-একটা ঘান গাইবার কথা ছিল, ঘান
-ঘান নয় গাধা, গান
-না, ঘান
-ঘান কি করে হয়
-হয়, এরকম সময়ে ঘান হতে হয়, আমি গলা ছেড়ে ঘান গাইবো
-এতো দেখি পাড় মাতাল, শালা!
-ঐ গালি দিবি না, আমি তোর শালা কেমনে, তুই তো বিয়াই করিস নাই
-বিয়া করি নাই তো কি হইছে, করছি তো
-কি করছিস
-যা ইচ্ছে করছি,এবার ঘান গাইতে হবে
-ধুশশালা মাতোয়াল!
-ঐ আবারো গালি দেস?? আমি তোর গলাটা চেপে ধরবো, আয় হারামী.....কাছে আয়। আমি তোর গলা টিপে ধরে কাঁদি, আয় দুজনে কেঁদে কেঁদে ঘান গাই। দোতলার বারান্দা থেকে দুই মাতালের গলাগলি আর গালাগালি শুনছিলাম মাঝরাতে। আমার ঘুম আসছে না। ঘরের ভেতর প্রচণ্ড গরম। কারেন্ট নেই। মশার ভ্যানভ্যান। সব মিলিয়ে ভীষণ অস্বস্তিকর একটা রাত। রাত দুটো বাজে এখনো ঘুমের দেখা নেই। প্রতিদিন এরকম হচ্ছে। মাঝরাতে উঠে বসি। আমার রুমমেট গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অসুখে পড়েছে। গত কয়েকদিন একাকী রাত্রিযাপন।
সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরে হারিক্যানটা জ্বালিয়ে রাখি। যখন তখন কারেন্ট চলে যায় বলে নয়। আমার নিজস্ব শখে। আমার পড়াশোনার বাতিক আছে একটু, কিন্তু টাকাপয়সার অভাবে তেমন বইপত্র কেনা হয় না। ফুটপাত থেকে পুরোনো ঈদসংখ্যা কিনে জমিয়েছি কিছু। সময় পেলে ওগুলোই পড়ি। মোটা মোটা ম্যাগাজিনগুলো অনেক সস্তা। একেকটা সংখ্যায় দশ পনেরোটা উপন্যাস থাকে। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে অনেক পাওয়া।
আমি মেট্রিক পাশ করার পর গ্রাম থেকে চলে আসি সংসারের হাল ধরার জন্য। টাইপের কাজটা শিখেছিলাম বলে একটা কাজ পেয়ে যাই। সারাদিন খুটখাট টাইপ করে মাস শেষে যা পাই তাতে সংসারের হাল ধরা যেতো না। তাই ভাবি যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে।
দুর্ভাগাদের জন্য ধার্মিকেরা আশ্বাসবাণী ছড়ায়। আল্লায় যা করে ভালোর জন্যই করে। হ্যাঁ আমি জানি। খুব ভালো করে জানি এখন। সব ভালোর কারিগর সেই। এমনকি এক অসুখে আমার মা আর ছোটভাইটা এক সপ্তাহের মধ্যে দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েও খুব ভালো কাজ করেছে। সবই তাঁর ইশারায়।
সংসারের হাল ধরার জন্য এখন আর হিমশিম খেতে হয় না। চার হাজার টাকা বেতনে আমার খুব ভালো চলে যায়।
মেসের সবগুলো ঘরে কারেন্ট আছে। শুধু আমার ঘরে নাই। আমার ঘরে লাইন আছে। কিন্তু বাতি না জ্বালালে ভাড়া ১০০ টাকা কম। পঞ্চাশ টাকার কেরোসিনে আমার সারা মাস চলে যায়। তাই বাতি লাগাই নাই। তাছাড়া বাতি ফিউজ হলে আমার কিনে লাগাতে হবে। একটা বাল্বের টাকায় দুই সপ্তার কেরোসিন হয়ে যায়। এটা কি যথেষ্ট জোরালো কারণ নয়?
হারিক্যানটা আমার কিনতে হয়নি। চিমনিও বহু পুরোনো। কালসিটে দাগ পড়েছে, তবু বদলাই না। আমি সন্ধ্যাবেলায় হারিক্যান জ্বালিয়ে পড়াশোনা করি। যেমন করতাম গ্রামের স্কুলে পড়ার সময়। তখন মা হারিক্যানটা ঝেড়ে মুছে জ্বালিয়ে দিতেন। চিমনিতে খাতার কাগজ ছিঁড়ে চারভাঁজ করে একটুকরো কাগজও লাগিয়ে দিতেন। চোখে আলো আসলে পড়তে অসুবিধা।
আমি সেই অভ্যেসটা এখনো চালু রেখেছি। পুরোনো ঈদসংখ্যার বিজ্ঞাপনের পাতা ছিড়ে চারভাঁজ করে হ্যারিকেনের চিমনিতে আটকে দেই। চোখে আরাম লাগে। পড়তে কষ্ট হয় না আর চোখের জলও আড়াল হয়।
আসল ব্যাপারটা সসংকোচে বলেই ফেলি।
আমি প্রত্যেক সন্ধ্যায় নিয়ম করে চোখের জল ফেলি। পুরুষ মানুষের চোখের জল লজ্জার বিষয়। কিন্তু এই হ্যারিকেনের সামনে বসলে আমার চোখে জল না এসে পারে না। এই উজ্জ্বল শহরে আমি পুরোনো চিমনির মধ্যে যে আমার মায়ের মুখ দেখি। এই হ্যারিকেন আমার আমরণের সঙ্গী!
No comments:
Post a Comment