Thursday, July 5, 2012

ওয়াসফিয়া নাজরীনের সাথে একটি সান্ধ্যকালীন আড্ডা

যাচ্ছিলাম আম কিনতে। খবর পেয়েছি ফরমালিন মুক্ত আম এসেছে এক জায়গায়। যেতে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম এতদিন বিষযুক্ত আম খেয়েছি, এখন বিষমুক্ত আম খেলে বদ হজম হবে কিনা। কিন্তু গিয়ে আমের দাম শুনে মস্তিষ্কে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হলো। বিবেকের কাছ থেকে সমাধান এলো ওই দামের বিষমুক্ত আম খাওয়ার চেয়ে খানিকটা বিষ সয়ে নেয়া ভালো। শরীরের নাম মহাশয়, যতটুকু সওয়ানো যায়, ততটাই .....।

আম কিনতে ব্যর্থ হয়ে মনে পড়লো বিশদ বাঙলার আলম খোরশেদ জানিয়েছিলেন ওয়াসফিয়া আসছে বুধবার সন্ধ্যার পর। আড্ডা হবে। ওদিকেই চাকা ঘোরালাম। নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘন্টা পরে গিয়ে বিশদ বাঙলার ছোট্ট আড্ডা ঘরে জায়গা পাবো কিনা সন্দেহ আছে। তবু ঘোর প্রতিবেশী মেয়েটাকে এক পলক দেখে আসার সুযোগ হারাই কেন। ঘোর প্রতিবেশী বলাতে অবাক হচ্ছেন? একই শহরের বাসিন্দারা সবাই প্রতিবেশীই তো। তাছাড়া ওয়াসফিয়া যে পাহাড়ে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছে তার একটা পাহাড় পরেই আমার বাসা। তার চেয়ে বড় সত্য হলো নিজের শহরের কেউ বিখ্যাত হলে তাকে প্রতিবেশী পরিচয় দিতেই গর্ব হয়।

নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা পর সাড়ে সাতটার দিকে বিশদ বাঙলায় ঢুকতেই কর্ণধার আলম ভাই জানালেন আর দশ মিনিটের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হবে, যানজটের জন্য প্রধান অতিথি শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফি আসতে দেরী করছেন, তিনি ওয়াসফিয়াকে সংবর্ধিত করবেন সবার পক্ষ থেকে। তিনি এসে পৌঁছালেই শুরু হবে। ভেতরে তখনো একটু জায়গা খালি আছে দেখলাম। আর কি, স্যান্ডেল খুলে ভেতরে বসে পড়লাম। সম্পূর্ন ঘরোয়া আয়োজন। বিশদ বাঙলার পনের বাই পঁচিশ ফুটের ছোট্ট আড্ডাঘরটি ততক্ষণে নানা বয়সী মানুষে জমজমাট হয়ে গেছে। পুরো ঘর জুড়ে কার্পেট বসিয়ে আড্ডার বন্দোবস্ত। দেয়ালের একপাশে মুরব্বীদের জন্য একসারি চেয়ার আছে। বাদ বাকী ঘরে সবাই পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে আছে কার্পেট জুড়ে।

অভিযাত্রী কই? মেয়েদের মধ্যে কোনজন হবে? পত্রিকার ছবির সাথে মিল আছে কিনা বাস্তবে? গতকালকের পত্রিকায় শেখ হাসিনার চেয়েও লম্বা লাগছিল। সামনের দিকে দেখলাম গাঢ় নীল সুতী শাড়ি পরা একটা মেয়ে লাজুক মুখে মাথা নীচু করে বসে আছে। আমার জায়গা থেকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। তবে মাথা তুলতেই বুঝলাম ওই মেয়েটিই ওয়াসফিয়া নাজরীন।

যানজট পেরিয়ে মুশতারী আপা আসতে প্রায় আটটা। ইতিমধ্যে ওয়াসফিয়ার মাও এসে গেছেন। যানজট আজকে আমার উপকারই করলো।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। এটাকে অনুষ্ঠান বললে যুত হয় না। পুরো ব্যাপারটাই ঘরোয়া। মাইক স্পীকারের বালাই নাই। গোল হয়ে মুখোমুখি বসে গল্প করতে করতে প্রজেক্টরে স্লাইড শো দেখা। বিশদ বাঙলার পক্ষ থেকে ওয়াসফিয়াকে একটা লাল সবুজ পতাকা চাদর পরিয়ে দিয়ে মুশতারী শফি সংবর্ধনা শেষ করলেন।

এবার মূল পর্ব। ওয়াসফিয়া তাঁর ছোট্ট জীবনের বিশাল অভিজ্ঞতা ঝুলি থেকে একটু একটু ছাড়তে লাগলেন মুগ্ধ শ্রোতাদের সামনে। বিশ্বাসই হতে চায় না, এই ছিপছিপে সাদামাটা দেখতে মেয়েটি বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম স্থানে পা রেখেছে।

সহজ, স্বচ্ছ, সরল বর্ননা। গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলতে জানে সে। সাত মহাদেশের সাতটি চুড়ায় উঠবে ওয়াসফিয়া। তিন মহাদেশ শেষ। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া। ইউরোপের শীর্ষচুড়ার ৩০০ মিটার নীচ থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল ঝড়ের কারণে। আবার যেতে হবে ওটায়। এই ৪টি চুড়ায় উঠতে পারলে মিশন শেষ। খোলামেলা আড্ডার মধ্যে প্রচুর গল্প হলো দেড় ঘন্টা ব্যাপী। ছেলেবেলার গল্প থেকে বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত গল্পের একাংশে যোগ দিলেন ওয়াসফিয়া জননী। প্রশ্নের মুখোমুখি হলো সেও।

প্রশ্নঃ আপনি কি গর্ব বোধ করছেন আপনার মেয়ের এভারেষ্ট জয়ে?
জবাবঃ আমার মেয়ে মোট ৭ টা চুড়ায় ওঠার জন্য নেমেছে, মাত্র তো ৩টায় উঠেছে। ও এভারেষ্টে যখন গেছে আমি ভয়ে থাকতাম প্রতিটা মুহুর্ত, ঘুমাতে পারতাম না। বাকী চারটায় কিভাবে উঠবে ভাবলে আমার বুক আতংকে হিম হয়ে যায়। গর্ব নয় আমি আতংকে আছি।

প্রশ্নঃ মা হিসেবে ওর এত বড় অর্জনের কোন লক্ষণ দেখা গিয়েছিল শৈশবে?
জবাবঃ ও বরাবরই শান্তশিষ্ট লাজুক। কিন্তু শৈশব থেকেই অসম্ভব জেদী ছিল সে। শৈশবেই জেদের চোটে বিছানায় শুয়ে শুয়েও খাট পালংক কাঁপিয়ে ফেলতো।

আড্ডার সুরে অনেক কথা বলেছেন ওয়াসফিয়া। তাঁর কয়েকটা নীচে দিলাম। তবে যেহেতু মগজের মেমোরি থেকে লেখা, আক্ষরিকভাবে হুবহু শব্দ ব্যবহার করা যায়নি।

১) আমাকে ২০০৭ এ চীনারা এভারেষ্টে উঠতে দেয়নি আমার ব্যাগে দালাইলামার ছবিসম্বলিত বই ছিল বলে। কঠোর ভাবে বলেছিল, তুমি জীবনে আর কখনোই তিব্বতে পা রাখতে পারবে না। এবার এভারেষ্টে উঠে নেপাল অংশ থেকে তিব্বতের দিকে ৫০ ফুট নেমে গিয়ে দালাইলামার একটি ছবি বরফে পুতে ছবি তুলে এসেছি। অনেক দিনের জেদ ছিল আমার। পা রাখতে দেবে না আবার!

২) আমাদের গ্রামের কিছু রক্ষণশীল মানুষের কাছে আমি প্রায় অচ্ছ্যুত ছিলাম আমার ধর্মকর্মহীন জীবন যাপনের জন্য। দেশ বিদেশ একা ঘুরে বেড়াই। কিন্তু এবার এভারেষ্ট থেকে ফেরার পর সেই রক্ষণশীল মুরব্বীরাই এসে জড়িয়ে ধরে জানাচ্ছে আমার জন্য প্রতিদিন দুহাত তুলে দোয়া করেছে।

৩) এভারেষ্টকে শেরপারা দেবতা মান্য করে। কিন্তু এভারেষ্টের চুড়ায় উঠতে হয় জুতা পায়ে। দেবতার মাথায় পা দেয়া একটা বেয়াদবী। বেয়াদবীর জন্য আগাম মাফ চাইতে একটা পুজার আয়োজন করা হয়। পুজার বেদীতে নানান জিনিসপত্রের পাশে অভিযাত্রীদের জুতোগুলো রেখে দেবতার পুজো করা হয় যাতে ওই জুতো পরে এভারেষ্টে উঠলেও দেবতা রাগ না করেন। কুসংস্কার আছে যদি কোন কারণে পুজার বেদীটা ভেঙ্গে পড়ে তাহলে সেটাকে অমঙ্গলের সূচক বলে ধরে নেয়া হয়। পথে একটা মেয়ের মৃত্যু ঘটলে শেরপারা স্মরণ করছিল মেয়েটার বেদীটা ভেঙ্গে গিয়েছিল পুজা করার সময়।

৪) কিলিমাঞ্জারো কিংবা একোংকাগুয়ার চেয়ে এভারেষ্ট অনেক কঠিন। তবু এভারেষ্ট আমার ভেতরে নেশা জাগিয়েছে। আমার ইচ্ছে ভবিষ্যতে আমার আমার যতগুলি সন্তান হবে প্রত্যেকটিকে নিয়ে এভারেষ্টে চড়বো।

৫) আমাকে এভারেষ্ট বিজয়ী বলা উচিত নয়। শুনতে ভালো লাগে না। বারণ করেছি তবু মিডিয়া এতেই অভ্যস্ত। এভারেষ্ট অনেক বিশাল ব্যাপার, একে কেউ বিজয় করতে পারে না, আমরা কেবল এভারেষ্ট ছুঁয়ে আসতে পারি।

৬) মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর আমাকে বিশাল একটা পতাকা দিয়েছিল এভারেষ্টের চুড়ায় ওড়ানোর জন্য। অতবড় পতাকা কেউ নেয় না অভিযানে। বেস ক্যাম্পে আমি যখন পতাকাটা ওড়াই, সবগুলো ক্যাম্পের মধ্যে ওটাই ছিল বৃহত্তম পতাকা। সারা পৃথিবী থেকে আসা অভিযাত্রীরা মনে করে বাংলাদেশ এভারেষ্টে বিশাল এক টীম পাঠিয়েছে।

৭) এভারেষ্ট থেকে ফিরে আসার পর বহুবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে একটি মন্তব্য - "যখন শুনলা নিশাত আগে উঠে গেছে, তোমার কিরকম লাগলো। মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে ইচ্ছে করেনি? নিশাত যখন উঠে গেছে তখন তোমার লাভ কি?" কেউ কেউ বোঝে না, এভারেষ্টে ওঠা কোন প্রতিযোগিতার বিষয় নয়। ওঠাটাই যোগ্যতা। নিশাত আপা আর আমি কখনোই প্রতিযোগিতা করিনি।

ওয়াসফিয়ার শৈশব কৈশোরের উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছে চট্টগ্রামে। বাবার চাকরীসুত্রে থাকতেন জেমস ফিনলের পাহাড়ে। পড়তেন বাওয়া স্কুলে। তারপর ঢাকা চলে যান। অতঃপর উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য আমেরিকা, স্কটল্যাণ্ড, তিব্বত। তিব্বতে গবেষণা কালীন সময়ে শেরপাদের সাথে বন্ধুতা গড়ে ওঠে। হিমালয়ের সাথে জানাশোনাও তখন। তাদের কাছ থেকেই ট্রেনিং নিয়েই অভিযাত্রার শুরু।

কথার শেষ নেই। ঘড়ির কাটা দেখে আড্ডা সংকুচিত হলো। দশটা বেজে গেছে ততক্ষণে। আনুষ্ঠানিকভাবে আড্ডা শেষ করা হলো। প্রশ্নোত্তর পর্বও শেষ। আড্ডা শেষে ওয়াসফিয়াকে বললাম আমার ছ বছরের জেদী মেয়েটার জন্য কিছু একটা লিখে দিতে। সে লিখলো, "ডিয়ার ওশিন, লিভ ইয়োর লাইফ, লাইফ ইজ হোয়াট ইউ মেক ইট। লাভ ফ্রিডম"।

বাসায় গিয়ে ওশিনকে বইটা দিয়ে অটোগ্রাফের কথা বলাতে সে বললো, "মানেটা বুঝিয়ে দাও বাবা!"।
মুশকিলে পড়লাম। হুবহু অনুবাদ করে দিলে তো আগামীকাল থেকে আর পড়ার টেবিলের কাছ দিয়েও যাবে না, ডাইনিং টেবিলের আশপাশ মাড়াবে না, স্বাধীনতা ঘোষণা করে ধেই ধেই করে সারা ঘর নেচে তোলপাড় করে ফেলবে। তাই বললাম, "তোমাকে ওয়াসফিয়া বলেছে বেশী বেশী করে লেখাপড়া করে বড় হতে, তাইলে তুমিও হিমালয়ের চুড়ায় উঠে এই বরফের আইসক্রিমে ঘুরে বেড়াতে পারবে।"

এত সুন্দর মিথ্যা আমি জীবনে খুব কমই বলতে পেরেছি।

No comments: