বাবা হিসেবে আমি সন্তানদের বেড়ে ওঠা দেখতে দেখতে একটা নতুন আনন্দের সন্ধান পেয়েছি। জানি না সব বাবা এই আনন্দকে উদযাপন করে কিনা। সেই সাথে একটা দুঃখবোধও কাজ করে। আমার আশঙ্কা এই সুখের মেয়াদ বেশিদিন থাকবে না। আমার চেনাজানা অনেক পরিবারে দেখেছি জ্বলে ওঠার পর দপ করে নিভে গেছে কোন না কোন একটা ঘটনায়। আমার ছেলেটা যখন অসুস্থ হলো করোনার সময়, আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমি জীবনের সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি সারারাত জেগে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার বাবাও আমার ছেলেবেলায় এরকম ঘাবড়ে গিয়ে ডাক্তারকে ধরে মার দিয়েছিল শুনেছিলাম। আমি প্রায় মরে গিয়েছিলাম। একদম শেষ প্রান্ত থেকে ফিরে এসেছিলাম। আমরা চার ভাই হবার কথা ছিল। টিকেছি শুধু আমি একা।
আজকাল আমার ভাবতে ভালো লাগে এই বয়সে বাবা কী করেছিলেন, কেমন ছিলেন ইত্যাদি। এরকম বয়সে বাবা বিদেশ থেকে ফিরে আসেন। আমি তখন কলেজে পড়ি। পঞ্চাশ পার হবার পর থেকে বাবা খুব বেশি স্বচ্ছল ছিলেন না। ৫৫ বছরে পৌঁছে বাবা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম। অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি।
সেদিক থেকে তুলনা করলে আমার মধ্য পঞ্চাশে আমি এখনো স্বচ্ছল আছি। কিন্তু আমার সন্তানেরা এখনো স্কুলে পড়ছে। আমি দেরিতে বিয়ে করেছি, দেরিতে বাবা হয়েছি, তাই আমার বাবার তুলনায় পিছিয়ে আছি অন্তত ৮ বছর। এই ঘাটতি কখনো পুরণ হবে না। আমাকে যদি এই মাঝপথে চলে যেতে হয়, তাহলে আমার সন্তানেরা অসহায় হয়ে পড়বে। তাদের বেড়ে ওঠার পর্বটা অনিশ্চয়তায় ডুবে যাবে। এই ভাবনটা আমাকে মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে।
তবু একটা তৃপ্তি আছে আমার। আমার বাবার চেয়ে আমি সন্তানদের বেশি কাছে পেয়েছি। আমার যখন বেড়ে ওঠার বয়স বাবা তখন বিদেশে। দীর্ঘ ৮ বছর বিদেশে থাকার কারণে বাবাকে আমি অনেকটা সময় কাছে পাইনি। যখন দেশে ফিরে এসেছে, তখন আমি বড় হয়ে গেছি, ওই বয়সে কেউ বাবার ন্যাওটা হয়ে থাকে না। প্রেস্টিজজ্ঞান বেড়ে যায়। আমি বাবার কাছ থেকে সযত্ন দূরত্ব বজায় রাখতাম। কিছুদিন পর আমার ছেলেও হয়তো প্রেস্টিজজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে পড়বে তখন সেও আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে। তবু এখনো আনন্দ যে আমি দীর্ঘ সময় ওদের কাছে পেয়েছি। আমার কর্মক্ষেত্র বাসার মধ্যে আছে বলে। স্কুলের সময় বাদ দিলে সারাক্ষণই আমরা একসাথে কাটাই। আমার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে আমার দুই সন্তান। ওদের ছাড়া আমার এক দিনও চলে না।
ছেলেবেলার কথা ধরলে আমার তুলনায় আমার সন্তানেরা একটা জায়গায় পিছিয়ে আছে। ওদের বয়সে আমি অনেক বেশি বহির্মুখী ছিলাম। বাইরের খেলাধুলার একটা জগত ছিল। আমাদের কলোনীতে সেই সুযোগটা বেশি ছিল। এখন ওরা পুরোপুরি গৃহবন্দী জীবনযাপন করে। শহরের কেন্দ্রস্থলে থাকি, ঘর থেকে বের হলেই সদর রাস্তা গাড়িঘোড়া হৈ হুল্লোড়। আমাদের সেই নিরিবিলি জীবন ওরা পায়নি।
ওরা এগিয়ে আছে অন্য জায়গায়। আমার ছেলেবেলায় আমরা অতি সাধারণ নিন্মবিত্ত জীবনযাপন করতাম। ছোট একটা বাসায় আমরা এতগুলো ভাইবোন মিলে থাকতাম। অভাব অনটন না থাকলেও তেমন একটা উন্নত জীবন কাটাতাম বলা যায় না। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত এক রুমের বাসাতেই থাকতাম আমরা। এখন ভাবলে অবাক হই। ওদেরকে সেই গল্পগুলো করলে ওরা অবিশ্বাসীর চোখে তাকায়। ওরা জন্ম থেকেই শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা আধুনিক ফ্ল্যাটে বাস করছে ওরা। যেখানে বিদ্যুত পানির অবাধ সরবরাহ আছে। লিফট, জেনারেটর, সিকিউরিটি সার্ভিস সবকিছু প্রথম শ্রেণীর। আমরা এখনো মধ্যবিত্ত, কিন্তু জীবনযাত্রার মান অনেকটা উচ্চবিত্তদের মতো। ঘরে আধুনিক সব গ্যাজেট মজুদ আছে। শৈশব থেকে বাসায় দু চারটা ল্যাপটপ দেখে বড় হয়েছে, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট ফোন, ডিএসএলআর ক্যামেরা থেকে শুরু করে সবকিছুই বাসায় আছে। কোনদিন অভাব দেখেনি। বাসায় আইপিএস, জেনারেটর সব আছে, আজকাল বেশি লোডশেডিং মাঝে মাঝে জেনারেটর থাকে না। তাই কখনো কারেন্ট চলে গেলে ওরা অবাক হয়। আমি বলি, দেশের বেশিভাগ মানুষ এভাবেই আছে। তোমাদেরও সেরকম অবস্থায় থাকার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। বলি ঠিকই, কিন্তু জানি কখনো এই সুবিধাগুলো চলে গেলে ওদের খুব কষ্ট হবে। আমার ছেলেবেলায় এসবের কানাকড়িও দেখিনি। তাই আমাদের অসুবিধা হয়নি। আমরা ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। ওরা জন্মের সাথে সাথে সবকিছু পেয়ে গেছে। যদি আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায় তখন ওদের খুব কষ্ট হবে। এটা ভেবে আমার খারাপ লাগে। কিন্তু জীবন তো চিরকাল একরকম থাকে না। আমরা গত ২৮ বছর এক নাগাড়ে যে স্বচ্ছলতার জীবন কাটাচ্ছি, সেটা খুব দুর্লভ একটা বিষয়। আমার বাবা দাদা কেউ এতদিন সুখ করেনি।
আমার কন্যাকে নিয়ে খানিক দুশ্চিন্তা আছে। সে পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী না। নিজের ভাল বোঝে না। সুযোগ পেলেই ফাঁকি দেয়। শুধু পড়ায় নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সে ফাঁকি দেবার সুযোগ খোঁজে। এই প্রবণতা খুব খারাপ। এটা ওর ভবিষ্যতকে অনেক জটিল করে ফেলবে। আমি অনেক চেষ্টা করেও কাজ না করার বদভ্যাসটা দূর করতে পারিনি। ফাঁকির হাতে সে বন্দী হয়ে আছে। কিছুদিন পর কলেজে পড়তে শুরু করবে। তখন জীবনটা নিজের হাতে চলে যাবে। সেই জীবনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে যদি চলতে না পারে, তাহলে পুরো ভবিষ্যত হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। নিজেকে ফাঁকি দিলে জীবন ক্ষমা করে না। আমার অনেক বন্ধুর জীবন থেকে আমি এই শিক্ষাই নিয়েছি। সেই হিসেবে ছেলেটা এখনো ভালো আছে। তার মধ্যে ফাঁকিবাজির চেষ্টা নেই। সে নিজে নিজে অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করে। সেই চেষ্টাগুলো আমাকে অবাকও করেছে। যদি ওর সুযোগ থাকে তাহলে সে উন্নতি করতে পারবে। টেকনোলজিতে ওর বেশ আগ্রহ। টেকি জিনিসপত্র নিয়ে একদম ছেলেবেলা থেকেই নাড়াচাড়া করে। আমি তেমন কিছু শেখাইনি, তবু সে কম্পিউটারে আমার চেয়ে ভালো। আমি যেসব পারি না, সে ওসব পারে। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর সে আমাকে কম্পিউটার বিদ্যা শেখানোর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এটা ভালো লেগেছে আমার। আমি প্রোগ্রামিং এর পও জানি না। সে আমাকে ল্যাঙ্গুয়েজ শেখায়। বেসিক ওয়েব পেজ ডিজাইন, ওয়েব টুলস তৈরি করা, জাভা, এইসটিএমল, সিএসএস এসব আমি বুঝি না। সে আমাকে ওসব নিয়ে জ্ঞান দেয়। শেখার এই আগ্রহটা জরুরী। ভাইবোন দুজনই যদি একরকম করে কাজ শিখতো। দুজনেরই ভাল হতো। কিন্তু দুজন খোঁচাখুঁচি করে বেশি। এটাই মুশকিল। আমি তাই দুজনকে দুপাশে নিয়ে মিলেমিশে গল্প করতে ভালোবাসি। তখন ওরা ভাল থাকে পোষা বেড়ালের মতো। মধ্য পঞ্চাশ বয়সে আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ওদের সাথে সময় কাটাতে। বন্ধুদের আড্ডার চেয়েও আমি ওদের আড্ডা উপভোগ করি। কারণ এখন ওরা পড়াশোনা বিষয়ক কথাবার্তাগুলো বোঝে। আমি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করি সেগুলোর গল্প করতে পারি ওদের সাথে। আগে দিশার সাথে করতাম, এখন ওদের সাথে করি।
No comments:
Post a Comment