কেতাবী জ্ঞান না থাকলেও কাতেবুল ইসলামের কুতুবী বুদ্ধির কাছে মিরাজুল ইসলাম দুগ্ধপানরত বাছুর মাত্র। এক গাঁয়ের বাসিন্দা দুইজনই, দুই প্রান্তে বসবাস। শৈশব কৈশোরে একসাথে দুরন্তপনা করলেও দেশভাগের পর ভোল পাল্টে যায় কাতেবুল ইসলামের। দাঙ্গার সময় গ্রাম ছেড়ে পালানো এক হিন্দু পরিবারের সব সহায় সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব নেবার পর পুরো গাঁয়ের দায়িত্বও যেন তার উপর এসে পড়ে। সেই পরিবার আর ফেরেনি, সম্পদের দলিলে কাতেবুলের কারসাজির হাত পড়ে মালিকের ঠিকানা বদলে যায়। শুরুতে আপনি মোড়ল হলেও একসময় গাঁয়ের লোকেও তাকে মানতে শুরু করে। এক মিরাজুল ইসলাম ছাড়া।
মিরাজুল ইসলাম তাকে মোড়ল মানতে পারে না বন্ধুই মনে করে এখনো। বাল্যবন্ধু হলেও কাতেবুল ইসলাম ধনদৌলতের মালিক হবার পর থেকে মিরাজুলের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে থাকে। একসময় মিরাজুল বন্ধুকে হারিয়ে ফেলে চামুণ্ডাবেষ্টিত ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে। মিরাজুল প্রথম ভুলটি করে এক সালিশের দিনে। সেদিন সে কাতেবুলের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে কোন কথাবার্তা ছাড়াই। কাতেবুলের কাছে ব্যাপারটা বেয়াদবীর সামিল। ছেলেবেলায় নেংটা হয়ে এক পুকুরে গোসল করেছি বলে এখনো এক বিছানায় ঘুমাবো তা কখনো হয় না। গাঁয়ের লোক কিন্তু এতে কিছু মনে করে না, জানে দুজনেই বাল্য দোস্ত। কাতেবুল মনে মনে খুবই রুষ্ট হয় কিন্তু মুখফুটে কিছু বলতে পারে না। মনে মনে চেপে রাখে।
মেজাজ ঠাণ্ডা করতেই বোধহয় কাতেবুল একদিন একটা মোটর সাইকেল কিনে ফেললো। নানান কাজে তাকে জেলা শহরে যাতায়াত করতে হয়। মোটরসাইকেলের দরকারটা ফেলনা নয়। জেলাশহর থেকে ফেরার সময় দুনিয়া কাঁপিয়ে ভটভট করে যখন তালতলার মেঠো পথে নামে তখন গাঁয়ের লোক কেন যেন একটু তটস্থ হয়ে পড়ে।
মিরাজুলের মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি পৌঁছানোর আগেই কাতেবুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তার মেয়ের বিয়েটা এমন জাঁকজমক করবে তা সাত গ্রামের লোকে দেখেনি। জেলা শহর থেকে বাবুর্চি, শহরের নামকরা ব্যাণ্ডের বাদক দল, মহাসড়ক থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তার পুরোটাই সাতদিন ধরে আলোকসজ্জা চলবে।
ঘুম থেকে জাগার পর দুইজন মানুষকে নিখোঁজ দেখা গেল। স্বয়ং বিয়ের কন্যা এবং মিরাজুলের কনিষ্ঠ পুত্র।
দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে কাতেবুল পাঁচ সেকেণ্ডে বুঝে ফেলে তার মেয়েকে নিয়ে মিরাজুলের পোলাটা ভাগছে। তাকে ধরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো আমি। মিরাইজ্যারে আমি এখন লাথি দিয়ে পুস্কুরনীতে ফেলে দেবো। খুন করে ফেলবো তোর গুষ্টিশুদ্ধা। শালা নেমক হারাম!
এরকম গালিগালাজ চলাকালীন কাতেবুলের শুভাকাংখী একজন পরামর্শ দিল খুনের কর্মসূচী আপাততঃ মুলতবী রেখে থানায় যাওয়া যাক। পুলিশকে কাজে লাগালে কাজ অনেক সহজ।
থানায় যাবার পথে পাশের জমিতে সাদা পাঞ্জাবীতে একজনকে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। কাছে গিয়ে দেখা গেল সেটি মিরাজের কনিষ্ঠপুত্রের লাশ।
ঘটনা এখানে এসে সম্পূর্ন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে।
ঘটনা এখানে এসে সম্পূর্ন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে।
জানাজানি হতেই শত শত লোক ছুটে এলো। কাতেবুল ইসলামে পা থানার বিপরীত দিকেই টানতে শুরু করলো এবার। থানায় গিয়ে মামলা করার বদলে তাকে এখন বলতে হবে, আমি খুন করি নাই!
খুনের দায় থেকে রেহাই পেতে কাতেবুলকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হলো। মিরাজুলকে আবারো বুকে টেনে নিতে হয়েছিল তাকে।
কিন্তু মিরাজুল কোনদিন তাকে ক্ষমা করতে পারেনি। আবার এটাও বুঝতে পারেনি কেন তার ছেলেকে খুন হতে হলো। তার সাথে কি কাতেবুলের মেয়ের কোন সম্পর্ক ছিল? সেরকম কোন ইঙ্গিত পায়নি কোনদিন।
অনেক তদন্ত করেও এই ঘটনার ব্যাপারে আর কিছুই জানা যায় না। রহস্য থেকে যায়। একসময় সবাই ভুলে যায়।
শেষ সংবাদঃ
কিন্তু মিরাজুল কোনদিন তাকে ক্ষমা করতে পারেনি। আবার এটাও বুঝতে পারেনি কেন তার ছেলেকে খুন হতে হলো। তার সাথে কি কাতেবুলের মেয়ের কোন সম্পর্ক ছিল? সেরকম কোন ইঙ্গিত পায়নি কোনদিন।
অনেক তদন্ত করেও এই ঘটনার ব্যাপারে আর কিছুই জানা যায় না। রহস্য থেকে যায়। একসময় সবাই ভুলে যায়।
শেষ সংবাদঃ
কোন ঘটনাই চাপা থাকে না চিরকাল। বহুবছর পর জানা যায় কাতেবুলের মেয়েটা যাকে ভালোবাসতো তার সাথে যখন পালাচ্ছিল তখন কাতেবুলের কনিষ্ঠ সন্তানের চোখে পড়ে যায়। ছেলেটা তাদের পিছু পিছু কিছুদূর যাবার পর তাকে ধরে খুন করে ফেলে রেখে যায় মেয়েটার প্রেমিকের বন্ধুরা। এই সংবাদটা এমন সময় জানা যায় যখন কাতেবুল আর মিরাজুল দুই বন্ধুই পরপারের ঠিকানায় পৌঁছে গেছে। এরকম চটকদার সংবাদেও কোন সাড়া পড়ে না। কারো কোন উপকার হয় না।
No comments:
Post a Comment