Tuesday, April 4, 2017

The Trial, কাফকা এবং আমাদের বাস্তবতা

কাফকার চোখে আধুনিক মানুষ যেভাবে সভ্যতার কাঠগড়ায় শারিরীক ও মনস্তাত্বিকভাবে নির্যাতিত হবার চিত্র দেখা গেছে, তা শতবর্ষ পরেও প্রাসঙ্গিক তো বটেই, তা বৃদ্ধি পেয়েছে নানান আঙ্গিকের আরো জটিলতর অবস্থান নিয়ে। সভ্যতার আলোর পাশাপাশি সভ্যতার একটি কুৎসিত অন্ধকারও বয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিটি আধুনিক মানুষ। কাফকার উপন্যাস অবলম্বনে Orson Welles নির্মিত ১৯৬২ সালের The Trial সিনেমায় সেই অন্ধকারকে চিত্রায়িত করা হয়েছিল ইউরোপীয়ান বাস্তবতার আলোয়।

বাংলাদেশের আলোতে দ্যা ট্রায়ালকে যদি আরো একটু বিস্তৃত করে দেখার চেষ্টা করা হয় তখন আরো প্রকট বীভৎস রূপ ধরা পড়ে।

আইনকে মানুষ ভয় পায়, সেটা আইনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আইন সাধারণ মানুষকে অভয় দেয় না, ভয় দেখায়। আইনের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি শাখা মানুষের জন্য উৎপাত ছড়িয়ে রেখেছে। বর্তমান ইউরোপ জানি না, কিন্তু কাফকার আমলের ইউরোপের আইন আদালতের চিত্রটি এখন এই উপমহাদেশের বাস্তবতা। আদালত, উকিল, পুলিশ, মোক্তার, দালাল, সর্বশ্রেণীর হাতে মানুষের অধিকার বিপন্ন, কখনো কখনো জীবনটাই।

শুধু আইন আদালত পুলিশী হয়রানী নয়, প্রতিটি সরকারী দফতরেই খাবি খাওয়া মানুষগুলো বৃহত্তর জিম্মি জনগোষ্ঠির অংশ। যেখানে কেউ দেয় প্রাণ, কেউ দেয় মান। অর্থের কথা বলাই বাহুল্য।

সরকারী দফতর বা আইন আদালতের বাইরেও কী নিরাপদ মানুষ? যেখানে মানুষ শান্তি সেবা ও সুস্থতার সন্ধান করে সেখানেও যে বিপুল বিশাল অন্ধকার লুকিয়ে। ভাবতে খারাপ লাগে অসুস্থ হওয়াও একটা অপরাধ এই দেশে। সাধারণ কিংবা দুরারোগ্য যে ব্যধিতেই আক্রান্ত হোক, যদি কেউ ডাক্তার হাসপাতালের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হয় তখন অর্থ, স্বাস্থ্য, এমনকি জীবনও বিপন্ন হয়। চিকিৎসা ব্যবস্থাও আইন আদালতের মতো একটি ত্রিচক্র ফাঁদ।

আইনের আশ্রয় নেয়া মানুষ যেমন পুলিশ, উকিল, আদালত এই তিনটি চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে, অসুস্থ হবার পর সেই মানুষ ডাক্তার, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চক্রে ঘুরতে ঘুরতে নিঃশেষে প্রাণ দিতে পারে। একটা সময় ছিল ডাক্তার, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার তিনটি আলাদা ইউনিট হিসেবে কাজ করতো। সময়ের বিবর্তনে তিনটি ইউনিটকে একটি গ্রন্থিতে আবদ্ধ করেছে।

আপনাকে বেশীদূর যেতে হবে না সেবা পেতে। একই দালানেই সব পাবেন। ঝকঝকে রিসেপশনে প্রবেশ করে প্রথম পর্বে আপনি ডাক্তারের চেম্বারে যাবেন। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে পাঠাবে উপরতলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখান থেকে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে দেখানোর পর ডাক্তার বলবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন। হাসপাতালে ভর্তি হবেন আপনি। তারপর চিকিৎসা চলাকালীন এই ত্রিচক্রযান অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে যতদিন একটা চক্র সম্পন্ন না হচ্ছে। একেকটি সম্পূর্ণ চক্র হলো সুস্থ অথবা মৃত অবস্থায় বাড়ি ফেরা। সেখানেও তিনটি সম্ভাবনা আছে।
১. খুব সৌভাগ্যবান হলে অর্থ ব্যয় শেষে বাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরতে পারে রোগী।
২. ভাগ্যবান না হলে সুস্থ না হয়ে আরো জটিল অবস্থায় পড়ে যেতে পারে।
৩. আর খুব দুর্ভাগা হলে সকল সম্পদ ব্যয় করে পরিবারকে পথে বসিয়ে পরপারে চলে যেতে পারে।

এর বাইরে আরো একটি সম্ভাবনা আছে। ধরে নিলাম হাসপাতাল, ডাক্তার, ডায়াগনস্টিক সেন্টার সবকিছু ঠিক আছে। তার পরেও ওষুধের ভেজালে মারা পড়তে পারেন আপনি কিংবা অঙ্গ হারাতে পারেন। আসলে সস্তায় মৃত্যুবরণ করাও একটা সৌভাগ্য হিসেবে ধরা হয় অনেক ক্ষেত্রে।

চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে কাফকা কিছু লিখেছেন কিনা জানি না। যদি কাফকা এই মুহুর্তে বাংলাদেশে জন্মাতেন তাহলে হয়তো আরেকটি মহাকাব্যিক অমানবিক আখ্যান পড়ার সৌভাগ্য হতো বিশ্ববাসীর।


No comments: