Tuesday, April 18, 2017

সিপাহী বিদ্রোহ : চট্টগ্রামের ইংরেজ ক্যাপ্টেনের বিদ্রোহ বিবরনী ২৪ নভেম্বর ১৮৫৮

একজন মঙ্গলপাণ্ডে যখন ২৯শে মার্চ ১৮৫৭ তারিখে বিদ্রোহ করেছিলেন ইংরেজের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন একা। ছোট্ট একটি ঘটনায় তিনি প্রতিবাদী হয়ে প্রমান করেছিলেন হাজার মাইলের দাবানল ছোট্ট একটি আগুনের ফুলকি থেকেই শুরু হয়। তাঁকে প্রাণ দিতে হয় এক সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু সেই ফুলকি কোলকাতা ছাড়িয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল কয়েক মাসের মধ্যেই। সেই বিদ্রোহ ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে পারেনি ঠিক, কিন্তু একশো বছরের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসন থেকে ভারতকে সরাসরি ইংরেজ সরকারের শাসনে রূপান্তরিত করেছিল। এটাও একটা অর্জন। কোম্পানী শাসন ছিল বস্তুতপক্ষে দুবৃত্ত শাসন। ভারতবর্ষের মতো বিশাল একটি অঞ্চলের জন্য চরম অপমান। ভাড়াটে গুণ্ডাপাণ্ডা সৈন্য দিয়ে এত বিশাল একটা দেশকে দখল করে শাসন করায় ঔপনিবেশিক শক্তির চেয়েও বেশী কারণ ছিল আমাদের নিজস্ব বিভেদ এবং দুর্বলতা। অনেক রাজা মহারাজা যুদ্ধ বিগ্রহ করে যা পারেনি, এক মঙ্গল পাণ্ডে তা করতে পেরেছিল। তাই সিপাহী বিদ্রোহকে প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধও বলা হয়।

মঙ্গলপাণ্ডের সেই বিদ্রোহ এ আত্মদানের প্রভাব প্রায় আট মাস পরে পূর্ববঙ্গের বন্দর শহর চট্টগ্রামেও এক ঝলক দেখা গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে পূর্ববাংলা সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব থেকে মুক্তই ছিল। চট্টগ্রামের ওই্ একটি ঘটনা ছাড়া আর কোথাও কিছু ঘটেনি। ঢাকার লালবাগে একটু বিদ্রোহপ্রচেষ্টা গোড়াতেই থামিয়ে দেয়া হয়েছিল।

চট্টগ্রামের ঘটনার নায়ক ছিলেন হাবিলদার রজব আলী খান। নাম ছাড়া তাঁর আর কোন পরিচয় পাওয়া যায় না।

তিনি ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর বৃটিশের বিরুদ্ধে তার অন্যান্য সহযোদ্ধাসহ বিদ্রোহ করেন। তিনি বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরিরত ছিলেন। তার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। ৩৪নং রেজিমেন্ট। কর্মস্থল ছিল প্যারেডগ্রাউন্ড। যা বর্তমানে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের খেলার মাঠ। ৩৪নং রেজিমেন্ট ছিল বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে সৃষ্ট রেজিমেন্ট। উক্ত রেজিমেন্ট ইংরেজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল।

জেলগেটের সশস্ত্র পাহারাদারদের পরাজিত করে হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলে আটক সকল বন্দীদের মুক্তি দিয়ে ছুটলেন চট্টগ্রাম ট্রেজারির দিকে। ট্রেজারিতে কর্তব্যরত বৃটিশ অফিসারকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা ট্রেজারি দখল করে প্রচুর টাকাকড়ি লুট করে নেয়। তারপর রজব আলীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ইংরেজদের চট্টগ্রামস্থ অস্ত্রাগার লুট করলেন। তিনটি হাতী ও অন্যন্য অস্ত্র সহকারে হাবিলদার রজব আলীর বিদ্রোহী সিপাহীরা ত্রিপুরা রাজার সাহায্য পাবার আশায় তার রাজ্য সীমানায় পৌঁছে গেলেন। এই ঘটনাগুলো দ্রুত গতিতে ঘটেছিল এবং হতাহতের সংখ্যা ইংরেজদের পক্ষে মাত্র একজন। বিদ্রোহীদের কেউ হতাহত হয়নি।

ত্রিপুরার দিকে এগিয়ে গেলেও রাজার সহায়তা না পেয়ে  হাবিলদার রজব আলীরা আর ত্রিপুরা না গিয়ে মনিপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মনিপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে অাঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে অবশেষে সিপাহীরা সিলেট এসে পৌঁছলেন। তারা তখন ক্লান্ত। অনেক দুর্গম পথ হেঁটে তারা সিলেটে পৌঁছেন।

ইংরেজরা খবর পেয়ে সেখানে আক্রমণ করতে আসে। খবর পেয়ে হাবিলদার রজব আলী এক পরিকল্পনা করলেন। সৈনিকরা তৈরি করলেন অনেকগুলো খড়ের মূর্তি। পাহাড়ের ঢালুতে তাঁবু গাড়লেন রজব আলী। সন্ধ্যার সাথে সাথে সেই মূর্তিগুলোকে সিপাহীদের পোশাক পরিয়ে তাঁবুর চারপাশে সুন্দরভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। রজব আলী সিপাহীদের নিয়ে পাহাড়ের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে রইলেন। এদিকে মেজর বাইঙ-এর নেতৃত্বে বৃটিশ সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে মুর্তিগুলোর উপর আক্রমণ করে বসল। এ সুযোগে হাবিলদার রজব আলী মেজর বাইঙকে হত্যা করেন। উক্ত যুদ্ধে অনেক বৃটিশ সৈন্য নিহত হয়। এরপর হাবিলদার রজব আলী মনিপুরের দিকে রওয়ানা হন।

সিপাহীরা মনিপুর প্রবেশ করলে সেখানেও আক্রান্ত হয়। এই পর্যায়ে এসে সিপাহীদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা চারদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম ত্যাগ করার পর সিপাহীদের রসদের অভাব দেখা দেয়। স্বাভাবিক কারণে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন সংঘর্ষে ২০৬ জন সিপাহী মারা যায়। অবশেষে রজব আলীর দল রেঙ্গুনের পার্বত্যাঞ্চলে চলে যায় এবং ধারণা করা হয় রেঙ্গুনের পার্বত্য জঙ্গলে খাদ্যাভাবে তাদের মৃত্যু হয়।

ঘটনার এইটুকু আগেই জানা ছিল।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক পড়াশোনা করতে গিয়ে সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শী একটি বিবরণের সন্ধান পাওয়া গেল বৃটিশ সরকারের একটি তথ্যভাণ্ডার থেকে। চট্টগ্রাম শহরে সেই সময় Captain P.H.K. Dewool ছিলেন ৩৪ রেজিমেন্টের প্রধান। তিনি বিদ্রোহের ঘটনাটির বিবরণ দিয়ে একটি পত্র লিখেছিলেন মেজর জেনারেল Sir J. Hearsey, K.C.B. এর কাছে যিনি প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের প্রধান ছিলেন।

১৮ নভেম্বর বিদ্রোহের এক সপ্তাহ পর ২৪শে নভেম্বর লিখিত সেই দুর্লভ চিঠির সম্পূর্ণ বিবরণী-

"Chittagong, November 24th, 1857.

 

" I have the honour to report, for the information of Major-general Sir J. Hearsey, K.C.B., commanding the presidency division, that, on the evening of Wednesday, the 18th instant, about nine o'clock, the detachment of the 34th regiment of native infantry mutinied, and instantly occupied the magazine with a strong body of men. Immediately upon hearing the noise from my house, which is quite close to the lines, I went to the parade in company with Lieutenant Hunter; but upon approaching the scene of disturbance, hearing the men very violent and loading their muskets, I directed that officer to retire, and went forward to the mutineers alone. I found a very strong guard in front of the magazine, who challenged me, and shouted out in a most violent tone, ' Don't care for him ! Go away ! you have no business here !'


I advanced up to it, and did my best, with every argument I could use, to persuade the men to their duty; but a Mohammedan, who was in a native dress, and not in uniform like the rest, standing out in front, called out in a loud voice, ' The whole detachment is in a state of mutiny, and we have all determined to die if it is necessary. Go away !' This he said shaking his hand in my face, and using the most violent gestures. A shout was then raised, ' Shoot him ! shoot him !' but a number of voices replied, 'No! no! don't hurt the captain.' Taking encouragement from this, and thinking I might have some men who would stand by me, I again endeavoured, by every persuasion, to bring the men to a sense of their duty, and appealed to several sepoys by name, who had previously borne a good character, to think what they were about, and to remain faithful to their salt; but they all replied that they had joined the mutineers, and that it was not their intention to withdraw. 


A shout was again raised, ' Shoot him ! shoot him !' which was again negatived ;and at the same moment two or three sepoys, with their muskets at the charge, came at me. Not liking this demonstration, I stepped back a few paces, and got out of the crowd, which was gradually getting round me; a Sikh of No. 4 company then came up, and giving me a rough push, said, ' Go away from this [Hum suh log bigger gya).'


Not a single native commissioned or non-commissioned officer, or Sikh, remained by me; and seeing nothing could be done, I went to the quarters of Lieutenant Hunter, close by, and found that officer with Lieutenant Thomson, walking in the verandah ;  I told them hastily what had occurred, upon which they armed themselves and immediately went away. I then went to every house in the cantonment, to give warning to the residents, but most of them had already taken alarm and fled. Ultimately joining the civil surgeon's family, who live at the extreme end of the cantonment, in their company I sought to make my own escape; but by this time the parade and all the road around were covered with mutineers, so that we were only able to reach the next house, where we were detained for about two hours ; we afterwards disguised ourselves as natives, and, under the guidance of the collector's bearers, proceeded by a jungle path to the banks of the river, when with difficulty we got a boat, and dropped  down to the Kortabeea lighthouse, from whence we returned yesterday.

 

"I have to state that the mutineers plundered the treasury most completely, and in doing so killed a burkandaze. They also broke open the gaol, and forced the prisoners to go with them to carry the treasure ; and afterwards returned to the cantonments, and blew up the magazine and burned down the lines. I am happy to say that none of the European residents have been personally injured, and that, with the exception of a horse or two which were taken away to carry their baggage, the mutineers have left all private property untouched. 


" I have been informed by a native named Thakoor Bux, formerly a jemadar of the Chittagong provincial battalion, whom the mutineers forced to go some distance with them, that the pay-havildar of No, 4 company, named Rujub Ali Khan, has assumed command of the detachment, which, we hear, has crossed the Fenny river, and entered the territories of the rajah of Tipperah.

 

" I took the opportunity while at Kootuhdeen, to write to the commissioner of Arracan, reporting the mutiny, and requesting him to send a copy of my letter for the information of the general commanding, which I hope has been done.


— I have

 

P.H.K. Dewool,

Captain,

Commanding 34th Regiment Native Infantry.

 

" P.S. — Lieutenants Hunter and Thomsonare in safety."




১৮৫৮ সালে প্রকাশিত The Mutiny of Indian Army থেকে সংকলিত।



No comments: