Sunday, June 8, 2014

অসময়ে গুরুত্ব হারানো সংবাদটি

কেতাবী জ্ঞান না থাকলেও কাতেবুল ইসলামের কুতুবী বুদ্ধির কাছে মিরাজুল ইসলাম দুগ্ধপানরত বাছুর মাত্র। এক গাঁয়ের বাসিন্দা দুইজনই, দুই প্রান্তে বসবাস। শৈশব কৈশোরে একসাথে দুরন্তপনা করলেও দেশভাগের পর ভোল পাল্টে যায় কাতেবুল ইসলামের। দাঙ্গার সময় গ্রাম ছেড়ে পালানো এক হিন্দু পরিবারের সব সহায় সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব নেবার পর পুরো গাঁয়ের দায়িত্বও যেন তার উপর এসে পড়ে। সেই পরিবার আর ফেরেনি, সম্পদের দলিলে কাতেবুলের কারসাজির হাত পড়ে মালিকের ঠিকানা বদলে যায়। শুরুতে আপনি মোড়ল হলেও একসময় গাঁয়ের লোকেও তাকে মানতে শুরু করে। এক মিরাজুল ইসলাম ছাড়া।

মিরাজুল ইসলাম তাকে মোড়ল মানতে পারে না বন্ধুই মনে করে এখনো। বাল্যবন্ধু হলেও কাতেবুল ইসলাম ধনদৌলতের মালিক হবার পর থেকে মিরাজুলের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে থাকে। একসময় মিরাজুল বন্ধুকে হারিয়ে ফেলে চামুণ্ডাবেষ্টিত ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে।

কাতেবুলের বৈঠকখানায় লম্বা একটা টেবিলের এক পাশে দুটো চেয়ার বসানো আছে যেখানে সে বিশিষ্ট অতিথিকে বসিয়ে গল্পগুজব করে। টেবিলের দুপাশে আর ঘরের চারপাশে আরো আট দশখানা কাঠের টুল বসানো যেখানে গ্রামের সাধারণ লোক বসে মোড়লের কথা শোনে।

মিরাজুল প্রথম ভুলটি করে এক সালিশের দিনে। সেদিন সে কাতেবুলের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে কোন কথাবার্তা ছাড়াই। কাতেবুলের কাছে ব্যাপারটা বেয়াদবীর সামিল। ছেলেবেলায় নেংটা হয়ে এক পুকুরে গোসল করেছি বলে এখনো এক বিছানায় ঘুমাবো তা কখনো হয় না। গাঁয়ের লোক কিন্তু এতে কিছু মনে করে না, জানে দুজনেই বাল্য দোস্ত। কাতেবুল মনে মনে খুবই রুষ্ট হয় কিন্তু মুখফুটে কিছু বলতে পারে না। মনে মনে চেপে রাখে।

সেই থেকে শুরু। সুযোগ পেলেই কাতেবুল অপদস্থ করতে শুরু করে মিরাজুলকে। মিরাজুলের অর্থবিত্ত নেই, কিন্তু কিছু জোত জমি আছে তাতে ভালোই সংসার চলে। এই ভালোটা কাতেবুলের সহ্য হয় না। সে চায় বাকীদের মতো মিরাজুলও তার বাধ্য থাকবে, তার অধীন থাকবে, টাকাপয়সা লাগলে হাত পাতবে। ছেলেমেয়ের জন্য ভালো জামা লাগলে এসে বলবে। কাতেবুল জনসেবা করতে পছন্দ করে। সে সবাইকে সেবা করলেও মিরাজুলের জন্য কিছু করতে না পেরে মনে মনে অস্বস্তিতে ভোগে।

অস্বস্তিটা কয়েকগুন বেড়ে গেল যখন মেরাজুল বাড়ির পশ্চিম জমিতে বিরাট একটা পুকুর খনন করালো। পুকুরের চারপাশ ঘিরে নারকেল আম জাম কাঠাল গাছ লাগালো। খাবার জল আর মাছ চাষ দুটোর জন্যই দরকার ছিল পুকুরটার। গাঁয়ের লোকের মুখে পুকুরের প্রসংশা শুনে কাতেবুলের মেজাজটা দ্বিগুন চড়ে গেল।

মেজাজ ঠাণ্ডা করতেই বোধহয় কাতেবুল একদিন একটা মোটর সাইকেল কিনে ফেললো। নানান কাজে তাকে জেলা শহরে যাতায়াত করতে হয়। মোটরসাইকেলের দরকারটা ফেলনা নয়। জেলাশহর থেকে ফেরার সময় দুনিয়া কাঁপিয়ে ভটভট করে যখন তালতলার মেঠো পথে নামে তখন গাঁয়ের লোক কেন যেন একটু তটস্থ হয়ে পড়ে।

এরকম সময়ে মিরাজুল ইসলাম তৃতীয় বেয়াদবীটা করে বসলো। একদিন সে একটা রেডিও কিনে ফেললো। দেশ বিদেশের খবর শোনার জন্য। কাতেবুল ভাবলো এটা মিরাজুলের বাড়াবাড়ি। সে মোটর সাইকেল কিনেছে বলে পাল্টা রেডিও কিনে সে বাহাদুরি দেখালো। চাইলে কাতেবুল তিনটা রেডিও কিনে দেখাতে পারে। কিন্তু সেটা করলে মিরাজুলকে শিক্ষা দেয়া হবে না। তাই সে এক বৈঠকে ঘোষণা করলো, রেডিও হলো শয়তানের বাক্স। মানুষের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে রেডিও শুনলে। চাটুকারেরা রব তুললো শয়তানের বাক্স, শয়তানের বাক্স, শয়তানের বাক্স।

একদিন কাতেবুলের বড় ছেলে জেলা শহর থেকে ফেরার পথে একটা রেডিও কিনে আনলো। কাতেবুল রাগে কিড়মিড় করেও জিব কামড়ে ফতোয়া বের করে ফেললো। ইহুদি নাসারার সাথে যুদ্ধ চলতেছে আরব দেশে। সেই যুদ্ধের খবর শোনা ঈমানী দায়িত্ব। সুতরাং রেডিও এখন হালাল। মোসাহেবরা বললো হালাল হালাল হালাল।

মিরাজুলের বড় ছেলে ঢাকায় পড়াশোনা করে। সে একটা মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলেছে শহরেই। মিরাজুল সমাজে মুখ যতটুকু দেখাতে পারতো তাও বন্ধ হয়ে গেল কাতেবুলের এক ফতোয়ায়। যে ছেলে বাপের অমতে বিয়ে করে তাকে ত্যাজ্য করা ছাড়া কোন উপায় নাই। মাথা নীচু করে শুনলেও মিরাজুল ত্যাজ্য করতে পারলো না ছেলেকে। তবে কঠিনভাবে বলে দিল সে যেন গ্রামে না আসে আর। মেসাহেবরা বললো ত্যাজ্য ত্যাজ্য ত্যাজ্য।

বছর না ঘুরতেই কাতেবুলের বড় ছেলেটা একদিন পাশের গ্রামের এক কৃষকের মেয়েকে তুলে এনে জোর করে বিয়ে করলো। কাতেবুলের ফিট হওয়া মাথায় বরফ দেবার পর হুশ ফিরলে সে প্রথম যে বাক্যটা বলে তা হলো, 'বয়স হলে মুসলমানের ছেলেকে বিয়ে করানো বাপের দায়িত্ব। বাপ সে দায়িত্ব ভুলে গেলেও ছেলে যে ভোলেনি, সেজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। সে নিজ দায়িত্বে বাপের অপ্রদত্ত নির্দেশ পালন করেছে বলে তাকে খোশ আমদেদ। মোসাহেবরা বললো, খোশ আমদেদ, খোশ আমদেদ, খোশ আমদেদ।

মিরাজুল সব বুঝেও মুখ বন্ধ করে থাকে। সে বুঝে ফেলে একই কাজ তার জন্য হারাম হলেও কাতেবুলের জন্য হালাল। এই নিয়মের মধ্যে সে ছোট মেয়ের বিয়েটা দিয়ে ফেলে নিজ হাতে। ব্যাপক আয়োজন না হলেও ঢাকঢোল কম বাজেনি।

মিরাজুলের মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি পৌঁছানোর আগেই কাতেবুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তার মেয়ের বিয়েটা এমন জাঁকজমক করবে তা  সাত গ্রামের লোকে দেখেনি। জেলা শহর থেকে বাবুর্চি, শহরের নামকরা ব্যাণ্ডের বাদক দল, মহাসড়ক থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তার পুরোটাই সাতদিন ধরে আলোকসজ্জা চলবে।

তিন মাসের মধ্যে পাত্র ঠিকঠাক করা হলো। মোড়ল জীবনের তেইশ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো কাতেবুল হাজির হলো সাবেক বন্ধুর বাড়ি। বিয়ের দাওয়াত নিয়ে। অনুষ্ঠানের তিনদিন আগেই যেন মিরাজুল পরিবার নিয়ে তার ঘরে চলে আসে ভাবীসাবকে সেই ওয়াদা করিয়ে তবে উঠলো কাতেবুল। মুগ্ধ হলো মিরাজুলের পরিবার।

বিবাহের আয়োজনের সাথে দুই বন্ধুর পুনর্মিলনে গ্রাম জুড়ে আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো।

গায়ে হলুদে রাতভর জমজমাট অনুষ্ঠান হলো বলে বিয়ের দিন সবাই দেরীতে জেগে উঠলো।

ঘুম থেকে জাগার পর দুইজন মানুষকে নিখোঁজ দেখা গেল। স্বয়ং বিয়ের কন্যা এবং মিরাজুলের কনিষ্ঠ পুত্র।

দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে কাতেবুল পাঁচ সেকেণ্ডে বুঝে ফেলে তার মেয়েকে নিয়ে মিরাজুলের পোলাটা ভাগছে। তাকে ধরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো আমি। মিরাইজ্যারে আমি এখন লাথি দিয়ে পুস্কুরনীতে ফেলে দেবো। খুন করে ফেলবো তোর গুষ্টিশুদ্ধা। শালা নেমক হারাম!

এরকম গালিগালাজ চলাকালীন কাতেবুলের শুভাকাংখী একজন পরামর্শ দিল খুনের কর্মসূচী আপাততঃ মুলতবী রেখে থানায় যাওয়া যাক। পুলিশকে কাজে লাগালে কাজ অনেক সহজ।

থানায় যাবার পথে পাশের জমিতে সাদা পাঞ্জাবীতে একজনকে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। কাছে গিয়ে দেখা গেল সেটি মিরাজের কনিষ্ঠপুত্রের লাশ।

ঘটনা এখানে এসে সম্পূর্ন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে।

জানাজানি হতেই শত শত লোক ছুটে এলো। কাতেবুল ইসলামে পা থানার বিপরীত দিকেই টানতে শুরু করলো এবার। থানায় গিয়ে মামলা করার বদলে তাকে এখন বলতে হবে, আমি খুন করি নাই!

খুনের দায় থেকে রেহাই পেতে কাতেবুলকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হলো। মিরাজুলকে আবারো বুকে টেনে নিতে হয়েছিল তাকে।

কিন্তু মিরাজুল কোনদিন তাকে ক্ষমা করতে পারেনি। আবার এটাও বুঝতে পারেনি কেন তার ছেলেকে খুন হতে হলো। তার সাথে কি কাতেবুলের মেয়ের কোন সম্পর্ক ছিল? সেরকম কোন ইঙ্গিত পায়নি কোনদিন।

অনেক তদন্ত করেও এই ঘটনার ব্যাপারে আর কিছুই জানা যায় না। রহস্য থেকে যায়। একসময় সবাই ভুলে যায়।

শেষ সংবাদঃ
কোন ঘটনাই চাপা থাকে না চিরকাল। বহুবছর পর জানা যায় কাতেবুলের মেয়েটা যাকে ভালোবাসতো তার সাথে যখন পালাচ্ছিল তখন কাতেবুলের কনিষ্ঠ সন্তানের চোখে পড়ে যায়। ছেলেটা তাদের পিছু পিছু কিছুদূর যাবার পর তাকে ধরে খুন করে ফেলে রেখে যায় মেয়েটার প্রেমিকের বন্ধুরা। এই সংবাদটা এমন সময় জানা যায় যখন কাতেবুল আর মিরাজুল দুই বন্ধুই পরপারের ঠিকানায় পৌঁছে গেছে। এরকম চটকদার সংবাদেও কোন সাড়া পড়ে না। কারো কোন উপকার হয় না।

No comments: