ধরা কাহিনী সবারই আছে। জীবন মাত্রেই মরণশীল, মানুষ মাত্রেই ধরাশীল। ধরা খাওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নাই, কোলেষ্টেরোলও নাই। তবে ধরা কাহিনী নগদের চেয়ে বাসীই মজাদার। তাই গতকাল যে ধরাটা খেয়েছি সেটা এখন না বলে পুরোনো গুলিই বলছি।
মোবাইল 'ধরা': একটেল
দশ-বারো বছর আগেও ভোররাত থেকে লাইন ধরে হুড়োহুড়ি ধাক্কাধাক্কি করে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা খরচ করে মিনিটে ৭ টাকায় কথা বলার সুবর্ণ সুযোগ পাবার জন্য যে কোম্পানীর কানেকশান কিনতো মানুষ, তার নাম গ্রামীণ ফোন। ক্রেতা সামলানোর জন্য পুলিশ ডাকতে হয়েছে সেরকম কোম্পানী পৃথিবীতে খুব বেশী নেই। গ্রামীণের ক্রেতাভাগ্য ঈর্ষনীয় ছিল।
আমি গ্রামীনের লাইনে দাঁড়াইনি কখনো। মোবাইল ফোন বড়লোকের জিনিস, বাসার ল্যান্ডফোনই যথেষ্ট, এই ধারনাটা এক বন্ধু এসে নাড়িয়ে দেয় যখন সে বিদেশ যাবার আগে তার একেটেল মোবাইলটা আমাকে বন্ধুসুলভ দামে 'উপহার' দিয়ে যেতে চাইল।
'উপহারে' আমার আপত্তি নেই জেনে 'মাত্র' আট হাজার টাকায় দূর্লভ একটেল পোষ্টপেইড সিম আর সাথে বোনাস হিসেবে সাড়ে তিন হাজার টাকার দুমাসের বকেয়া বিল বুঝিয়ে দিয়ে সে বিদেশে চলে গেল। একটেলের ওই সিমটা তখন মহার্ঘ ছিল 'ইনকামিং ফ্রি' ছিল বলে।
কিছুদিন পরে এক প্রতিবেশী আমার কাছে সীমটা 'মাত্র' দশ হাজার টাকায় কিনতে চাইলে আমি ঝাপটা দিয়ে উড়িয়ে বললাম, 'বেকুব পাইছো আমাকে? ওই সিমের দাম শেয়ার বাজারের মতো বাড়তেছে, ছমাস পর বিশ হাজার টাকায় উঠবে'। বুদ্ধিমান হলাম, সিমটা যত্ন করে রেখে দিলাম।
কিন্তু মাত্র ১১ মাসেই সিমের দাম মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। ৫০০ টাকায়ও কেউ মুলোয় না দশ হাজার টাকার সিম। উল্টা বেহুদা মাসিক কানমলা আড়াইশো টাকার লাইন রেন্ট। সিমটা নর্দমায় ফেলেও দিতে পারছি না কারণ বাসার ঠিকানায় বিল আসে, সিম ফেলে দিলেও খেলাপী বিলের জন্য কোনদিন আবার পুলিশ আসে । পরে পাড়ার এক ছোটভাই দয়া করে বিনে পয়সায় সীমটা 'উপহার' নিয়ে আমাকে উদ্ধার করলো।
========================================
মোবাইল 'ধরা': টেলিটক
গ্রামীনের সিম নিয়ে মারামারি, কাড়াকাড়ি থেমে গেলেও টেলিটক নামের সোনার হরিণের জন্য ঢাকায় কয়েক দফা মারামারি হয়ে গেছে তখন।
বাঙালীর ধর্ম নতুন কিছু পাবার জন্য দাঙ্গাদাঙ্গি করতেই হয়। সেই সময় ঘোষনা এলো ঝামেলা এড়াতে টেলিটক ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভাগ্যবানদের নির্বাচিত করবে। চট্টগ্রামে বসেই আবেদন করা যাবে।
নিয়ম হলো জনপ্রতি মাত্র একটা আবেদন। বললেই হলো? দিলাম দুটো এপ্লাই করে, একটা নিজের নামে,আরেকটা বউয়ের নামে। আইন ভাঙার মজাই আলাদা। কিন্তু লটারীভাগ্য খারাপ আমার, বউয়ের নামটাই জিতলো। তবু খুশী কারন আইন অমান্য করার নগদ ফজিলত পেলাম।
২৭০০ টাকা জমা দিয়ে নির্দিষ্ট ব্যাংক থেকে সীম নেবার জন্য বলা হলো। সেই ব্যাংকটা অফিস থেকে অন্তত দশ বারো কিলোমিটার দুরে জঘন্য যানজট এলাকা খাতুনগঞ্জে। পরদিন আমি খাতুন গঞ্জের নির্দিষ্ট ব্যাংকে গেলাম সিম তুলতে।
দুপুর পেরিয়ে গেছে তখন। ব্যাংক থেকে বলা হলো যার সিম তাকেই তুলতে হবে। যদি সে আসতে না পারে তাহলে আমাকে অথরাইজ করে দিতে হবে, সাথে ফটো জাতীয়তা আর মেট্রিকের সার্টিফিকেট লাগবে। এক ঘন্টার মধ্যে না দিতে পারলে আজকে বন্ধ, আগামীদিন আবার আসতে হবে। মাথা খারাপ? একটা সিম নিতে দুদিন গচ্ছা দেবো? আজকেই নেবো। টেক্সী নিয়ে সোজা বাসায় গিয়ে বউয়ের স্বাক্ষর, ছবি, সার্টিফিকেট নিয়ে সেই অতি দুর্লভ সিমটা সংগ্রহ করলাম।
অবশেষে টেলিটক নামের সোনার হরিনের মালিক। সস্তায় কথা বলা, ইনকামিং ফ্রী, লাইন রেন্ট নাই, টিএন্ডটিতে ফোন করলে এক্সট্রা বিল নেই, মাত্র ২৭০০ টাকায় কত্তো সুবিধা! গর্বে বুক টানটান।
মাসখানেক পর।
পাশের টেবিলের রাশেদ জানালো সে এইমাত্র দুটো টেলিটক সিম কিনছে আগ্রাবাদ থেকে। আমি চোখ তুলে তাকালাম।
-টেলিটক? কেমনে? আবার দিচ্ছে নাকি? লটারীতে?
- আরেন্না, রাস্তা থেকে।
-আহা, রাস্তা থেকে কিনলা? দাম বেশী নিছে নিশ্চয়ই
-বেশী নিবে কেন?
-আমরা তো ব্যাংক থেকে বেসিক প্রাইসে কিনছি, বাইরের লোক তো প্রফিট যোগ করে বিক্রি করবে। তা কতো নিল তোমার কাছে, তিন হাজার নাকি চার?
-প্রতিটা বিশ টাকা
-কি????
-বিশ
-মশকরা করো?
-কসম
-তোমার কসমের গুল্লি মারি, সত্যি বলো কত খসলো
-সত্যিই বিশ টাকা। কেউ কেউ নাকি বিশ টাকায় দুটো সিমও পেয়েছে, আমার চল্লিশ গেল দুটোতে।
-কী?????
ফিট না খেলেও গুম হয়ে বসে থাকি। ২৭০০ টাকার সিম ২০ টাকায় ফুটপাতে নেমে আসবে কে জানতো। আর কটা দিন অপেক্ষা করলেই হতো।
========================================
আন্তর্জাতিক ধরা
এক দশক আগের কথা। অফিসের কাজে পূর্ব এশিয়ার একটা দেশে গিয়েছি ৭ দিনের জন্য। হোটেলের থাকা খাওয়ার সমস্ত খরচ কোম্পানীর। রাতে শোবার আগে বিছানার পাশে রাখা টেলিফোনটা দেখে ইচ্ছে হলো দেশে ফোন করি। কিন্তু লাভ নাই। হোটেলের রুমে সাধারনত লোকাল ফোনই থাকে। তবু বেনিফিট অব ডাউট চিন্তা করে ফোনটা কানে লাগাতেই দেখি টোঁ টোঁ করছে আইএসডি টোন। বোতাম টিপতেই সাঁ করে লাইন বাংলাদেশে চলে গেল। মজা তো!
প্রত্যেকদিন রাতে হোটেলে ফিরে দেশের খোঁজ খবর করি। ফোন ফ্রী পেলে বাঙালীর খোঁজ খবরের কাজ বেড়ে যায়। ফ্রী না হলেও দুচারশো টাকার বিল আসলে ক্ষতি কি। কোম্পানী দেবে নতুবা আমিই দিয়ে দেবো। কিন্তু হোটেল ছাড়ার সময় কেউ বিল খুঁজলো না ফোনের। আমিও অফিসকে জানালাম না ব্যাপারটা।
দেশে ফিরে আসলাম নিরুপদ্রপেই। দশ পনেরোদিন পর অফিসের কাজটাজ গুছিয়ে বেরুচ্ছি, এমন সময় একটা মেইল এলো আমার হেড অফিস থেকে। সাথে একটা এটাচ ফাইল। সেই হোটেলের বিলের কপি। ওটায় লেখা আছে, ৫ দিনে ৩৫ মিনিট কথা বলা বাবদ আমার কাছে পাওনা হয়েছে ১১৫ ডলার! কল নাম্বারের লগ সহ দেয়া আছে।
ওই দেশের আন্তর্জাতিক কল রেট যে আমাদের প্রায় দশগুন ছিল কে জানতো!
========================================
শেয়ার বাজার ১৯৯৬
শেষে বললেও আসলে এটাই ছিল জীবনের প্রথম ধরা।
শেয়ার বাজারে চরম চাঙ্গা ভাব দেখে বাবার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে দুটো কোম্পানীর সেকেন্ডারি শেয়ার কিনে ট্রান্সফার করে ভদ্রলোক হয়ে বসে ছিলাম। ভেবেছি এটা ভদ্রলোকদের ব্যবসা, এত বেচাবিক্রি কার্ভ মার্কেট ইত্যাদি নিয়ে অস্থির হবার কি আছে। শেয়ারের দাম আস্তে আস্তে বাড়ুক। কয়েক বছর পরে মোটা লাভ নিয়ে বিক্রি করবো।
এক লাখ টাকার বিনিয়োগ যখন দুমাসের ব্যবধানে দুলাখে উঠলো তখন অনেকে বললো বিক্রি করে লাভ উঠিয়ে নিতে। বন্ধুদের কেউ কেউ কিনতেও চাইল ভালো দামে। আমি তাদের গম্ভীর হয়ে বললাম, আমি ফটকা কারবারী না। একদিনে সব লাভ খেয়ে ফেলতে চাই না। কারো কথায় কান না দিয়ে শেয়ার সার্টিফিকেটগুলো আলমারীতে তুলে রাখলাম ভবিষ্যতের রিজার্ভ সম্পদ হিসেবে এবং চাকরীতে মনোযোগ দিলাম।
কিন্তু অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকে না। তিন-চার মাস পরেই শেয়ার বাজারের পাহাড়টা পতেঙ্গা সৈকতের বালিতে মিশে গিয়ে আমার দু'লাখ টাকাকে দশ হাজার টাকা বানিয়ে চলে গেল।
সেই ক্ষতির একটা উপকার পেলাম পনেরো বছর পর। ন্যাড়া আর বেলতলায় যায়নি বলে ২০১১ সালের শেয়ার ধ্বসে কোন আঘাত লাগেনি তার।
[রচনাকাল: জানুয়ারী ২০১১]
No comments:
Post a Comment