তোমার চোখে জলের ছায়া নদীর ধারে আমার বাস
মেঘের সাথে তোমার দেখা বর্ষা নামায় সর্বনাশ।
রবিঠাকুর যতই বলুক প্রহর শেষের চৈত্রমাসের কথা, বেশীরভাগ বাঙালীর হৃদয়ে সর্বনাশ ঘটে এই বর্ষার দিনেই। এই বাংলাদেশের বর্ষার কোন তুলনা আছে? থাকলে দুই হাত তোলেন। আমি বুক ফুলিয়ে বলি সারা বিশ্বে বাংলাদেশের বর্ষার রূপই সবচেয়ে অনন্য। এই রূপময়তার যে নদী আমাদের সর্বনাশ করে, সেই নদীই আবার সবচেয়ে সৌন্দর্যের আধারও মেলে ধরে।
দুনিয়ার যেসব দেশে বন্ধুবান্ধব আত্মীয় আছে এবং যেসব দেশে নিজে বর্ষা দেখেছি, সব মিলিয়ে বলতে পারি, উপমহাদেশ বাদে কোথাও উদার সৌন্দর্যের বর্ষা নাই। পশ্চিমা দেশে তো বর্ষা বলে কোনো ঋতু নেই। সামারেই বৃষ্টি বাদল সব সারিয়ে দেয়। তাই বোধহয় বৃষ্টি পড়ে ভীষণ রকমের দীনতা নিয়ে। একটুও ভালো লাগার না। আমার লাগেনি অন্ততঃ। ওসব দেখে বরং দেশের উদার- অকপট বৃষ্টিধারা তুমুল মিস করেছি! মেজাজ খারাপ করে বিচিত্র ভাবনা ভাবি, ওদেশের বৃষ্টির গরিবী দেখে। বড়লোক হলে কি হবে! বাংলাদেশের মতো ওদের আকাশ উদার হয়ে ঢালতে জানেনা- কাঁদতে শিখেনি তেমন করে। আরো ভাবি, ওখানকার বাচ্চাগুলোর কথা। গুটুর গুটুর করে খালি কম্পু গুতানো কিংবা হাইফাই কোনো খেলনা নিয়েই ব্যস্ত থাকলো বেচারাগুলো। বৃষ্টিতে কিভাবে ভিজতে হয়, আদুর গায়ে বৃষ্টিধারা কেমন করে মাখতে হয়, সে আনন্দের খোঁজ হতভাগার দল পেলো না ভেবেও মনটা উদাস হয়!
মনে পড়ে যায় নিজের ছেলেবেলার কথা। কোনো কোনো বৃষ্টির দিন মনটা কিছুতেই মায়ের শাসন, বড়দের বকুনির ধার ধারতো না। পাড়ার আর দু-দশজনকে জুটিয়ে হা রে রে রে করে নেমে যেতাম বৃষ্টিতে ভিজবো বলে। সে কি হৈ হু্ল্লোড়! আনন্দ স্বয়ং আমাদের বন্ধু তখন। সব ভুলে অপার আনন্দের হাত ধরে আমরা তখন দিশেহারা- বাঁধনছাড়া, পাগলপারার দল!
কোনো কোনো বৃষ্টির দিন ছুটতে ছুটতে চলে যেতাম নতুন কোনো পথের বাঁকে। যেদিকে হয়ত যাওয়া হয়নি কখনোই। লুকোচুরি খেলার অংশ হিসেবে তেমন জায়গা ছিলো খুব পছন্দের। এভাবে একদিন পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। ঘোরবৃষ্টির মাঝে একদম অচেনা এক পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলাম কেমন বোকার মতো! এখন ভাবলে হাসি পায়। আবার হারিয়ে যাওয়া সেই আমি'টার জন্য মনটা কেমন কেমন করে! এদিক ওদিক পথ খুঁজতে গিয়ে বন্ধুদের দেখা মিলে গিয়েছিলো তাতেই বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। সেবার বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি খেতে হয়নি। বরং আমি ফিরতেই, মা আমাকে ঝাপটে ধরে রেখেছিলেন অনেকটা সময়। আমার ভিজে কাপড় মায়ের শাড়িই শুধু ভিজিয়ে দেয়নি- তাঁর টুকটুকে মুখ জুড়ে জল ছোপছোপ খেলা দেখে আমি কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেবার ধুম জ্বর এসে যায় আমার। বৃষ্টি আমার ধাতে সয় না। ভিজলেই শর্দিতে ভুগতে হতো- যেকারণে বাড়ির বড় কেউ বৃষ্টিতে ভিজতে দেখলেই চোখ রাঙাতেন।
আর সব ব্যাপারে আমি শান্ত সুবোধ থাকলেও বৃষ্টি হলেই কেমন বেপরোয়া হয়ে যেতাম। তখন আমি পাগলা জগাই, তখন আমি কাউকে না ডরাই। ঠান্ডা জ্বরের তোয়াক্কা না করে কতো যে ভিজেছি তুমুল বৃষ্টির কোলাহলে! এখন এই বয়সে এসে বৃষ্টির দিনের সেসব কথা মনে পড়ে ভীষণ। খুব ইচ্ছে করে একদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ুক। ধুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আমি ভিজবো- আমূল ভিজে যাবো আমি। ছুটতে ছুটতে আবার পথ হারিয়ে ফেলবো…..কিন্তু তেমন বৃষ্টি আসে না যেন এখন। এলেও আমি আর আগের মতো ছুটে গিয়ে ভিজতে পারি না। ধুম বৃষ্টির দিনে হুডখোলা রিক্সায় প্রিয় একজন মানুষের সাথে ভিজতে পারার সুখস্মৃতি আমার হয়ত নেই। কিন্তু যা আছে সেই বা কম কি! বৃষ্টিদিন আমাকে তাই উদাস করে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবের সেইসব আনন্দমেলায়। মায়ের সেই সোঁদা গন্ধমাখা শাড়ির ছায়ায়…আমি তাই বৃষ্টি ভালোবাসি; আমি তাই হামুখো কাঙ্গালের মতো বৃষ্টি চাই।
==============================================
লেখাটা শেষ করার পর নিমাইচন্দ্র আমার দিকে মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, চ্রম বাজে একটা রচনা হইছে।
আমি বললাম, তা তো বটেই। কিন্তু কবিতাটা নিয়ে চাপাটা না মারলেই হতো।
নিমাই বললো, এটা ঠিক চাপা না, কিন্তু আমি কবিতা লিখছি শুনলে ছাগলেও হাসবে। দেখোনি, আগেকার দিনে নোটবইয়ের লেখকের নাম থাকতো, 'জনৈক অভিজ্ঞ হেডমাষ্টার'। আমাকে স্কুলে কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রিয় লেখকের নাম জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলাম, 'জনৈক অভিজ্ঞ হেডমাষ্টার'। আসলে তখন 'জনৈক' মানে ভাবতাম সৈয়দ জাতীয় বংশ টাইটেল, 'অভিজ্ঞ' মানে ভাবতাম মূল নাম, আর হেডমাষ্টারতো চিনিই, মাথায় পাকাচুল কেউ হবে।
আমি নিমাইচন্দ্রকে অভয় দিয়ে বললাম, তোমার লেখাটা দৈনিক বিলাতী আলুতে পাঠিয়ে দিতে পারো নিশ্চিন্তে।
No comments:
Post a Comment