Saturday, April 8, 2017

Battle of Chile : আলেন্দে হত্যাকাণ্ডের জীবন্ত দলিল

এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি ঘটেনি। যে মানুষকে হত্যার জন্য জলে-স্থলে-আকাশে কয়েক হাজার সুসজ্জিত বাহিনী ট্যাংক-কামান- যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ ঘিরে রেখেছে সে মানুষ মৃত্যু নিশ্চিত জানা সত্ত্বেও পালিয়ে না গিয়ে হাতে তুলে নিলেন রেডিও স্টেশনের মাইক্রোফোন। জাতির উদ্দেশ্যে জীবনের শেষ বার্তাটি দিতে শুরু করেন-

......Workers of my country, I have faith in Chile and its destiny. Other men will overcome this dark and bitter moment when treason seeks to prevail. Keep in mind that, much sooner than later, the great avenues will again be opened through which will pass free men to construct a better society. Long live Chile! Long live the people! Long live the workers!

তাঁর নাম সালভাদর আলেন্দে। তিনি ১৯৭০ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিলির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

চিলির সান্টিয়াগো শহরের ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালের সকালবেলা। La Moneda নামের প্রাসাদের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে ট্যাংক আর কামানে সুসজ্জিত এক সেনাবাহিনী। অবিরাম গোলাগুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়িটার ভেতরে অবস্থানরত প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করার আহবান করছিল তাঁর নিজের দেশের সেনাবাহিনী। তাদের কাছে আত্মসমর্পন করলে পালিয়ে যাবার পথ করে দেয়া হবে বলা হচ্ছিল, বলা হচ্ছিল তাঁর জন্য তৈরী আছে একটি বিমান। আত্মসমর্পন  না করলে বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার হুমকি। কিন্তু নিজের নীতিতে অটল অসীম আত্মবিশ্বাসী মানুষটি পালিয়ে যাওয়া কিংবা অবৈধ আহবানে সাড়া দেবার চেয়ে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করাকে বেছে নিলেন। ভবনের ভেতরে তাঁকে রক্ষার জন্য অবস্থানকারী সৈন্যদের বললেন নিরাপদ স্থানে সরে যেতে। তাঁর পরিবারের নারী ও শিশুদের সরিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে আকাশ পথে উড়ে এলো সশস্ত্র জঙ্গী বিমান। একের পর এক বোমাবর্ষণে লা মোনেদা প্রাসাদের ছাদ ধ্বসে পড়ছিল।

দেশবাসীর প্রতি দেয়া বক্তব্য শেষ হবার পর তিনি হাতের AK-47 রাইফেলটি হাতে নিয়ে চিবুকে ঠেকিয়ে ট্রিগার চেপে ধরলেন। সেই অসম্ভব দৃঢ়চেতা মানুষটি দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রপ্রধান। চিলির জন্য নতুন যুগের হাওয়া বয়ে আনা একজন স্বপ্নবাজ মানুষ। যিনি মাত্র ৩৪ মাস বৈরী শক্তির মোকাবেলা করে ক্ষমতায় টিকতে পেরেছিলেন। দেশে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বৈশ্বিক মোড়ল আমেরিকার চক্রান্তে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে রক্তাক্ত অভ্যূত্থানে সরিয়ে দেয়া হয়।

রাইফেলটি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ত্রো। যিনি কল্পনাও করেননি প্রিয় কমরেড এই অস্ত্র দিয়েই পৃথিবীকে বিদায় জানাতে বাধ্য হবেন একদিন।

চিলির সেই ভয়াবহ সময়টাকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন চিলির খ্যাতনামা তথ্যচিত্র নির্মাতা Patricio Guzman. ১৯৭৩ সালে আলেন্দে হত্যার আরো আগ থেকে তিনি আর তাঁর পাঁচ সহযোগী চিলির রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র  ক্যামেরায় ধারণ করে যাচ্ছিলেন। তখনো তাঁরা জানতেন না সেই চিত্রায়নগুলো কখনো কাজে আসবে কিনা। সময়কে ধরে রাখা সেই চিত্রগুলো ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থেকে গেছে। আলেন্দে সরকারের পতনের পর গুজম্যান ও তাঁর দলের সবাই পালিয়ে আত্মগোপনে কিংবা নির্বাসনে চলে যান। কিন্তু একজন ধরা পড়ে গেলেন। তিনি Jorge Müller Silva, যিনি গত এক বছরের সব চিত্র  ক্রমাগত ক্যামেরায় ধারণ করে ইতিহাসের জ্বলন্ত প্রমাণ রেখে গেছেন, তাঁকে ১৯৭৪ সালে গ্রেফতার করার পর গুম করে ফেলা হয়, তাঁর লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই চলচ্চিত্রটি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন পরিচালক প্যাট্রিসিও গুজম্যান যিনি নিজেও ২৩ বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করেছিলেন। নির্বাসিত অবস্থাতেই নির্মান করেন সারা বিশ্বে সাড়া জাগানো Battle of Chile।

'ব্যাটল অব চিলি' তিন ভাগে বানানো হয়েছে আলাদা তথ্যচিত্র হিসেবে-
The Insurrection of the Bourgeoisie (1975),
The Coup d'état (1976),
Popular Power (1979)

এর মধ্যে দ্বিতীয় পর্ব The Coup d'état (1976) হত্যাকাণ্ডের মূল চিত্রটি তুলে ধরেছে, বাকী দুটি অভ্যূত্থানের পটভূমি এবং সামগ্রিক পরিস্থিতির চিত্রায়ন।

এই ছবিতে আলেন্দে হত্যার দৃশ্য নেই। কিন্তু ওই প্রাসাদে বোমাবর্ষণের সরাসরি চিত্রায়ন আছে। সম্ভবত নিকটস্থ কোন দালানের ছাদ বা জানালা থেকে চিত্রায়িত হয়েছিল দৃশ্যটা। আলেন্দে আত্মহত্যা করেছিলেন কিনা সেটা নিয়ে অনেক বছর বিতর্ক ছিল ধোঁয়াশা ছিল। আরো অনেক বছর পর ২০১১ সালে তাঁর কন্যা ইসাবেল আলেন্দের অনুরোধে আবারো লাশের ময়না তদন্ত করে নিশ্চিত হওয়া গেছে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর দেহরক্ষীদের সাক্ষাতকারেও একই বিবরণ মেলে।

পুরো চলচ্চিত্রে ক্যামেরার কাজ Jorge Müller Silva-র করা হলেও এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও চিত্র যুক্ত করা হয়েছে।

সেই চিত্রটি ধারণ করেছিলেন Leonardo Henrichsen নামে আর্জেন্টিনার টিভি চ্যানেল-১৩ এর একজন রিপোর্টার। তিনি চিলির ঘটনাবলী কাভার করার জন্য সান্টিয়াগো অবস্থান করছিলেন। ২৯শে জুন ১৯৭৩ তারিখ সকাল নটায় সেনাবাহিনীর ছোট একটা দল একজন লে.কর্নেলের নেতৃত্বে ৬টি ট্যাংক নিয়ে আলেন্দের প্রাসাদে আক্রমন চালিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু তখন সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী যুক্ত হয়নি বলে ব্যর্থ হয়েছিল সেই অভ্যূত্থান। আলেন্দের পক্ষের সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অভ্যূত্থান প্রচেষ্টার সময় ২২ জনকে হত্যা করে সেই বাহিনী, যার মধ্যে ছিল Leonardo Henrichsen। তিনি সেদিন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছাকাছি একটা হোটেলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছিলেন সকাল নটার সময়। হঠাৎ হৈচৈ ছোটাছুটি গোলাগুলির শব্দ পেয়ে তিনি নীচে নেমে এসে দেখেন অদূরে সেনাবাহিনীর কিছু সৈন্য প্রাসাদের সামনে গোলাগুলি শুরু করেছে।

সবাই যখন উর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছিল, তিনি তখন ক্যামেরা নিয়ে ঘটনার চিত্রায়ন শুরু করে দিলেন। সৈন্যরা তাঁকে দেখে ফেলে এবং এক অফিসার তাঁকে লক্ষ্য করে হুংকার দেয় রিভলবার তাক করে। সেই হুংকার এবং তাক করা বন্দুক ক্যামেরার লেন্সে দেখতে পাওয়া যায় এবং ক্যামেরা তাক করা অবস্থাতেই গুলি লাগে। তবু ক্যামেরা থামেনা রেকর্ড চলা অবস্থাতেই তিনি ক্যামেরা হাতে পড়ে যান এবং মৃত্যুবরণ করেন। হত্যাকারী সেই অফিসার ক্যামেরা থেকি ফিল্ম খুলে ছুড়ে ফেলে, কিন্তু সৌভাগ্যবশত ক্যামেরায় আরেকটি ব্যাকাপ ফিল্ম ছিল এবং সেখানে এই চিত্রটি ধারণ করা ছিল। তাঁর এক সহকর্মী আর্জেন্টিনা ফিরে গিয়ে সেই চিত্রটি প্রচার করে টেলিভিশনে। সেই ঐতিহাসিক দুর্লভ চিত্রটি এই সিনেমায় যুক্ত করেছেন গুজম্যান। Leonardo Henrichsen এর স্মরণে ১৯৮৯ সালে আর্জেন্টিনার কংগ্রেস ২৯শে জুনকে National day of the cameraman হিসেবে পালন করার আইন করেছিল।

এই সিনেমা সম্পর্কে টিম অ্যালেন 'ভিলেজ ভয়েস' পত্রিকায় বলেছিলেন- "The major political film of our times - a magnificent achievement."

পলিন কায়েল 'দ্য নিউ ইয়র্কার' পত্রিকায় লিখেছিলেন - " How could a team of five - some with no previous film experience - working with ... one Éclair camera, one Nagra sound recorder, two vehicles..and a package of black-and-white film stock sent to them by the French documentarian Chris Marker produce a work of this magnitude? The answer has to be partly, at least; through Marxist discipline ... The young Chilean director and his associates had a sense of purpose. The twenty hours of footage they shot had to be smuggled out of the country..the cameraman, Jorge Müller Silva, hasn't been heard of since his imprisonment. The others fled separately, assembled in Cuba, and together with a well known Chilean film editor Pedro Chaskel, ... worked on the movie ... Aesthetically, this is a major film, and that gives force even to the patterning of its charges ... It needs to be seen on public television, with those [U.S.] government officials who formed policy toward Allende explaining what interests they believed they were furthering."

সালভাদর আলেন্দে হত্যাকাণ্ডে আমেরিকান সরকার জড়িত ছিল এটা এখন আমেরিকাও স্বীকার করে খোলাখুলিভাবে। কিন্তু কিভাবে সেই অভ্যূত্থানের পরিবেশ তৈরী করা হয়েছিল এবং পরিকল্পনা এগিয়েছে সেটা এক ঝলকে বোঝার জন্য গুজম্যানের এই সিনেমাটা খুব কাজের। যে সরকারকে পছন্দ হয় না তাকে উচ্ছেদের জন্য আমেরিকান পদ্ধতি হলো সরকার বিরোধী একটি আবহাওয়া তৈরী করা, সরকারকে অজনপ্রিয় করার জন্য অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরী করা। পত্রিকার মাধ্যমে প্রপাগাণ্ডা চালানো। সেই সাথে মদদ দিতে হবে সেনাবাহিনীকে। চিলির ক্ষেত্রে জনগণ বাদে সমগ্র দেশের আর সবকিছুকে আলেন্দের বিপরীত মেরুতে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এর পেছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঢেলেছে আমেরিকা। শুধু একটি উদাহরণ দেয়া যায়। সমগ্র চিলির ট্রাক কোম্পানীগুলো সব আমেরিকার। সমগ্র চিলিকে পন্য পরিবহনে ওই ট্রাকের কোন বিকল্প নেই। চিলিকে অচল করার জন্য ট্রাক ট্রলি ধর্মঘটের মত অস্ত্র নেই আর। সেই অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছিল দেশকে অস্থিতিশীল করার সূচনাতেই। সারা চিলিতে খাদ্য সংকট দেখা দেয়, কলকারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ হাহাকার করতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো সারা দুনিয়াতে শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডাকলেও চিলির ওই ধর্মঘট ডেকেছিল মালিকপক্ষ। এবং শ্রমিকদেরকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য নিয়মিত বেতন পরিশোধ করা হতো আমেরিকার দেয়া টাকা দিয়ে।

চিলির প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি তার খনিজ সম্পদ। সেই সম্পদই আলেন্দের জন্য কাল হয়েছিল। সেখানে মার্কিন পুঁজির মূল বিনিয়োগ ছিল সর্বোচ্চ। আলেন্দে ক্ষমতায় আসার পর খনিগুলো জাতীয়করণের ঘোষণা করা হয় শ্রমিকদের স্বার্থে। তাদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয় ২৫% হারে। শ্রমিকরা খুশী হলেও মালিকরা চরম অসন্তুষ্ট। সেই মালিক পক্ষ আমেরিকা দাঁড়াবে সেটাই স্বাভাবিক।

চিলিতে আলেন্দের সরাসরি শত্রু সিনেট, আদালত এবং সেনাবাহিনীর একাংশ। চিলির সিনেটে বিরোধী পক্ষের আসন বেশী হলেও একক দল হিসেবে আলেন্দে সংখ্যাগরিষ্ট।  বিরোধী দলের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ট ছিল না বলে প্রেসিডেন্টকে আইনগতভাবে অপসারণে ব্যর্থ হয়ে অবৈধ পন্থা বেছে নয়।

বলা বাহুল্য প্রতিটি তৃতীয় বিশ্বের অপছন্দের সরকারকে উৎখাত করার এই মার্কিন ষড়যন্ত্র এখনো বহাল আছে সারা বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশে সেই উদাহরণ আমরা খুব নগ্নভাবে দেখেছি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে।