উপর অভিশাপ নেমে এসেছে। কর অভিশাপ। তাঁর মতো বেকার মানুষকে বছরে আয়কর দিতে হবে ৬০,০০০ টাকা!! তিনি বার্ষিক ঈদে পরিবারের জন্য ১০ হাজার টাকা বাজেট করতে হিমশিম খান, বেঁচে থাকার জন্য নিজের ঘরের আয় সাশ্রয় করতে চেয়েছেন। তবু তাঁকে গৃহকর দিতে হবে ৩৪০০০ টাকা!!
যদি ভ্যাট ইত্যাদি হিসেব করা হয় বছরে এক লাখ টাকা তিনি সরকারকে দিয়ে দিচ্ছেন। যিনি বাজারে গিয়ে সবচেয়ে সস্তা মাছটা বেছে কিনেন, তাজা বাদ দিয়ে পচা মাছ কিনে সংসার চালান, তার উপরে লাখ টাকার এই করের বোঝা একটা অভিশাপ ছাড়া আর কী? তিনি কার কাছে বিচার দেবেন?
প্রিয় ঈশ্বর,
তুমি আমাকে চেনো কিংবা চেনো না। এই চিঠি তোমার কাছে কখনো পৌঁছাবে না। তোমার কাছে লিখেও আমার কোন লাভ নেই। তবু আমি নিতান্ত অসহায় হয়ে কিছু কথা বলতে চাইছি যেটা বলে ফেললে আমি হয়তো চাপমুক্ত হতে পারবো।
আমি একজন বেসরকারী কর্মজীবি ছিলাম। ৩৫ বছরের কর্মজীবন শেষ করার পর ৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহনের পর আমার আয়ু কতদিন আছে আমি জানি না। কিন্তু অবসর গ্রহনের পর আমার ৪ সদস্যের পরিবার নিয়ে আমি চট্টগ্রাম শহরে বেঁচে থাকার জন্য কিছু উপায় করেছিলাম নিজের সামর্থ্য অনুসারে। সেই উপায়টি কপালদোষে হুমকির মুখে পড়ে গেছে। অনেকের জন্য এগুলো হয়তো তেমন গুরুতর নয়। কিন্তু আমার কাছে এই হুমকি জীবন মরনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমি যতদিন কর্মজীবনে ছিলাম কখনো কোন অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়াইনি। সীমিত আয়ে সংসার টেনে নিয়ে গেছি। অবসর গ্রহনের পর আয়েশ করার বাসনা করিনি কেননা তখনো আমার কাজ বাকী আছে। আমার দুটি বিবাহযোগ্য কন্যা আছে যারা আর দুতিন বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করবে। আমার আত্মীয় পরিজনের কেউ কেউ অভিযোগ করে এত বয়স পর্যন্ত কেন কন্যাদের বিবাহ দেইনি। কিন্তু আমি চাই আমার কন্যারা শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে নিজের দায়িত্বে নিজের পছন্দে বিয়ে করবে। কন্যারাও তাতেই খুশী।
কিন্তু অবসর গ্রহনের পরপর আমি আমার আয় নিয়ে এক মহাসংকটে পড়েছি। আমি আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ। বাকী জীবন নিজের সঞ্চয় ও সম্পদের উপর কাটিয়ে দিতে পারবো বলে ভাবলেও বর্তমানে সেটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। সেই আঘাত এসেছে আমি যে দেশে বাস করি সেই দেশের আইনের কাছ থেকে। আমি চিরকাল জেনে এসেছি আইন দুর্বলকে রক্ষা করার জন্য তৈরী। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই আইনই আমার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি একজন কর্মহীন, আয়হীন অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, যাকে বয়সের চাপে অসুস্থতা যে কোন সময় কাবু করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে। তবু আমার উপর চাপানো হয়েছে মোটা অংকের বাধ্যতামূলক কর। আমি টিপে টিপে বেছে বেছে পচা মাছ কিনে বাড়ি ফিরি বেঁচে থাকার আশায়। কিন্তু লাখ টাকার করের বোঝা এসে আমার বুকে চেপে বলে - এদেশের আইন আমি, আমাকে তোমার সেবা করতে হবে সবার আগে।
আমি কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো? এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার কোন উপায় থাকলে তাও চলে যেতাম। আমি এদেশের একজন অযোগ্য নাগরিক।
হে মাতৃভূমি, এ কিম্ভুত আইনের দেশে জন্মই আমার অভিশাপ।
ইতি,
অভাগা মাহতাব উদ্দিন
চিঠি লিখে একটা খামে ভরে ড্রয়ারে রেখে দিলেন তিনি। কয়েকদিন শয্যাশায়ী থাকার পর সুস্থ বোধ করলে এক বিকেলে বাজারে গেলেন। চাল ডাল কিনে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার গর্তে পড়ে রিকশা উল্টে গেলে তিনি রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলেন।
কয়েকদিন পর তাঁর চিঠিটা ড্রয়ার থেকে বের করে পড়ার পর কয়েকজন প্রতিবেশী নিন্মোক্ত মন্তব্যগুলো করেছিলেন-
১) মাহতাব সাহেব ভাগ্যবান মানুষ। তিনি করের চাপে মারা যাননি। গাড়ির চাপে মারা গেছেন।
২) দেশপ্রেমিক গর্তে রিকশা উল্টে গেলে সরকার বা মিউনিসিপ্যালিটির কোন দোষ দেয়া যায় না।
৩) মাহতাব সাহেব বেঁচে গেলেন। মৃত্যুর উপর এখনো কর ধার্য করা হয়নি।
No comments:
Post a Comment