Thursday, July 13, 2017

বেনেফিট অব ডাউট

চোর ডাকাতেরা জানতো না ফাঁকা মাঠের মাঝে এই বাড়িটার দরোজাগুলো কতো নাজুক। ভেতর থেকে কোনমতে বন্ধ করা গেলেও বাইরে তালা দেবার কোন উপায় নাই। এ বাড়ির কেউ কখনো একসাথে কোথাও যায় না। কেউ না কেউ থাকেই।

কিন্তু সেবার হঠাৎ এমন এক দুর্যোগ অতর্কিতে হানা দিলো সবাইকে পালাতে হলো ঘর ছেড়ে। এক রাতের অবিরাম ভারী বর্ষণে সমস্ত শহর যখন ডুবে গেল, তখন এই বাড়িটাও খুব দ্রুত এক বুক পানির নিচে ডুবে যাচ্ছিল দেখে সাত সকালে বাড়ির বাসিন্দারা কোনমতে এক কাপড়ে বেরিয়ে কয়েকশো গজ দূরে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলো। পেছনে দরোজা-খোলা বাড়িতে রয়ে গেল যাবতীয় আসবাবপত্র, টিভি-ফ্রিজ-কম্পিউটার, মধ্যবিত্ত পরিবারের অমূল্য সম্পদ।

ছেড়ে আসা বাড়িটা ছিল আমাদের। সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। অবিরাম বর্ষণ তখনো চলছিল। জল নামার কোন লক্ষণ নেই। থই থই করছে চারপাশ। প্রতিবেশীর দোতলা বাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম বন্যা কবলিত গাছপালা ঘেরা নিঃসঙ্গ বাড়িটার দিকে। গত বিশ বছরে এই প্রথম বাড়িটা একা হলো। বাড়ির ভেতরে একটা জিনিসও অক্ষত থাকবে না। বইগুলোর জন্য বেশী মায়া লাগলো। টিভি আর ফ্রিজটা কোনমতে টেবিলের উঁচুতে তুলে রাখা হয়েছে। সার্টিফিকেটের ব্রিফকেসটা আলমারীর উপরে। 

আলমারী? আলমারীর কথায় মনে পড়ে গেল ওখানে কত কি দামী সব জিনিস রয়ে গেছে। আছে অতিমূল্যবান গয়নার বাক্সগুলো। একদম নীচের তাকে আছে, ভিজে নিশ্চয়ই সুপসুপে হয়ে গেছে। এত বেশী পানি, তালা খুলতে ডুব দিতে হবে। কুচকুচে নর্দমার জলে ডুব দেয়া সম্ভব না। চাইলেও তাই বের করা যাবে না। কিন্তু চোরের কাছে ওসব ঝড় জল কিছুই না। এ কথাটা মনে হতেই বন্যার চেয়ে বড় বিপদের আশংকাটা জাগলো। চোরেরা শাবল দিয়ে আলমারী খোলে। চাবি লাগে না। নিশ্চয়ই চোর আসবে রাতে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই কোথাও। খানিক পরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসবে। এতদিন যেসব চোর চুরি করার সুযোগ না পেয়ে মনে মনে ক্ষুব্ধ ছিল তারা মনের সাধ মিটিয়ে ঘর খালি করে দেবে। যেসব জিনিস অক্ষত আছে এখনো, সেসব চোরের হাতেই নিকেশ হবে।

ফিরে গিয়ে বাড়ি পাহারা দেবো? অন্ধকারে এক বুক পানির ভেতরে দাঁড়িয়ে কী পাহারা দেবো? মালের চেয়ে জানের মায়া বেশী। থাক, জিনিস গেলে যাক। প্রাণ থাকলে কত কিছু কেনা যাবে।

তখনই আবার মনে পড়ে গেলো তাদের দুজনের কথা। আমার সাহস না থাকলেও তাদের উপস্থিতি চোরকে ঠেকিয়ে দিতে পারে না? ভেবে দেখলাম, নিশ্চয়ই পারে। অন্ততঃ একটা সম্ভাবনা আছে।

অন্ধকারে জল ঠেলে তাদেরকে পাহারায় নিয়োজিত করার জন্য ফিরে গেলাম থই থই জলে ডুবন্ত বাড়িটাতে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। দরোজাটা হা করে খোলা। টর্চের আলোয় দেখলাম ঘরের সমস্ত জিনিস ভাসছে। ঘটি বাটি সোফা চেয়ার ওয়ার্ড্রোব জামা কাপড় সব। দেখেও দেখিনি ভাণ করে মনোকষ্ট চেপে ভেতরে ঢুকে একজনকে আলগোছে আলমারীর উপর বসিয়ে দিলাম। অন্যজনকে জলে চুবিয়ে বাইরের বারান্দার দড়িতে ঝুলিয়ে দিলাম। তারপর দরোজা ভেজিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ফিরে এলাম প্রতিবেশীর বাড়িতে। তখনো জানি না কতটা কাজ হবে এই কৌশলে।

পরদিন সকালে জল খানিকটা নেমেছে। ভয়ে ভয়ে আমি জল ডিঙ্গিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখলাম জিনিসপত্র কিছুই খোয়া যায়নি। চোর ডাকাত কেউ আসেনি। বারান্দার দড়িতে ঝোলানো লুঙ্গিটা তখনো শুকোয়নি। ঘরের ভেতর হ্যারিকেনটা তখনো জ্বলছে মিটমিট করে। লুঙ্গি আর হারিকেনের যৌথ পাহারায় টিকে গেছিল অক্ষত মূল্যবান সম্পদগুলো।


No comments: