ওদের দুজনের কথা আমার খুব মনে পড়ে।
আরো মনে পড়ে তখন বিটিভিতে অ্যালেক্স হ্যালীর রুটস দেখাচ্ছিল আর আমি তখন ভার্সিটির নবীন ছাত্রের গন্ধ কাটিয়ে উঠছিলাম মাত্র। সংসারে তখন তীব্র অভাব, পড়াশোনা করাটা বিলাসীতারই নামান্তর। তবু কিভাবে যে চলছিল! চলছিল কারণ বাবা নামের বটগাছটি ছিল। যে বটগাছটি কয়েক বছর আগেও সুখের পায়রাদের নিয়ে বিত্তবান সমাজে আনন্দ উল্লাসে সময় কাটাতো সেই বটগাছ এখন পত্র পল্লব হারিয়ে ঘরের কোনে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছিল। সেই ঘরটিতে বাবার নিত্য সঙ্গী ছিল ১৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনটা যা বিকেল পাঁচটায় জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জেগে উঠতো, ঘুমাতো রাত বারোটায় জাতীয় পতাকা দেখাবার পরে। সেই সময়ের অধিকাংশ বাবা খুব মন দিয়ে টেলিভিশনে ডুবে থাকতো। মা বিরক্ত হতো, আমরাও কখনো কখনো। বাবা টিভি রুমে থাকলে রুটস ম্যাকগাইভার বা বিশ্বকাপের খেলাটেলা দেখা হলেও মুভিটুভিগুলো দেখতে সাহস পেতাম না। টিভির জাতীয় পতাকা দেখানোর অনেক পরেও বাবা জেগে থাকতেন। ঘুম আসতো না হয়তো। কেন আসতো না আমাদের বোঝার বয়স হয়তো হয়নি, অথবা আমরা সেদিকে দেখতে চাইতাম না।
ঠিক সেরকম একটা সময়ে কুনতা কিনতে আমাদের ঘরে আসে। একদিন বাবা বাজারে গিয়ে গোশতের বদলে দুটো ফুটফুটে খরগোশ ছানা নিয়ে ফিরেছিল। মায়ের তিরস্কারের মুখেও আমরা ভাইবোন চুপি চুপি বাবার পাশে গিয়ে খরগোশ দুটোকে দেখছিলাম এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই আদর করে ওদের নামকরণ করা হলো কুনতা কিনতে। রুটসের সেই বিখ্যাত দাস চরিত্র। ঘরে বাজার করার টাকা নেই কিন্তু খরগোশের জন্য তারের জালির সুন্দর ঘর তৈরী হয়ে যায়। ওদের জন্য আসতে থাকে খাবার দাবার সবজি। আরো মনে পড়ে তখন বিটিভিতে অ্যালেক্স হ্যালীর রুটস দেখাচ্ছিল আর আমি তখন ভার্সিটির নবীন ছাত্রের গন্ধ কাটিয়ে উঠছিলাম মাত্র। সংসারে তখন তীব্র অভাব, পড়াশোনা করাটা বিলাসীতারই নামান্তর। তবু কিভাবে যে চলছিল! চলছিল কারণ বাবা নামের বটগাছটি ছিল। যে বটগাছটি কয়েক বছর আগেও সুখের পায়রাদের নিয়ে বিত্তবান সমাজে আনন্দ উল্লাসে সময় কাটাতো সেই বটগাছ এখন পত্র পল্লব হারিয়ে ঘরের কোনে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছিল। সেই ঘরটিতে বাবার নিত্য সঙ্গী ছিল ১৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনটা যা বিকেল পাঁচটায় জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জেগে উঠতো, ঘুমাতো রাত বারোটায় জাতীয় পতাকা দেখাবার পরে। সেই সময়ের অধিকাংশ বাবা খুব মন দিয়ে টেলিভিশনে ডুবে থাকতো। মা বিরক্ত হতো, আমরাও কখনো কখনো। বাবা টিভি রুমে থাকলে রুটস ম্যাকগাইভার বা বিশ্বকাপের খেলাটেলা দেখা হলেও মুভিটুভিগুলো দেখতে সাহস পেতাম না। টিভির জাতীয় পতাকা দেখানোর অনেক পরেও বাবা জেগে থাকতেন। ঘুম আসতো না হয়তো। কেন আসতো না আমাদের বোঝার বয়স হয়তো হয়নি, অথবা আমরা সেদিকে দেখতে চাইতাম না।
আমরা অভাবের কথা ভুলে খরগোশ নিয়ে মেতে থাকি কদিন। আমাদের সামনের সবুজ বাগানে খরগোশ দুটো ছোটাছুটি করতো, খেলা করতো নিজেদের সাথে আর আমাদের সাথে। আমাদের সবচেয়ে কনিষ্ঠ বোনটার খুব প্রিয় হয়ে যায় কুনতা কিনতে। ওর প্রিয় সবকিছু আমারও প্রিয়, আমার প্রিয় সবকিছু ওরও প্রিয়। ফলে আমিও কুনতা কিনতের ভক্ত হয়ে যাই। আমাদের আনন্দ দেখে বাবাও কিছুসময় ভুলে থাকেন সংসার যন্ত্রণা।
মাঝে মাঝে সীমানা ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তায় উঁকি দিত। তখনো পাকা রাস্তা হয়নি ওদিকে। চারদিকে ধানক্ষেত। পূর্ব পশ্চিমের রাস্তাটা মাটির তৈরী। বর্ষাকালে ডুবুডুবু হয়ে উঠতো বিল উপচে পড়লে। রাস্তার দিকে উঁকি দিলেও বের হবার সাহস করতো না, কুকুরের ভয়ে।
কিভাবে কি ঘটলো কিছুই বোঝা গেল না। আপাতঃ দৃষ্টিতে বেড়াল বা কুকুরের আক্রমণে মারা গেছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু কোন শব্দ শুনলাম না কেন?
দায়মুক্তির জন্যই বোধহয় একদিন তাই বাবা ওকে খাঁচায় পুরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চিড়িয়াখানায় দান করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। অশ্রুসজল চোখে কুনতাকে বিদায় জানালাম আমরা। ভরসা এটুকু যে আমাদের আদর থেকে বঞ্চিত হলেও অন্ততঃ বাকী জীবন সঙ্গীহীন থাকবে না চিড়িয়াখানায়। সঙ্গীহীন জীবন যে কোন প্রাণীর জন্যই সমান দুঃসহ।
বহুকাল কেটে গেছে, ওদের দুজনকে আমি আজো ভুলতে পারি না। পৃথিবী থেকে চলে গিয়েও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল এখনো। পৃথিবীর বয়েস ২০ বা ২৫ বছর বেড়ে গেছে ইতিমধ্যে?
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয়
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-
তখন হলুদ নদী নরম নরম হয়
শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে !
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাই আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড় ছড়াতেছে;
মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল !
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের ঝাউয়ের-আমের,
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে-
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাঁকে কোথায় লুকায় আপনাকে !
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-
সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !
[ কবিতা এবং শিরোনাম কৃতজ্ঞতাঃ জীবনানন্দ দাশ]
No comments:
Post a Comment