আমি ছোট একটা দেশে বাস করি। দেশ ছোট কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের হা তার শরীরের চেয়েও বড়। তারা চাইলে আস্ত মানুষ খপখপাখপ করে খেয়ে ফেলতে পারে। আমি সেই দেশের ছোট মুখের মানুষ। আমি একদিন রাজার কাছে আবেদন করলাম আমি জলপাই আচারের কারখানা বানাবো। রাজা অনেক চিন্তা ভাবনা করে বললো, তুমি উজিরের সাথে কথা বলো। আমি গেলাম উজিরের কাছে। উজির বললো, তুমি নাজিরের কাছে গিয়ে বলো। নাজিরের কাছে গেলাম। নাজির বললো, তুমি গোমস্তার সাথে কথা বলো। আমি গোমস্তার কাছে গেলাম।
গোমস্তা আমাকে আসতে দেখে দরোজা বন্ধ করে দিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু আমাকে তো কথা বলতেই হবে। দরোজার কড়া নাড়তে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর, দরোজার ফাঁক দিয়ে একটা রক্তচক্ষু বের হয়ে বললো, তোর এত সাহস আমার ঘরের দরোজা ঝাঁকাঝাকি করিস? দাড়া কোতোয়াল দিয়ে তোকে শায়েস্তা করি। আমি ভয়ে গোমস্তার কাছে মাফ চাইলাম হাত জোড় করে। জোড়হাতের নতজানুত্বে একটু যেন মন গলে গেল গোমস্তার। তারপর আসল কথা পাড়লাম।
গোমস্তা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বললো। বড় কঠিন আবদার। দেশে তো জলপাই সংকট আছে, আচার বানিয়ে শেষ করে ফেললে দেশের লোক খাবে কি। আচ্ছা, তবু তুই যখন আবদার করলি, ভেবে দেখি কি করা যায়। কালকে আসিস।
পরদিন গেলাম। গিয়ে দেখি দরজায় তালা। সে কোথাও গেছে। আমি সারাদিন অপেক্ষা করে ফিরে আসলাম। তারপরদিন আবারো গেলাম। তিনদিন ব্যর্থ হবার পর চতুর্থ দিনের সকালে অনেক কড়া নাড়ানাড়ির পর দরোজা খুলে বললো, কি রে কী চাস?
আমি অবাক হলাম আমাকে ভুলে গেছে দেখে। স্মরণ করিয়ে দিতেই বললো, ও সেই কথা? আচ্ছা কাল আসিস। আজ আরো একটু ভাবি। রাজার অনুমতি ছাড়া হবে না। বড্ড কঠিন কাজ। সরাসরি তো রাজার কাছে যাওয়া যায় না।
আমি ফিরে আসতে গেলে পেছন থেকে ডাক দিল। তুই যে জলপাই আচার বানাবি, টাকাপয়সা আছে তোর? বললাম, আছে। জিজ্ঞেস করলো কত আছে? বললাম ২০০ টাকা আছে।
চোখ জ্বলজ্বল করে বললো, এত টাকা!! ঠিকাছে কালকে ২০ টাকা নিয়ে আসিস। দেখি রাজার কাছে পৌঁছানো যায় কিনা।
অনেক কষ্টে রাজার অনুমতি জোগার করে জলপাই আচার বানাবার কারখানা খুললাম। অনুমতি পত্রে লিখে দিয়েছিল- জলপাই বানাতে যা যা লাগবে সবকিছুর যেন পাই পাই হিসেব রাখি। রাজা চাহিবামাত্র প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। আমি জলপাই আচার বানাতে যা যা লাগে সবকিছুর হিসেব রাখি। জলপাই, তেল, সরিষা, আদা, রসুন, পেয়াজ, পাঁচফোড়ন, নুন, গরম মশলার গুড়া সবকিছু লিখে রাখি। আমার গুদামে নানান সাইজের বৈয়ামে থরে থরে সাজানো আচার।
একদিন গোমস্তা এলো কারখানা দেখতে। বললো, রাজার হুকুমে সব ঠিক আছে কিনা দেখতে এলাম। আমি খুশীমনে রাজার উপর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গোমস্তাকে সব হিসেব বুঝিয়ে দিতে লাগলাম। গোমস্তা গম্ভীর মুখে সবকিছু দেখেটেখে বললো, হিসেব তো রেখেছিস, কিন্তু কোন বৈয়ামে কতটা জলপাই তার হিসেব আছে তো?
আমি ওজন মেপে হিসেব রাখি। কিন্তু গুনে গুনে রাখতে হবে ভাবিনি। গোমস্তাকে বললাম, আজ্ঞে গুনে তো রাখিনি।
সাথে সাথে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো গোমস্তা। এত বড় সাহস তোর!! হুকুম করা সত্ত্বেও তুই সব হিসেব রাখিস নি? আমি এখন রাজাকে কী জবাব দেবো।
আমি তখন একটা বৈয়াম থেকে আচার ঢেলে জলপাই গুনে ফেললাম। বেশি সময় লাগলো না। পনের মিনিটে গুনে বের করলাম ৩৯টা জলপাই ধরেছে এই বৈয়ামে। হিসেব শুনে আরো গম্ভীর হয়ে গেল গোমস্তার চেহারা। মাথা নাড়তে লাগলো সে। বললো, এভাবে তো হবে না বাপু। শুধু কি জলপাই এখানে? বাকী মশলার হিসেব কি আমি বের করবো? শোনো হে বাপু। যদি আচারের কারখানা রাখতে চাও তাহলে কালকের মধ্যে আমাকে প্রতি বৈয়ামের হিসেব দিবা। কতটা জলপাই, কতফোটা তেল, কত দানা সরিষা, কতদানা পাঁচফোড়ন, সব হিসেব চাই।
এই হুকুম জারি করে সে চলে গেল। রাতে আমার ঘুমই এলো না। এই হিসেব কেমনে দেবে। এতকিছু গুনে রাখা কি সম্ভব? সে কি আচার বানাবে নাকি সরিষাদানা গুনবে বসে। তার চেয়ে ব্যবসা বন্ধ করে চলে যাবো। চিন্তায় আমার মাথার চুল যেন অর্ধেক পেকে গেল রাতে।
পরদিন গোমস্তা এলো, সাথে কোতোয়াল। কোতোয়ালের হাতে খাপখোলা চকচকে এক ছুরি। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।
কোতোয়াল এসে এক বৈয়াম আচার জব্দ করে বললো, এই আচার কতটা বিশুদ্ধ তা রাজার হুকুমে চেক করে দেখতে হবে। তারপর গোমস্তা এসে ফিসফিস করে বললো, তোর জন্য একটা উপায় বের করেছি। কোতোয়াল আর আমাকে দুই বৈয়াম আচার দিবি আর নগদে দিবি ৫০ টাকা। তোর যত খুশী সরিষা দে, যতখুশী জলপাই। কোন হিসেব লাগবে না। যাহ তোর জন্য এইটা করে দিলাম। এবার বিদায় কর আমাদের দুজনকে।
আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। জলপাই বিক্রি করেও ৫০ টাকা আয় করি না। এদেরকে ৫০ দিলে আমার উপায় কি। এ কথা বলতেই রক্তচক্ষু মেলে গোমস্তা বললো, তাহলে তোর কারখানা বন্ধ আজ থেকে।
আমি ছুটে গেলাম নাজিরের কাছে। ঘটনা খুলে বলতেই নাজির বললো, ১০০ টাকা রেখে যাও। দেখি কি করতে পারি। আমি পাগলের মতো ছুটলাম উজিরের কাছে। উজির বললো ২০০ টাকা দাও দেখি কোন উপায় করা যায় কিনা। আমি উপায় না দেখে রাজার কাছে ছুটে গেলাম। রাজা আমাকে দেখেই বললেন, তোমার কারখানার অবস্থা তো ভালো না হে। আচার খেয়ে লোকজন অসুস্থ হয়েছে বিস্তর। তোমার জরিমানা হবে ৫০০ টাকা। কারখানা বন্ধ করে তুমি গায়ে ফিরে গিয়ে ৫০০ টাকা কোষাগারে জমা দিয়ে যাও। নইলে তোমাকে শূলে চড়ানো হবে।
আমি গ্রামে গিয়ে জমিজোত বিক্রি করে ৫০০ টাকা জরিমানা শোধ করে শূলের হাত থেকে রক্ষা পেলাম।
গ্রামে ফিরে বুড়ো ওস্তাদের কাছে সবকিছু খুলে বলার পর তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে বললেন, আরো দেড় হাজার বছর পর গাঙ্গেয় অঞ্চলে বান্দেশ নামের যে দেশের জন্ম হবে, সেই দেশটাও আমাদের এই হা-গিলে দেশের মতো হবে। সেই দেশ শাসন করবে হা-গিলের বংশধরেরা।
আমি স্পষ্টতঃই বুঝলাম, এই বুড়োর মাথাটা একেবারে পচে গেছে!
No comments:
Post a Comment